‘‘না সোমা, এই নরম ঘাস বিছানার চেয়েও ভালো।’’—ঋজ্রাশ্ব বলল।
‘‘আচ্ছা, বল তো ঋদ্র! লবণ দিয়ে সেদ্ধ-করা মাংস খাবে, না পোড়া-মাংস খাবে? আট মাসের বাছুরের মাংস খুবই নরম।’’
‘‘আমি তো বাছুরের পোড়ানো মাংসই পছন্দ করি। আমি কখনও কখনও গোটা বাছুর আগুনে পোড়াই। পোড়াতে দেরি হলেও কিন্তু মাংস খুব সুস্বাদু হয়। তোমাকে কিন্তু সোমা! ঠোঁটের স্পর্শে আমার চষক মিষ্টি করে দিতে হবে।’’
‘‘হ্যাঁ—হ্যাঁ সোমা! ঋজ্র দীর্ঘ দিন পরে এসেছে।’’—কৃচ্ছ্রাশ্ব বলল।
‘‘আমি এখুনি আসছি, জোর আগুন আছে, মাংস পোড়াতে দেরি হবে না।’’
কৃচ্ছ্রাশ্বকে চষকের পর চষক নিঃশেষ করতে দেখে ঋজ্রাশ্ব বলল, ‘‘এত তাড়া কিসের?’’
‘‘সিদ্ধি হচ্ছে অপূর্ব! সোমার হাতে তৈরী সিদ্ধি খাওয়া অপূর্ব!যেন অমৃত। এ সিদ্ধি লোককে অমর করে। সিদ্ধি পার কর এবং অমর হও।’’
‘‘তুমি কি অমর হতে চাও? যে রকম চষকের পর চষক নিঃশেষ করে চলেছ, তাতে অচিরেই মৃত্যুর পর অমরত্ব লাভ করবে।’’
‘‘কিন্তু তুমি তো জান ঋজ্র, সিদ্ধি আমি কত ভালোবাসি!’’
এই সময় সোমা চামড়ায় করে পোড়ানো তিন টুকরা মাংস নিয়ে এসে বলল, ‘‘কৃচ্ছ্র! সোমাকে কি তুমি ভালোবাসো না!’’
কৃচ্ছ্র স্বর পরিবর্তন করে বলল, ‘‘সোমা ও সোম দুটিকেই আমি ভালোবাসি।’’ তার চোখ লাল হয়ে উঠছিল। সে বলল, ‘‘সোমা, আজ তোমার কিসের চিন্তা?’’
‘‘হ্যাঁ, আজকে তো আমি ঋদ্রের।’’
‘‘অতিথি না পুরানো বন্ধু?’’—কৃচ্ছ্র হাসতে চেষ্টা করে বলল।
ঋজ্রাশ্ব সোমার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে সোমপূর্ণ চষক তার মুখের কাছে ধরল। সোমা দু‘ঢোক পান করে বলল, ‘‘এখন তুমি খাও ঋদ্র! অনেক দিন পরে আজ আবার সুদিন ফিরেছে।’’
ঋজ্রাশ্ব পুরো চষকটি এক নিঃশ্বাসে পার করে পা্ত্রটি মাটিতে রেখে বলল, ‘‘তোমার ঠোটের স্পর্শে সোম না জানি কতই মিষ্টি হয়।’’
কৃচ্ছ্রাশ্বের ভেতর সোমের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি নিজের চষকটি ভর্তি করে নিয়ে সেই পেয়ালা সোমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘‘তা‘হলে সোমা, এটাও মধুর বানিয়ে দাও!’’
সোমা ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে চষক ফিরিয়ে দিল। অমৃতাশ্ব বৃদ্ধদের প্রেমালাপে রস পেল না, তাই বয়স্ক বালক বালিকাদের সঙ্গে খেলতে চলে গেল। কৃচ্ছ্রাশ্বের মাথা ঝুঁকে পড়ছিল, সে ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, ‘‘সোমা আমি গান গাই…’’
‘‘হ্যাঁ, তোমার মতো গায়ক কুরুদের মধ্যে আর কেউ কি আছে?’’
‘‘ঠি-ই-ক ব-লে-এ-ছ, আ-মা-র জু-উ-ড়ি-ই-নে-ই। বেশ তা—তা হোলে…’’
‘‘থাক, কৃচ্ছ্র! দেখছ না তোমার গান শুনে সমস্ত পশু-পক্ষী জঙ্গল ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’’
‘‘হু-হু-ম-ম’’
এটা সোম খাওয়ার সময় নয়। সাধারণত তার সময় সুর্যাস্তের পরে; কিন্তু কৃচ্ছ্রাশ্বের তো কোনো একটি বাহানার দরকার নেই। সে বেহুঁশ হয়ে পড়ায় সোমা ও ঋজ্রাশ্ব চষক রেখে দিল এবং দু‘জনে নদীর ধারে একটি টিলার ওপর গিয়ে বসল। পাহাড়ের মধ্যে যেখানটা কিছুটা সমতল সেখান থেকে নদী প্রবাহিত হচ্ছিল। নদী ছিল ছোট-বড় উপখণ্ডে ভরা। তার ওপর জলের আঘাত লাগায় শব্দ হচ্ছিল। পাথরের আড়ালে মাছগুলিকে চলতে ফিরতে দেখা যাচ্ছিল। পাখীর সুমিষ্ট সঙ্গীত আর ফুলের সুগন্ধি মৃদৃমন্দ বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছিল। অনেকদিন পরে তারা দু‘জনে এই স্বর্গীয় ভূমিতে অতীত দিনের প্রেমালাপের পুনরাবৃত্তি করছিল। তাদের মনে পড়ছিল সে-দিনগুলির কথা, যখন কিনা সোমা ছিল ষোড়শী পিঙ্গলা-কেশী। বসন্ত উৎসবের সময় ঋজ্রাশ্বও ছিল তার প্রেমিকদের একজন। তখন সোমার প্রণয়াভিলাষীদের ভেতর বেশ প্রতিযোগীতা ছিল। কিন্তু জয়মাল্য জুটল কৃচ্ছ্রাশ্বের অদৃষ্টে। অন্যান্য সকলের মতো ঋশ্বকেও পরাজয় স্বীকার করে নিতে হল। আজ সোমা কৃচ্ছ্রাশ্রের স্ত্রী কিন্তু সেই প্রাণপূর্ণ যুগে স্ত্রীলোক পুরুষের একচেটে জঙ্গম সম্পত্তি হতে স্বীকার করেনি, এর জন্য অস্থায়ী প্রেমিক গ্রহণ করার অধিকার ছিল। অতিথি এবং বন্ধুর নিকট নিজের স্ত্রীকে সেবা করতে পাঠানো তখন সর্বমান্য সদাচার বলে গণ্য হত। তাই আজ সোমা ঋজ্রের।
সন্ধ্যায় গ্রামের নরনারী মহাপিতরের বিস্তৃত আঙ্গিনায় জড়ো হল। সোমা মধু সুরা এবং সুস্বাদু গো-অশ্ব মাংস নিয়ে যাচ্ছিল। মহাপিতরের পুত্রের আজ জন্ম উৎসব। কৃচ্ছ্র নিজে বেসামাল অবস্থায় ছিল তাই তার বদলে সোমা এবং ঋশ্ব উপস্থিত ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত গান, গীত, নৃত্য করে মহোৎসব হল। সোমার গান এবং ঋশ্বের নৃত্য কুরু-জন সর্বদাই ভালোবাসত।
২
‘‘মধুরা! তুমি ক্লান্ত হওনি তো?ৎৎ
‘‘না, আমি ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসি।’’
‘‘কিন্তু সেই দস্যুরা তোমাকে কি খারাপভাবে আটক করেছিল?’’
‘‘হ্যাঁ, বাহলীকরা পক্থদের শুধু গরু এবং ঘোড়াই নয় পরন্তু তারা মেয়েদেরও লুট করতে এসেছিল।’’
‘‘হ্যাঁ, পশু-লুণ্ঠন দুটি‘জন’- এর মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতার সৃষ্টি করে। কিন্তু কন্যা লুট করলে শত্রুতা ক্ষণস্থায়ী হয়, কারণ শেষ পর্যন্ত শ্বশুড়কে জামাতার সমাদর করতেই হয়।’’
‘‘কিন্তু তোমার নাম আমার মনে নেই।’’
‘‘অমৃতাশ্ব; কৃ্চ্ছ্রাশ্ব-পুত্র, কৌরব।’’
‘‘কৌরব! কুরু আমার মামার কুল।’’
‘‘মধুরা এখন তুমি নিরাপদ। বল—কোথায় যাবে?’’
মধুরার মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠে অচিরেই বিলীন হয়ে গেল দেখে অমৃতাশ্ব কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, ‘‘অতীতে পক্থদের কন্যারা আমাদের গাঁয়েও এসেছে।’’