‘‘সমস্তই লুট করে তো?’’
‘‘না, তাদের ভেতর অধিকসংখ্যক মাতুল কন্যা ছিল।’’
‘‘তা‘হলেও মেয়েদের লুট-পাট করা আমার খুব খারাপ লাগে।’’
‘‘আর আমিও এটা খারাপ মনে করি, মধুরা! বিশেষ করে যেখানে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে প্রেমের সম্ভাবনা আছে কি-না—আমার জানা নেই।’’
‘‘মাতুল কন্যা বিয়ে করা এর চেয়ে ভালো। কেন না তা‘হলে প্রথম হতেই পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে।
‘‘তোমার এ রকম কোন প্রেমিক ছিল না-কি, মধুরা?’’
‘‘না, আমার কোন পিসীমা নেই।’’
‘‘অন্য কোন লোক?’’
‘‘স্থায়ীভাবে নয়।’’
‘‘তুমি কি আমাকে ভাগ্যবান করতে পার?’’
মধুরার সলজ্জ দৃষ্টি নত হয়ে গেল। অমৃতাশ্ব বলল, ‘‘মধুরা! এ রকম জনপদও আছে যেখানে স্ত্রী অন্যের নয়, নিজের।’’
‘‘তোমার কথা বুঝলাম না, অমৃতাশ্ব!’’
‘‘স্ত্রীলোককে কেউ লুট করে না কিম্বা স্থায়ী পত্মী করে রাখতে পারে না, সেখানে স্ত্রী পুরুষ সবাই সমান।’’
‘‘পুরুষের মতো মেয়েরাও সমানে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে?’’
‘‘হ্যাঁ, স্ত্রীর সে স্বাধীনতা আছে।’’
‘‘কোথায় সে ‘জনপদ’ অমৃতাশ্ব—অঃঅমৃতাশ্ব!’’
‘‘তুমি আমায় অমৃত বল মধুরা! সে ‘জনপদ’ পশ্চিমে, এখান থেকে অনেক দূরে!’’
‘‘অমৃত, তুমি কি সেখানে গিয়েছ?’’
‘‘হ্যাঁ, সেখানে নারী আজীবন স্বাধীনভাবে থাকে, যে রকম জঙ্গলে মৃগ স্বতন্ত্র বিচরণ করে, পাখি গাছে গাছে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়।’’
‘‘নিশ্চয়ই খুব সুন্দর‘জনপদ’? সেখানে কেউ মেয়েদের লুট করে না তো?’’
‘‘স্বাধীন! বাঘিনীকে জীবন্ত কে লুট করতে পারে?’’
‘‘আর পুরুষ, অমৃত?’’
‘‘পুরুষ ও স্বাধীন।’’
‘‘ছেলে মেয়েরা?’’
‘‘মধুরা সেখানকার সংসার অন্য রকমের—সমস্ত গ্রাম নিয়ে একটি পরিবার।’’
‘‘সেখানে পিতার কর্তব্য কি?’’
‘‘পিতা কে তা বলা যায় না। সেখানে নারী পত্মী নয়, স্বচ্ছন্দ তার প্রেম।’’
‘‘তা‘হলে সেখানে কেউ পিতাকে জানে না?’’
‘‘ঘরের সমস্ত পুরুষই পিতা।’’
‘‘এ কেমন প্রথা?’’
‘‘এ জন্যই সেখানে নারী স্বতন্ত্র, তারা যোদ্ধা, শিকারী!’’
‘‘আর গরু-ঘোড়া পালনের কি ব্যবস্থা?’’
‘‘গরু-ঘোড়া জঙ্গলে থাকে, যেভাবে এখানে থাকে হরিণ।’’
‘‘আর ছাগল, ভেড়া?’’
‘‘সেখানকার মানুষ পশুপালন জানে না। শিকার,মাছ এবং জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে দিন কাটায়।’’
‘‘শুধু শিকার! তাহলে কি তাদের দুধ জোটে না?’’
‘‘জোটে শুধু মানুষের দুধ, তাও আবার শৈশবেই।’’
‘‘ঘোড়ায় চড়ে না?’’
‘‘না। আর চামড়া ছাড়া তারা অন্য কিছু পরিধেয়ও জানে না।’’
‘‘তারা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পায়?’’
‘‘তা‘হলেও সেখানকার স্ত্রীলোকেরা স্বাধীন। পুরুষের মতোই তারা ফল সংগ্রহ করে, শিকার কলে, যুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে।’’
‘‘আমিও এ জিনিষ পছন্দ করি। আমি অস্ত্র চালাতে শিখেছি কিন্তু পুরুষের মতো যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?’’
‘‘পুরুষরা এ কাজ নিজ হস্তে গ্রহণ করেছে। গরু,ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া তারা পালন করে; তারা স্ত্রীকে পশু-পত্মী নয়, গৃহপত্মী করেছে।’’
‘‘আর মেয়েদের লুট্ করার উপযুক্ত করে তৈরী করেছে। সেখানে মেয়েদের লুট করা হয় নাত তো, অমৃত!’’
‘‘একটি ‘জন’-এর ছেলেমেয়েরা সর্বদাই সেই জনের ভেতর থাকে। ‘জন’-এর বাইরে যেতে দেওয়া হয় না, গ্রহণ করাও হয় না।’’
‘‘এ কি রকম প্রথা?’’
‘‘সে সব এখানে চলতে পারে না।’’
‘‘তাই বলে মেয়ে লুট চলতে থাকবে?’’
‘‘হ্যাঁ, মধুরা! আচ্ছা, তখন তুমি কি বলছিলে যেন?’’
‘‘কোন বিষয়?’’
‘‘আমার প্রেম সম্বন্ধে।’’
‘‘আমি তোমার বশীভূত, অমৃত!’’
‘‘কিন্তু আমি তোমাকে লুট করে নিয়ে যেতে চাই না।’’
‘‘তুমি কি আমাকে যুদ্ধ করতে দেবে?’’
‘‘যতদূর পর্যন্ত আমার পক্ষে সম্ভব।’’
‘‘আর শিকার করতে?’’
‘‘যতদূর আমার ক্ষমতা আছে।’’
‘‘ব্যাস এটু্কুই…?’’
‘‘কেন না আমাকে মহাপিতরের আদেশ পালন করতে হবে। নিজের দিক থেকে যদি বল মধুরা—আমি তোমাকে স্বাধীন মনে করব।’’
‘‘প্রেম করা না করার জন্যও?’’
‘‘প্রেম আমাদের সম্বন্ধ স্থাপন করছে। আচ্ছা তার জন্যেও।’’
‘‘তবে অমৃত, আমি তোমার প্রেম গ্রহণ করছি।’’
‘‘তা‘হলে আমরা কুরু‘জনে’ চলে যাব না-কি পক্থ ‘জনে’?’’
‘যেখানে তোমার খুশি।’’
অমৃত ঘোড়া ফিরিয়ে মধুরার নির্দেশিত পথে পক্থ গ্রামে পৌছাল। গ্রামে কোনো তাঁবুতে কেউবা মারা গিয়েছে;কেউ জখম হয়েছে, কারুর কন্যা লুণ্ঠিত হয়েছে। চারিদিকে হল্লা হচ্ছিল।
মধুরার মা কাঁদছিল এবং বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। এ সময় অমৃতাশ্বর ঘোড়া গিয়ে গিয়ে তাদের তাঁবুর বাইরে দাঁড়াল।
অমৃতাশ্ব নীচে নামার পর মধুরা লাফিয়ে পড়ল এবং অমৃতাশ্বকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেল। হঠাৎ একাকী কন্যাকে দেখে বাপ মা প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারল না। মা তাকে জড়িয়ে ধরল তার চোখের জলে মেয়ের মুখ ভেসে যেতে লাগল। মা শান্ত হলে, বাবার প্রশ্নের উত্তরে মধুরা বলল, ‘‘বাহলীকরা পক্থ কন্যাদের লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে লুট করে যে নিয়ে যাচ্ছিল সে একটু পিছিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে আমি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ি। ঠিক সে সময় একটি তরুণ অশ্বারোহী এসে উপস্থিত হল, সে বাহলীককে যুদ্ধে আহবান করে জখম করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই কুরু তরুণ আমাকে এখানে পৌছিয়ে দিতে এনেছে।’’
পিতা বলল, ‘‘সেই কুরু তরুণ তোমাকে নিয়ে যেতে চাইল না?’’
‘‘বলপূর্বক নয়।’’
‘‘কিন্তু আমাদের জনপদের নিয়ম অনুসারে তুমি তার।’’