মূহুর্তে মধ্যে চল্লিশটি ঘোড়া সংগ্রহ হল। পুরুরা যতগুলি পশু জড়ো করতে পেরেছিল তা‘ তারা উপত্যকার অপর পারে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুরো দু‘ঘণ্টা্ পশ্চাৎধাবনের পর ঊষার আলো ফোটার সময় কুরুগণ তাদের দেখতে পেল। ঘোড়া আর গরুর দল-গুলিকে একত্রিত একটি পাহাড়ের ওপর তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা সহজ কাজ ছিল না। পুরু অশ্বারোহীগণ তাদের চামড়ার চাবুক বাতাস এবং পাথরের ওপর আঘাত করে ভয়াতুর করছিল। অমৃতাশ্ব দেখল যে, পুরুরা সংখ্যায় প্রায় শ‘খানেক হবে। মাত্র চল্লিশটি ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা উচিত কি অনুচিত তা নিয়ে বেশীক্ষণ অযথা মাথা ঘামাতে চাইল না। শিংয়ের লম্বা ভল্ল বাগিয়ে অমৃতাশ্ব শত্রুর ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিল। কুরু বীর এবং বীরাঙ্গণাগণ সম্মুখে ঘোড়া ছোটাল। তাদের দেখা মাত্রই পুরুরা কিছু লোককে পশুগুলিকে আটকিয়ে রাখবার জন্যে ছেড়ে দিল। পুরুগণ নীচের দিকে ছূটতে লাগল্ এবং ঘোড়ার পুরো সুযোগ গ্রহণের জন্য নদী তীরের একটি উন্মুক্ত মাঠে দাঁড়িয়ে কুরুদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অমৃতাশ্বের সে মূর্তি তখন সত্যিই দেখবার মতো । অমৃতাশ্বের ঘোড়া অমৃত, এখন দু‘জনকেই অভিন্ন মনে হচ্ছিল। তার হরিণের সুতীক্ষ্ণ ভল্ল একবার যার শরীরে লাগত, দ্বিতীয় আঘাতের জন্য তাকে ঘোড়ার ওপর বসে থাকতে হত না। পুরুগণ ধর্নুবাণ ও পাষাণ-পরশুর ওপর বেশী নির্ভর করে ভুল করেছিল। যদি তাদের কাছে অত শিংয়ের ভল্ল থাকত তা‘হলে নিশ্চয়ই কুরুরা তাদের মোকাবিলা করতে পারত না। যুদ্ধ এক ঘণ্টা চলছে, পুরুগণ তখনও সংগ্রাম করছিল। কিন্তু তাদের এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা হতাহত হয়েছে, এটাই হল ভয়ের কারণ। ঠিক এই সময় ত্রিশজন কুরু অশ্বারোহী যুদ্ধক্ষেত্রে এসে হাজির হল। কুরুদের সাহস অনেক বেড়ে গেল। পুরুগণ ভয়ানকভাবে প্রাণ হারাতে লাগল। নিজেদের অবস্থা খারাপ দেখে যে অশ্বারোহীদের লুণ্ঠিত পশুগুলিকে আগ্লাবার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তারাও এসে হাজির হল কিন্তু ঠিক এই সময়ে চল্লিশ জনের একটি কুরু নারীর দল নিয়ে মধুরা এসে যুদ্ধে যোগ দিল; দেড় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হল। অধিকাংশ পুরু হতাহত হল আর কিছু পালিয়ে গেল। আহতদের শেষ করে কুরুবাহিনী পুরুদের গ্রামের দিকে এগিয়ে গেল। গ্রাম চার ক্রোশের ওপর! সমস্ত গ্রাম জনশূণ্য। লোকজন তাঁবু ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তাদের পশুগুলো এখানে-ওখানে বিচরণ করছে। সর্বপ্রথম কুরুদের বোঝাপড়া করতে হবে পুরুদের সঙ্গে। পুরুগণ বিপন্ন হল চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে। উত্তরের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধেও ছিল না। উপত্যকা ক্রমশ:ই সঙ্কীর্ণ হয়েছে আর চড়াইও ছিল খুব কষ্টকর। তবু প্রাণের দায়ে নর-নারী ঘোড়ায় করে পালাচ্ছিল। অবশেষে এমন জায়গায় গিয়ে পৌছাল যে ঘোড়া আর সামনের দিকে চলতে পারে না। লোকজন পায়ে হেঁটে চলতে লাগল। কুরুগণ তাদের খুব কাছে এসে পড়ল। বৃদ্ধ, স্ত্রী ও শিশুরা তাড়াতাড়ি এগুতে পারছিল না, তাই তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবার জন্য কিছু পুরু যোদ্ধা একটি সঙ্কীর্ণ জায়গায় দাঁড়াল। কুরুরা তাদের সমস্ত শক্তি কাজে লাগাতে পারছিল না। এ জন্যই পুরুদের হাত থেকে রাস্তা উন্মুক্ত করতে কয়েক দিন সময় লাগল। পুরু এবং কুরু উভয় দলই পায়ে হেঁটে আসছিল। কিন্তু পুরুদের ভেতর পুরুষের সংখ্যা দশ-বার জনের বেশী ছিল না। একদিন কিছু সাহসী স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে একটি দুরূহ পথ ধরে ওই উপত্যকা ত্যাগ করল এবং পাহাড় পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেল। পুরুদের শিশু, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলোকেরা প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল—কুরুরা শেষ পর্যন্ত তাদের পাকড়াও করল। বন্দী করে রাখা তখনকার পিতৃতান্ত্রিক যুগের আইন-বিরুদ্ধ কাজ ছিল। তাই শিশু থেকে আরম্ভ করে সমস্ত পুরুকুলকে তারা মেরে ফেলল এবং স্ত্রীগণকে সঙ্গে নিয়ে গেল। পুরুদের সমস্ত পশু-ধনও তারা করায়ত্ত করল। এখন সেই হরিৎ নদীর উপত্যকায় নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত কুরুদে চারণভূমি। এক পুরুষ পর্যন্ত মহাপিতর একাধিক পত্নী গ্রহণ করবার বিধান দিলেন এবং এই সময় কুরুদের ভেতর সর্বপ্রথম সপত্নী দেখা গেল।
০৪. পুরুহুত (স্থান : বক্ষু উপত্যকা (তাজিকিস্তান) ।। কাল : ২৫০০খৃষ্টপূর্ব)
বক্ষুর কলকল ধ্বনি মুখরিত ধারা বয়ে চলছে। এর দক্ষিণতটের জলধারা থেকেই পাহাড় শুরু হয়েছে, কিন্তু বামদিকে বেশী ঢালু হওয়ার দরুণ উপত্যকা প্রশস্ত বলে মনে হচ্ছে। দূর থেকে দেখলে গাঢ়-সবুজ উত্তুঙ্গ পাইন-বৃক্ষরজির কালো ছায়া ব্যতীত আর কিছুই দেখা না। কিন্তু কাছে এলে দেখা যায় এদের সুচাগ্র পত্রবিশিষ্ট শাখাসমূহ, নীচ থেকে ক্রমশ ছোট হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। পাইন বৃক্ষশ্রেণীর নীচে অন্যান্য রকমারি বনস্পতি বিরাজ করছে। গ্রীষ্মের শেষ কিন্তু বর্ষা এখনও শুরু হয়নি।
বক্ষুর বাম-তট ধরে হেঁটে চলছিল একটি তরুণ, পরণে তার পশমের এক গাত্রাবরণ—তার ওপর কয়েক ভাঁজে জড়ানো কোমরবন্ধনী। নীচে পশমের পাজামা এবং বহুবিমুনী যুক্ত চপ্পল। মাথা থেকে টুপীটা খুলে পিঠের উপরকার ঝুড়িতে রাখল, দীর্ঘ উজ্জল পিঙ্গল কেশরাশি তার পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ে হাল্কা হাওয়ায় ফুরফুর করে উড়তে লাগল।তরুণের কোমরে চামড়ার খাপে মোড়া তামার তরবারি। পিঠের ওপর বৃক্ষ-শাখা নির্মিত ঝুড়ি, তার ভিতর অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে খোলা ধনুক এবং বাণপূর্ণ তুণীর রেখে দিয়েছিল। তরুণের হাতে একটি দণ্ড, সেটাকে ঝুড়ির নীচে ঠেকিয়ে দাঁড়ানো অবস্থাতেই মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছিল। অধিকতর চড়াই আরম্ভ হয়েছে এখন। তার সামনে ছাড় মোটা মোটা ভেড়া চলছিল, এদের পিঠের উপর ঘোড়ার লোমের তৈরী ছাতুভরা বড় বড় থলি। তরুণের পেছন পেছন আসছিল এক লাল রঙ-এর লোমশ কুকুর। বিহগকুলের মধুর স্বরে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিল পর্বত; তরুণের ওপর তার প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছিল এবং শিস দিতে আরম্ভ করছিল সে। একটি খাড়াই-এর ওপর থেকে এক সূক্ষ্ম রুপালী ঝর্ণার ধারা ঝরছিল। খাড়াই-এর প্রান্তদেশ কেটে কে নযন কাঠের নালা তৈরী করে রেখেছিল। শ্রান্ত ভেড়ার পাল জল খেতে আসল। তরুণ দেখল কাছেই আঙ্গুর লতায় আঙ্গুরের গুচ্ছ। ঝুড়ি নামিয়ে আঙ্গুর ছিঁড়ে খেতে লাগল—কাঁচা আঙ্গুর ফলে টক একটু বেশী। পাকতে এখনও মাসখানেক দেরী, তবু তরুণ পথিকের কাছে এই-ই ভালো লাগছিল। সম্ভবত সে অত্যন্ত পিপাসার্ত ছিল এবং তাড়াতাড়ি এসেই শীতল জল পান করা ক্ষতিকর মনে করে কিছু্টা অপেক্ষা করছিল।