শাওনের কাছ থেকে খবরটা পেয়ে খুব মন খারাপ হলো। ছবির খরচের পুরোটাই হচ্ছে চ্যানেল আই-এর হাতে। সেখানে খবরদারির কিছু নেই। তাহলে হাসানের কথার অর্থ কি এই যে, আমার কারণে অতিরিক্ত খরচের ব্যাপারটা ঘটছে।
দারুচিনি দ্বীপে শুটিং-এর জন্যে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমি হেলিকপ্টার ব্যবহার করি নি, চারটা গরুর গাড়ি গাজীপুর থেকে সিলেট নিয়ে গিয়েছি। কারণ সিলেটে গরুর গাড়ি নেই।
হোটেল শেরাটনে ছবির মহরত অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ল। সেই অনুষ্ঠানে ইউনিলিভারের কর্মকর্তা স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ভালো ছবির নির্মাণে সব রকম আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। এটা কি কথার কথা?
সাধারণ একটি বিজ্ঞাপন তৈরির বাজেটে কি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হয়?
চ্যানেল আই প্রতিবছর বেশ কিছু ছবি বানাচ্ছে। ছবির বাজেট হাস্যকর। পরিচালকরা চুক্তিভিত্তিক। মহানন্দে সেই বাজেটেই ছবি বানিয়ে দিচ্ছেন। এর থেকেই হয়তোবা চ্যানেল আই-এর ধারণা হয়েছে–এই বাজেটেই ছবি হয়।
অনেক আগে বানানো শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে আমি খরচ করেছিলাম প্রায় এক কোটি টাকা (সে ছবিতে অবশ্যি আরো কিছু সমস্যা ছিল)।
চন্দ্রকথা ছবিতে ৭৬ থেকে ৮০ লক্ষ টাকার মতো খরচ হয়েছে। অনেক টাকা চলে গেছে সেট বানানোতে।
সব কিছুর দাম হুহু করে বাড়ছে, সেখানে কী করে চ্যানেল আই-এর বাজেটে ছবি হবে?
আমি কোনো পরামর্শদাতা না। তারপরেও গায়ে পড়ে ছোট্ট পরামর্শ দিচ্ছি। একজন লাক্স সুন্দরীর পুরস্কার ছবির নায়িকা হওয়া। ব্যাপারটা হাস্যকর। নায়িকা হওয়া অর্জনের বিষয়, পুরস্কারের বিষয় না। তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত নির্বাচিত লাক্স সুন্দরী নাটক করবে, টেলিফিল্ম করবে। এদের ভেতর থেকে অভিনয়ে নিপুণ একজনকে নিয়ে প্রতি চার বছর পর ভালো বাজেটে একটা ছবি হবে।
বুঝতে পারছি আমি কোনো কাজের সাজেশন দিচ্ছি না। বর্তমান পৃথিবীর চালিকাশক্তি অর্থ। আমার আছে জল-এর বাইরে পড়ে না। ছবির অর্থের ব্যাপারটা ফয়সালা করবেন ইউনিলিভার, এশিয়াটিক এবং চ্যানেল আই। তারা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক বিষয়টি বেছে নেবেন। ছবি কী হবে না হবে তা অনেক পরের ব্যাপার।
তবে আমার শিক্ষা সফর সম্পন্ন।
.
কুশপুত্তলিকা দাহ বিষয়ক জটিলতা
বহুব্রীহি নামের একটা কমেডি ধাঁচের নাটক একবার বানিয়েছিলাম। সেই নাটকে একজন বোকা ডাক্তার ছিলেন। নাটক দেখে ডাক্তাররা এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা দারুণ ক্ষেপল। হয়তো তাদের ধারণা বাংলাদেশে কোনো বোকা ডাক্তার নেই। ডাক্তারদের এসোসিয়েশন (বিএমএ বা এই ধরনের কিছু) থেকে সিদ্ধান্ত হলো (!) যে, হুমায়ুন আহমেদ এবং তার পরিবারের কাউকে ডাক্তাররা চিকিৎসা সেবা দেবেন না! এই সময় আমার ছোট মেয়ে বিপাশার প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা। সে কাদঁতে কাঁদতে বলল, বাবা ডাক্তাররা তো আমার ব্যথা কমাবে না। এখন আমি কী করব?
আমি মেয়েকে কোলে নিয়ে গেলাম ডাক্তার রতনের কাছে (রতন ডেন্টাল ক্লিনিকের ডাক্তার রতন। তখন তিনি বোধহয় বিকল্প ডেন্টাল ক্লিনিকে ছিলেন, ঠিক মনে পড়ছে না) ডাক্তার রতনকে বললাম, আমার মেয়েটার প্রচণ্ড দাঁতে ব্যথা। আপনি কি তার চিকিৎসা করবেন না-কি তাকে নিয়ে দেশের বাইরে যেতে হবে?
ডাক্তার রতন বললেন, মা আসো আমার কোলে আসো। আগে কোলে নিয়ে আদর করি তারপর চিকিৎসা।
তখনকার সেই অদ্ভুত সময়ে চারদিকে আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হতে লাগল এবং আমার লেখা বইয়ে অগ্নিসংযোগ হতে লাগল। আমি খুবই মজা পেলাম।
বহুব্রীহির আগে এইসব দিনরাত্রি নাটকে টুনিকে মেরে ফেলার জন্যে আমার জেলা ময়মনসিংহ শহরেও কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল।
কুশপুত্তলিকা দাহের ব্যাপারটা সে কারণে আমার মাথার ভেতর ঢুকে আছে।
যখন খবর পেলাম চ্যানেল আই-এর হাসান আসছে সিলেটে আমার সঙ্গে দেখা করতে, তখন ভাবলাম মজা করা যাক–চ্যানেল আই-এর বিরুদ্ধে আমরা স্লোগান দেব এবং হাসানের একটা কুশপুত্তলিকা দাহ করা হবে।
সবাই এই আইডিয়ায় যথেষ্টই মজা পেল। জাহিদ বলল, শহীদ মিনারের সামনে একবার তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছিল। কারণ সে একটা সিগারেট কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিল।
লাউয়াছড়ার গহীন অরণ্যে শুটিং হচ্ছে। হাসান শুটিং দেখতে গেল। শুটিং এর শেষে আমরা যথেষ্ট আনন্দ এবং হাততালির মধ্যে তার কুশপুত্তলিকা দাহ করলাম। হাসান হাসছে এবং হাততালি দিচ্ছে। হাসানের এই আনন্দ যে অভিনয় তখন বুঝতে পারি নি। আমাকে পরে জানানো হয়েছে, তার অধস্তন কর্মচারীদের সামনে তাকে অপমান করা হয়েছে। সে দারুণ আহত।
সমস্যা তার না, সমস্যা আমার। জীবনের হাস্যকর দিকটাই সবসময় আমার চোখে পড়ে। আমি রসিকতা করার চেষ্টা করি। এই রসিকতায় অন্যরা কষ্ট পাবে। এটা চট করে মাথায় আসে না। যখন বুঝতে পারি তখন আর শোধরানোর পথ থাকে না। আমার মনে থাকে না যে রসিকতা বন্ধুদের সঙ্গে করা যায়, কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে করা যায় না। হাসানকে তরুণ বন্ধুই ভেবেছি, তাকে চ্যানেল আই-এর কর্তাব্যক্তি কখনো ভাবি নি। হাসানের কাছে Sorry বলা ছাড়া আর কী বলব? তবে হাসানের মনতুষ্টির জন্যে আমি নিজেই নিজের কুশপুত্তলিকা দাহের ব্যবস্থা করেছি। অনুষ্ঠানটি হবে নুহাশ পল্লীতে। আমার স্টাফদের সামনে। অনুষ্ঠানে আমি ইউনিলিভার, এশিয়াটিক ও চ্যানেল আই-এর কর্তাব্যক্তিদের (!) এবং আমার আছে জল-এর সকল কুশিলবদের নিমন্ত্রণ করলাম। আমার ধারণা অনুষ্ঠানটি যথেষ্ট আনন্দের হবে।