ভদ্রলোক ফিরে এসেছেন। সঙ্গে আট ন বছরের দুটি শিশু। তারা আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলবে। আমি বললাম, এখানে চারদিন শুটিং করব। ছবি তোলার অনেক সময় পাবেন। আপাতত পাবলিক কন্ট্রোল করুন। ছবির কাজ যেন ঠিকমতো করতে পারি সেই ব্যবস্থা করেন। ভদ্রলোক বললেন, অয় অয়। এবং অতি ব্যস্ততার সঙ্গে জনগণকে সামলাতে লাগলেন। স্টেশনের ঐতিহ্যবিষয়ক জটিলতার এইখানেই সমাপ্তি।
দুপুর একটার দিকে চ্যানেল আই-এর প্রোডাকশন কন্ট্রোলার এবং তার সহকারী এসে উপস্থিত হলো। প্রোডাকশন কন্ট্রোলারের নাম কামাল, অন্যজনের নাম ভুলে গেছি। অন্যজনের মাথায় টাক। তার চেহারা এবং আচার-আচরণ ধূর্ত প্রকৃতির।
আমি বললাম, তোমরা এত দেরিতে এসেছ?
স্যার, রাতে ঘুম হয় নাই। ঘুমাচ্ছিলাম।
ছবির মতো বড় ব্যাপারের সঙ্গে আগে যুক্ত ছিলে?
কামাল বলল, জি-না স্যার। এটাই আমার প্রথম চাকরি।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। চ্যানেল আই-এর হাসান বলেছিল, স্যার, নিখুঁত ব্যবস্থা থাকবে। সব এক্সপার্ট লোকজন দেওয়া হবে। ক্যামেরা ঠিক হবার পর আপনাকে ডাকা হবে। আপনি শুধু বলবেন, ক্যামেরা। ক্যামেরা চালু হবে। আপনাকে সম্পূর্ণভাবে ঝামেলামুক্ত রাখার দায়িত্ব আমার।
আমি কামালকে বললাম, ছবির অতি জটিল এই কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা তোমাদের নেই। তোমাদেরকে দিয়ে আমার চলবে না। চ্যানেল আই এর একটি মাইক্রোবাস আমি দেখতে পাচ্ছি। এই মুহূর্তেই তোমরা এই মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় চলে যাবে। বাকি কাজ আমি আমার লোকজন দিয়ে করাব।
দুজনই মনে হয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। একসঙ্গে বলল, জি আচ্ছা স্যার। ঢাকায় চলে যাচ্ছি।
বলেই লম্বা লম্বা পা ফেলে উধাও। আমি ভেবেই নিয়েছিলাম তারা চলে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে তাদেরকে আড়ালে আবডালে উঁকি দিতে দেখা গেল। তাদের ডেকে আবার যে ধমকাব সে ইচ্ছা করছে না। কারণ প্রথমদিনেই তিনটা সিকোয়েন্স করেছি। প্রতিটি সিকোয়েন্স চমৎকার হয়েছে। আমার মন প্রফুল্ল। কী আর হবে রাগারাগি করে!
.
প্রথম শট
ছবির প্রথম শট সব পরিচালকের কাছেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছবির কিছু কুসংস্কারের একটি হলো, প্রথম শট এক টেকে Ok হতে হয়। Ok হবার পর বিপুল করতালি, তারপরই যাত্রা শুরু। আমি অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ বলেই প্রথম শটের পর যখন হাততালি হতে থাকে, তখন আমার চোখে পানি আসে। আমি ব্যস্ত খাকি চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টায়।
আমার যেসব ছবিতে শাওন থাকে, তার প্রতিটির প্রথম শট তাকে নিয়ে করেছি। ব্যক্তিগত ভালোবাসা তার একটি কারণ। একই সঙ্গে প্রথম শট সে এক টেকে Ok করবেই এই বিশ্বাস। এই প্রথম আমার আছে জল ছবিতে শাওনকে বাদ দিয়ে প্রথম শটের জন্যে বেছে নিলাম সাড়ে তিন বছর বয়সী শিশুশিল্পী ওয়াফাকে। প্রথম শটে শাওনকে বাদ দিয়েছি বলেই কেউ আবার ভেবে বসবেন না যে আমাদের ঝামেলা শুরু হয়েছে। অনেকদিন মানবজমিন পত্রিকায় আমার কোনো নিউজ যাচ্ছে না। এবার হয়তো যাবে, শাওনের সংসারে আগুন। অসহায় শিশু নিষাদের কাস্টডি কে পাবে?
শাওনকে প্রথম শটে না নেয়ার কারণ তার সঙ্গে শিল্পীর মেকাপ শেষ হয়। নি। অনেক সময় লাগবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করার অর্থ হয় না। কাজেই শিশুশিল্পী শুয়াফা। শটটা এরকম–সোহাগী স্টেশনে সবাই নেমেছে। অপেক্ষা করছে কখন জিপ আসবে। তারা রওনা হবে ডাকবাংলোর দিকে। এই অবস্থায় সবার দৃষ্টি এড়িয়ে নিশাতের কন্যা টুনটুনি (ওয়াফা) নেমে পড়েছে রেললাইনে। হাতে দুধের বোতল। মাঝে মাঝে বোতলে টান দিচ্ছে। মনের আনন্দে রেল লাইন ধরে হাঁটাহাঁটি করছে।
শিশুশিল্পীদের নিয়ে কাজ করতে আমি অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এরা মিমিক করায় ওস্তাদ। অনেকটাই রোবটের মতো। যা বলে দেয়া হবে তাই করবে। এক চুল এদিক-ওদিক হবে না। আমি বললাম, ওয়াফা, অ্যাকশন বলার সঙ্গে সঙ্গে তুমি বোতল হাতে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকবে। রেললাইনের তিনটা স্লিপার পার হবার পর থামবে। এইগুলিকে বলে স্লিপার। এক দুই তিন, এই জায়গায় থামবে। বোতলটা মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ দুধ খাবে। তারপর উল্টোদিকে ফিরে হাঁটা ধরবে। আমি Stop না বলা পর্যন্ত হাঁটতেই থাকবে। পারবে?
পারব।
ভুল হবে না?
না।
একবার করে দেখাও।
সে করে দেখাল। নিখুঁতভাবে করল। তবে একবার ক্যামেরার দিকে তাকাল। ছবির ভাষায় বলা হয় False look. তাকে ভালোমতো বুঝিয়ে দেয়া হলো যেন ক্যামেরার দিকে না তাকায়।
.
ক্যামেরা চালু করে অ্যাকশান বললাম। ওয়াফা কোনোরকম ভুল ছাড়া শট Ok করল। তুমুল করতালি চলছে। আমি Stop বলতে ভুলে গেছি। ওয়াফা হেঁটেই যাচ্ছে। এত হৈচৈ হচ্ছে সে একবারও ফিরে তাকাচ্ছে না।
শিশুশিল্পীদের দিয়ে অভিনয় করানোর কিছু সমস্যাও আছে। একটা উল্লেখ করি। ওয়াফার একটা শট এরকম–গরুর গাড়ি করে তারা যাচ্ছে। সে আছে মায়ের সঙ্গে। হঠাৎ দেখল একদল অতিথি পাখি উড়ে যাচ্ছে। দেখেই সে বলল, মা, দেখো দেখো, Birds! আমি বুঝিয়ে দিলাম, অ্যাকশান বলা মাত্রই তুমি বলবে, মা, দেখো দেখো, Birds!
আচ্ছা।
অ্যাকশান বললাম, সে নিখুঁতভাবে বলল। শট শেষ হয়ে গেল। এরপর শুরু হলো বিপদ। অন্য সিকোয়েন্স হচ্ছে। যতবারই বলছি অ্যাকশান; ওয়াফা বলছে, মা, দেখো দেখো, Birds!