জলপানের পর ভেড়াগুলো চারিদিককার সবুজ ঘাসের ওপর চরে বেড়াতে লাগল। লোমস কুকুরটা অতিরিক্ত গরম বোধ করছিল, কাজেই সে তার প্রভু বা ভেড়ার পাল কারও অনুকরণ না করে ঝর্ণার জলের মধ্যে বসে পড়ল। তার পেট হাপরের মতো ওঠা-নামা করছিল। আর তার লম্ভা লাল জিভ মুখ থেকে বেরিয়ে থরথর করে কাঁপছিল। ঝর্ণার নীচে মুখ রেখে এক নি:শ্বাসে তরুণ তার পিপাসা দূর করল। তারপর চোখে জল দিয়ে সামনের চুল গোড়া পর্যন্ত ভিজিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। তার অরুণাভ গাল এবং লাল ঠোঁট দুটো ঢেকে ফেলবার জন্য সবে মাত্র পিঙ্গল রোমরাজির উদগম হতে আরম্ভ করেছে। খুশী মনে ভেড়াগুলোকে চরতে দেখে ঝুড়ির পাশে বসে পড়ল সে। কান খাড়া করে স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কুকুরের চোখের ভাব পরখ করে ঝুড়ির এক পাশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল, তারপর একখণ্ড খণ্ড ভেড়ার মাংস বের করে কোমরবন্ধনী থেকে প্রলম্বিত চামড়ার খাপে মোড়া ধারালো তামার ছুরি দিয়ে কেটে কিছু নিজে খেল আর কিছুটা কুকুরকে খাওয়াতে লাগল। এমন সময় কাঠের ঘণ্টার খট্খট্আওয়াজ শোনা গেল। তরুণ দূর থেকে দেখল—ঝোপের আড়ালে অর্ধেক ঢাকা অবস্থায় এক গাধাকে আসতে। তার পিছনে পিছনে এক ষোড়শী তরুণী তারই মতো পোষাক ও পিঠে ঝড়ি নিয়ে আসছে। হাল্কাভাবে শিস্দিতে লাগল তরুণ। সে যখনই কিছু ভাবতে থাকে—তার মুখ থেকে নি:শ্বাসের মতোই স্বত:স্ফুর্তভাবে এমনি শিসের আওয়াজ বেরিয়ে পড়ে। ষোড়শীর কানে একবার অন্তত শিসের আওয়াজ পৌছাল এবং সেইদিক লক্ষ্য করে তাকালও কিন্তু তরুণের দেহ লতাগুল্মের আড়ালে ছিল। তরুণ যদিও হাত পঞ্চাশ দূরে থেকে দেখছিল, তবু ষোড়শীর মুখের হাল্কা অথচ সুন্দর এক ছাপ তার অন্তস্থলে রেখাপাত করছিল, তাই উন্মুখ আগ্রহে জানবার প্রতীক্ষায় বসে রইল—কোথায় চলেছে ওই তরুণী। এ-ধারে বক্ষুর ওপরে আর কোনো বসতি নেই এ কথা তরুণ জানত, কাজেই সেও যে প্রথাচারিণী তা বুঝতে পারল। অপরিচিত ষোড়শীকে দেখে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করল, তরুণ ‘চুপ’ বলতেই সেখানে চুপ করে বসে গেল। ষোড়শীর গাধাটি জল খেতে লাগল, তরুনী তার পিঠ থেকে ঝুড়ি খুলতেই তরুণটি এগিয়ে এসে শক্ত হাতে সেটাকে নামিয়ে নিচে রেখে দিল। মৃদু হেসে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তরুণী বলল, ‘‘বড্ড গরম আজ।’’
‘‘গরম নয়, চড়ািই পেরিয়ে আসবার জন্যে এ রকম মনে হচ্ছে। একটু বিশ্রাম নিলেই ঘাম শুকিয়ে যাবে।’’
‘‘এই সময়টাতে দিনগুলো বেশ ভালো থাকে।’’
‘‘আর দশ-পনের দিনের মধ্যে বৃষ্টি হবার ভয় নেই।’’
‘‘বৃষ্টিকে আমার সত্যিই বড় ভয়। নালার জলে আর পিছল কাদায় রাস্তাগুলো এত বিশ্রী হয়ে যায়!’’
‘‘গাধাগুলোর পক্ষে পথ চলা আরও মুশকিল হয়ে পড়ে।’’
‘‘বাড়িতে আমাদের ভেড়া নেই বলে আমি গাধা নিয়ে বেরিয়েছি। আচ্ছা, বন্ধু তুমি কোথায় যাবে?’’
‘‘পাহাড়ের ওপর, আজকাল আমাদের ঘোড়া, গরু ভেড়া সব ওখানেই আছে।’’
‘‘আমিও ঐখানেই যাচ্ছি। আমি ছাতু, ফল, নুন এইসব পৌছে দিতে যাচ্ছি।’’
‘‘তোমার পশুদের কে দেখছে সেখানে?’’
‘‘আমার প্রপিতামহ, আর ভাইবোনেরাও আছে।’’
‘‘বাবার ঠাকুর্দা! সে নিশ্চয় খুবই বুড়ো?’’
‘‘খুবই বুড়ো। এত বুড়োমানুষ বোধহয় কোথাও দেখা যায় না।’’
‘‘তবে পশুদের কি করে দেখাশোনা করে?’’
‘‘এখনও খুব শক্ত সমর্থ আছে। তার চুল, ভ্রু সব সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু দাঁত এখনও প্রায় নতুনের মতো রয়েছে। দেখলে পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বয়স বলে মনে হয়।’’
‘‘তা‘হলে তো তাকে ঘরেই বসিয়ে রাখা উচিত।’’
‘‘রাজীই হয় না। আমার জন্মের আগে থেকে সে গাঁয়ে যায়নি কখনো।’’
‘‘গাঁয়ে যায়নি!’’
‘‘যেতে চায় না। গাঁ-কে সে ঘৃণা করে। বলে, ‘মানুষ এক জায়গায় বন্দী হয়ে থাকবার জন্যে জন্মায়নি।’ অনেক প্রাচীন কাহিনী আমাদের শোনায়। আচ্ছা তোমার নাম কি বন্ধু?’’
‘‘পুরুহুত মাদ্রীপুত্র পৌরব। আর তোমার নাম বোন?’’
‘‘রোচনা মাদ্রী।’’
‘‘তা‘হলে তুমি তো আমার মাতুলকুলের লোক! তোমরা উত্তরমাদ্র না নিম্ন?’’
‘‘উত্তরমাদ্র।’’
বক্ষু নদীর বামতটে পুরুদের গ্রাম, কিন্তু তার নিম্নভাগ—যা নীচের সমতলভূমির সঙ্গে মিশেছে—মমুদের অধিকারে ছিল। দক্ষিণতটে উপরিভাগ মাদ্র এবং নিম্নভাগ পরশুদের অধিকারে ছিল। ভূমি এবং জনসংখ্যার বিচারে পুরুরা মাদ্রদের চেয়ে ছোট ছিল না। পুরুদের নিম্নে অবস্থিত মাদ্রদের নিম্নমাদ্র বলা হত। রোচনা উচ্চমাদ্রের বংশ।
এইসব জানবার পর দু‘জনেই আরও অধিক আত্মীয়তা অনুভব করল। পুরহুত বলল, ‘‘রোচনা, আজ কিন্তু আমরা পাহাড়ের ওপর পৌছাতে পারব না। কিন্তু একলা আসবার সাহস তুমি কোত্থেকে পেলে?’’
‘‘হ্যাঁ, আমি জানতাম যে রাতে চিতাবাঘের হাত থেকে গাধাগুলোকে বাঁচানো মুশিকিল, কিন্তু বুড়ো মানুষটির জন্য খাওয়ার জিনিস আনবার দরকার ছিল পুরহুত। আমার ওপর তিনি অনেকখানি ভরসা করেন। আমি ভেবেছিলাম যে রাস্তায় আরও কেউ হয়ত জুটে যাবে, আজকাল ওপরে অনেক লোকই যায়। আর এও মনে করেছিলাম রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে নিলেই কাজ চলে যাবে।’’
‘‘রাস্তায় চলতে চলতে আগুন জ্বালানো সম্ভব নয়। তোমার কাছে কি অরণী আছে?’’
‘‘আছে।’’
‘‘থাকলেও অরনী ঘর্ষণ করে আগুন জ্বালানো সহজ কাজ নয়। যা‘হোক আমার কাছে এক পবিত্র অরণী আছে, পিতামহের আমল থেকে আমাদের ঘরে এটা ব্যবহৃত হচ্ছে। এই অরণীর আগুনে বহু যজ্ঞ, বহু দেবপূজার অনুষ্ঠান হয়েছে। অগ্নিদেবতার মন্ত্রও আমার জানা আছে, কাজেই এ দিয়ে তাড়াতাড়িই আগুন জ্বলে যায়।