‘‘বাবা, আমি তাকে ভালোবাসি!’’
মধুরার পিতা বাইরে এসে অমৃতাশ্বকে অর্ভ্যথনা করে তাকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেল।গ্রামবাসীরা সব কথা শুনে আশ্চর্য বোধ করল। সকলের সম্মান ও সহানুভুতির মধ্যে অমৃতাশ্ব মধুরাকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিল।
৩
অমৃতাশ্ব তখন নিজ কুরু-গ্রামের মহাপিতর। তার পঞ্চাশশাধিক অশ্ব, গরু ও অনেকগুলি ছাগল আর ভেড়া ছিল। তার চার ছেলে ও মধুরা পশুপালন এবং গৃহকাজ করত। গ্রামের দরিদ্রশ্রেণীর কিছু লোকও তার ওখানে কাজ করত। তবে ভৃত্যের মতো নয়, আপন লোকের মতোই। একজন কুরুকে আর একজন কুরুর সমতা স্বীকার করতে হত। অমৃতাশ্ব যে সব গ্রামে চলাফেরা করত সে সব গ্রামে পঞ্চাশটির অধিক পরিবার বাস করত। তাকে তাদের ঝগড়ার আপোষ এবং মামলার বিচার করতে হত। যুদ্ধ—যা প্রায়ই ঘটত তাতে মহাপিতরকে সৈন্যদলের প্রধানের কাজ করতে হত। বস্তুত, যুদ্ধে সফলতা লাভ করলেই সে সময় মানুষ মহাপিতরের পদ লাভ করত। অমৃতাশ্ব বড় যোদ্ধা ছিল। পক্থ, বাহলীক ও অন্যান্য জনের সঙ্গে যুদ্ধে সে নিজের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। মধুরাকে সে যে কথা দিয়েছিল তা পালন করেছিল। মধুরা অমৃতাশ্বের সঙ্গে শুয়োর, বাঘ শিকারই শুধু করত না, যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করত। যদিও কেউ কেউ এ সব পছন্দ করত না—তারা বলত স্ত্রীলোকের কাজ হল ঘরে।
অমৃতাশ্বকে প্রথম যেদিন মহাপিতর নির্বাচন করা হয় সেদিন কুরু-পুরে মহোৎসব পালন করা হল। সেদিন তরুণ-তরুণীরা অস্থায়ী প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ হল। গ্রীষ্মের দিনে নদীর উপত্যাকার এবং পাহাড়ের ওপরে গরু, ঘোড়ার পাল মনের সুখে বিচরণ করছিল।গ্রামবাসীরা ভুলেই গেল যে তাদেরও শত্রু আছে। পশু-ধন হতেই তাদের শত্রু সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কুরুজন ভোল্গার তীরে যে যুগে বাস করত, তখন তাদের নিকট পশু ধন ছিল না। তাদের জঙ্গল থেকে আহার্য সংগ্রহ করতে হত। শিকার, মধু কিংবা ফল না পেলে তারা অনাহারে থাকত। আর এখন! কুরুগণ আহারের জন্য কিছু পশু, গরু, ঘোড়া, ছাগল, গাধা ইত্যাদি স্থায়ীভাবে রাখে। তাদের শুধু মাংস, দুধ, চামড়াই নয় এই পশুগুলো পশমের বস্ত্র পর্যন্ত সরবরাহ করে। কুরু স্ত্রীগণ সুতো কাটতে আর কম্বল বুনতে কুশলী! তাদের কুশলতা সমাজে বেশীদিন পূর্বসম্মান অধিকার করে থাকতে পারল না। এখন স্ত্রীর নয় পুরুষের রাজ্য। পুরুষ শাসিত সমাজে সম্পদের অধিকার, সামাজিক ব্যবস্থা অনেক বদলে গেল। স্ত্রীর রাজ্যে যেখানে একাধিক পরিবার একত্রে বাস করত, একসঙ্গে কাজ করত, সেখানে আজকের ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের, ভিন্ন ভিন্ন পশু-সম্পদ এবং ভিন্ন ভিন্ন লাভ লোকসান। হ্যাঁ, সকলের বিপদের সময় ‘জন’ আবার পুরনো ‘জন’-এ রুপ নিত।
অমৃতাশ্ব মহাপিতর নির্বাচিত হল। মহাপিতরের মহোৎসবে মত্ত ‘জন’-এর লোকেরা নিজেদের পশু-ধনের প্রতি কোনো নজর রাখল না। বাদ্যের শব্দে নৃত্যপর তরুণরা কেবল সোম-সুরা এবং সুন্দরী তরুণীদের কথাই মনে করতে পারত। এক প্রহর রাত আর বাকি কিন্তু নৃত্যগীত তখনও বন্ধ হওয়ার কোনো উপক্রম নেই। ঠিক সেই সময় চারদিক থেকে কুকুরগুলিকে জোরে চীৎকার করতে করতে উপত্যকার ওপরের দিকে ছুটতে দেখা গেল। অমৃতাশ্ব পরিমিত সোম পান করত, আর তাতেই আনন্দ পেত। চোখে লাল রঙ ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে বেহুঁস হয়ে পড়ে না। কুকুরগুলির ডাক শুনে সে উঠে দাঁড়াল। কাঠের হাতলযুক্ত নিজের পাষাণ মুদগর বাগিয়ে নিল এবং নদীর যেদিক হতে শব্দ আসছিল সেদিক চলতে শুরু করল। সামান্য অগ্রসর হওয়ার পর অস্তগামী চাঁদের আলোতে একটি স্ত্রীলোককে আসতে দেখা গেল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। মূর্তি, নিকটবর্তী হলে দেখা গেল—সে মধুরা। মধুরা তখনও ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছিল, সে উত্তেজিত স্বরে বলল,‘‘পুরুরা আমাদের পশুগুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে!’’
‘‘তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে? আর আমাদের ছেলেরা নেশায় চুর! তুমি কতদূর ওদের পেছনে পেছনে গিয়েছিলে, মধুরা?’’
‘‘একেবারে কাছে নয়—যতদূর থেকে দেখা যায় সেই পর্যন্ত।
‘‘আমাদের সমস্ত পশু নিয়ে যাচ্ছে?’’
‘‘ওদের দেখে মনে হল—চারিদিকে ছড়ানো পশুদের একত্র করে নিয়ে যাচ্ছে।’’
‘‘তুমি কি মনে করছ, মধুরা?’’
‘‘দেরী করবার আর সময় নেই।’’
‘‘কিন্তু আমাদের সব ছেলরা নেশায় মত্ত!’’
‘‘যারা চলতে সক্ষম তাদের নিয়ে এখনই আক্রমণ করা চাই।’’
‘‘হ্যাঁ, ঠিক কথা; কিন্তু, মধুরা, আমার সঙ্গে তোমার যাওয়া উচিৎ নয়। এই খবরেই অর্ধেক লোকের নেশা কেটে যাবে এবং বাকি লোকদের দই খাওয়াতে হবে। যখনই যার নেশা কেটে যাবে তখনই তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো চাই।’’
‘‘আর কুরু মেয়েরা?’’
‘‘আমি কুরুদের মহাপিতর হিসাবে এই আদেশ দিচ্ছি, তারাও যুদ্ধক্ষেত্রে যাক! সেই প্র্রাচীন প্রথাকে আবার আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে।’’
‘‘আমি আগে যাবার চেষ্টা করব না; তবে তাড়াতাড়িই কাজ সারতে হবে।’’
মহাপিতরের আদেশে বাজনা একদম বন্ধ হল। নর-নারী মহাপিতরের চারিদিকে জড়ো হল। সত্যি-সত্যিই গো-অশ্ব চুরির কথা শুনে তাদের মধ্যে অনেকের নেশা কেটে গেল। তাদের চেহারায় প্রণযের কোমলভাব কেটে গিয়ে বীরভাব প্রকাশ পেল, মহাপিতর মেঘগম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘‘কুরু নর-নারীগণ! পুরু শত্রুর কাছ থেকে আমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিতে হবে। তোমাদের মধ্যে যাদের চেতনা আছে, নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হও এবং আমাকে অনুসরণ কর, যারা নেশায় এখনও নিঝুম হয়ে আছ তারা মধুরার কাছ থেকে দই নিয়ে খাও আর নেশা কাটার সঙ্গে সঙ্গে চলে এস। কুরুনারীগণ! আজ তোমাদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে নির্দেশ দিচ্ছি। প্রাচীন কালের কুরু রমনীগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত—এ কথা আমরা বৃদ্ধদের কাছে শুনেছি। আজ তোমাদের মহাপিতর অমৃতাশ্ব তোমাদের এই আদেশ দিচ্ছে।’’