আমি ভালোমতো বুঝলাম। বললাম, এখন থেকে অ্যাকশান বললে, তুমি শুধু মার দিকে তাকিয়ে থাকবে। মা কথা বলবে, তুমি শুনবে।
আচ্ছা।
আমি বললাম, অ্যাকশান! ওয়াফা যথারীতি বলল, মা, দেখো দেখো, Birds!
.
লাক্স সুন্দরী কথা
লাক্স সুন্দরীর নাম মীম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম মেয়েটি মুসলমান। আলিফ লাম মীমের মীম থেকে তার নাম। মেয়ের মা বললেন, (গলা নামিয়ে) স্যার, আপনার মতো অনেকেই মনে করে আমরা মুসলমান। আসলে আমরা হিন্দু। মীমের আসল নাম বিদ্যা সিনহা সাহা। চ্যানেল আই এবং আমরা অনেক কায়দা করে তার আসল নাম গোপন রেখেছি। হিন্দু জানলে তো কেউ তারে ভোট দেবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ স্যার।
তুমি কি সবাইকে এইসব কথা এখন বলে বেড়াচ্ছ?
সবাইকে বলি না স্যার। যারা আপন তাদের বলি।
আমি মীমের মায়ের সরলতায় মুগ্ধ হলাম। মীম তার মার মতো সরল না, তবে জটিলও না। শিশুশিল্পীদের কাছ থেকে অভিনয় আদায়ের যে টেকনিক, আমি তার ক্ষেত্রেও সেই টেকনিক ব্যবহার করলাম। যা করতে বলা হবে অবিকল তাই করতে হবে। ডানে তাকাতে বললে ডানে তাকাবে। বামে তাকাতে বললে বামে। প্রতিটি step বলে দেওয়া।
কয়েকবার রিহার্সেল করা হলো। সে ঠিকমতো পারল। যখন ক্যামেরা চালু করা হলো তখন আর পারল না। আমি বললাম, আবার যদি ভুল কর আছাড় দিয়ে ট্রেন লাইনে ফেলে দেব। শুরু হলো কান্নাকাটি। আমি বললাম, চোখ মুছে শট দেবার জন্যে তৈরি হও।
মীমের কো-আর্টিস্ট জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় এই পর্যায়ে এগিয়ে এলেন। তিনি আমাকে বললেন, হুমায়ুন! মেয়েটা কান্নাকাটি করছে। তাকে আধঘণ্টা সময় দিন। সে নিজেকে Compose করুক।
আমি বললাম, না। আজ তাকে সময় দেওয়া হলে প্রতি শটেই সময় দিতে হবে। আজ যদি সে বের হয়ে আসে পরে আর সমস্যা হবে না।
আমি শট নিলাম। মীম উতরে গেল। তাকে নিয়েই আমার সব টেনশন। অভিনয়ের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ছবির এত বড় এবং এত জটিল চরিত্রে কাজ করা কঠিন বিষয়। দিনের শেষে আমি বলব, ছবি দেখে কেউ বলতে পারবে না এটা মেয়েটার প্রথম কাজ।
মেয়েটার বেশ কিছু প্লাসপয়েন্ট আছে—
১. সে ক্যামেরা ফ্রি।
২. সে ধৰ্মক ফ্রি। (ধমক খেয়ে কাজ করতে পারে)
৩. সে ভালো অনুকরণ করতে পারে।
তবে, তাকে প্রতিটি অংশ ধরিয়ে না দিলে সে কাজ করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। আমার আছে জল ছবিতে অভিনয় করার অভিজ্ঞতাটা সে কাজে লাগাতে পারে কি না তাও দেখার বিষয় আছে। যদি কাজে লাগাতে পারে তাহলে তার ভবিষ্যৎ ভালো।
তাকে ক্ষতি করেছে লাক্স সুন্দরী গ্রুমিং সেশন নামক কর্মকাণ্ড। তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে–জীবনের সার কথা একটাই, নিজেকে সুন্দর দেখানো। সাজগোজেই সব।
মেকাপম্যান মেকাপ দিয়েছে সে চলে গেছে নিজের ঘরে। বাড়তি কিছু মেকাপ দেওয়া। আরো সুন্দর হবার চেষ্টা। তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছি। একদিন ডেকে বললাম, মীম! আমেরিকায় সবচে বেশি সাজগোজ করে বুড়িরী। ঠোঁটে রং, গালে রঙ, চুলে রঙ। তারপরেই আসে মধ্যবয়স্করা। তোমার মতো বয়েসী মেয়েরা কোনো সাজসজ্জাই করে না। তারা জানে বয়সের সৌন্দর্যেই তারা সুন্দর। তুমি যতই সাজবে ততই তোমাকে কৃত্রিম লাগবে। আমার আছে জল ছবির নায়িকা দিলশাদের মধ্যে কোনো কৃত্রিমত্তা নেই। সে জীবনের জটিলতা নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। সে কিন্তু সাজতো না। বুঝেছ?
বুঝেছি স্যার।
এরপর থেকে মেকাপম্যান যতটুকু মেকাপ দেবে তার বেশি কিছু করবে না। ঠিক আছে?
জি স্যার, ঠিক আছে।
বলেই সে ঘরে ঢুকে গেল। সারা মুখে আরো বাড়তি কিছু রঙচঙ দিতে, চোখ আঁকতে।
.
মিউটিনি অন দ্য বাউন্টি
শুটিং চলছে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহের বীজ দানা বাঁধছে। দুটি দল তৈরি হয়েছে। একদিকে চ্যানেল আই অন্যদিকে গোটা শুটিং দল। শুটিং দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে এফডিসির কামরুল। তার সঙ্গে পরোক্ষভাবে অনেকেই আছে। পরোক্ষ দলের একজন নুহাশ চলচ্চিত্রের জুয়েল রানা।
চ্যানেল আই নেতৃত্ববিহীন। চ্যানেল আই-এর প্রতি কামাল ভেজিটেবল টাইপ চরিত্র। সে কর্মকাণ্ড গোছানো নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। তার সহকারীর (নাম মনে পড়েছে, হীরন) সব কর্মকাণ্ডই অস্পষ্ট। স্টিল চিত্রগ্রাহক নাসির চ্যানেল আই-এর। সে গুপ্তচর গোছের। তার কাজ চ্যানেল আই-এর ঢাকা অফিসকে মোবাইলে খবর সরবরাহ করা (ভুল খবর)।
এক ভোরে কামরুল উপস্থিত। দারুণ উত্তেজিত ভঙ্গিতে জানাল, সে পরিষ্কার বুঝতে পারছে কাজ শেষ হলে চ্যানেল আই কাউকে টাকাপয়সা দেবে না।
আমি বললাম, চ্যানেল আই কোনো ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান না। বিশাল প্রতিষ্ঠান। কমিটমেন্টের টাকা তারা দেবে না এটা কখনো হবে না।
কামরুল নানান উদাহরণ দিতে লাগল। এক পর্যায়ে আমি বললাম, চ্যানেল আই টাকা না দিলে আমি নিজের পকেট থেকে দেব। এখন কি ঠিক আছে?
জি স্যার, ঠিক আছে।
আমি আর কোনো সমস্যার কথা শুনতে চাই না।
স্যার আর শুনবেন না।
এর মধ্যে ইউরোপ থেকে হাসান ঢাকা ফিরেছে। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি। হাসান চলে এসেছে, আর সমস্যা হবে না। দূরে বসেও সব ঠিকঠাক করার জাদুকরী ক্ষমতা এই ছেলের আছে।
হাসান দেশে ফেরায় সমস্যা কমল না, আরো বাড়ল। সে একদিন টেলিফোন করে (যথেষ্ট বিনয় এবং ভদ্রতার সঙ্গেই) বলল, ভাবি, শুটিং-এ এই অল্প কিছু দিনেই প্রচুর টাকা খরচ হয়ে গেছে। সাগর ভাই চিন্তিত। আপনি কি ব্যাপারটা দেখবেন?