আমি ফেরদৌসের টেলিফোনের বিষয়ে জানি না। একদিন বিস্মিত হয়ে দেখি, একই রকম দুটা চেয়ার পাশাপাশি। ফেরদৌস বিনীত গলায় বলল, স্যার, এটা আপনার জন্যে। গহীন জঙ্গলে পাওয়া এই উপহার কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে অভিভূত করে রাখল। মনে হলো সে আমার অভিনেতা না, আমারই ছেলে। বাবার বসার কষ্ট দেখে দূরদেশ থেকে একটা চেয়ার আনিয়েছে।
.
জাহিদ হাসান
টিভির নায়করা যে চলচ্চিত্রের নায়কদের মতোই বিপদজনক সঙ্গী এই ধারণা জাহিদকে দেখে জন্মেছে। যেখানেই জাহিদ সেখানেই শত শত ভক্ত। কেউ জাহিদ ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে ছবি তুলবে। কেউ অটোগ্রাফ নেবে। রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ জাহিদকে দেখে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বলবে, আরে জাহিদ ভাই। ভালো আছেন? মৌ আপু ভালো?
আমি জাহিদের মতো রসবোধসম্পন্ন মানুষ দ্বিতীয়টি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাৎক্ষণিক Humour-এ তার জুড়ি নেই। তার রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে কতবার যে হো হো করে হেসেছি।
পাঠকরা কি জানেন, সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এবং ছাইপাশ খায় না? ছাইপাশ খাওয়া অভিনেতারা অভিনয়ের অঙ্গ মনে করেন, সেখানে একজন তা খায় না দেখে অবাক হয়েছি।
আমার আছে জল ছবিতে সে খুব ভালো অভিনয় করেছে। একটি অতি জটিল মনস্তাত্ত্বিক চরিত্র চমৎকার ফুটিয়েছে। তার অভিনীত একটি দৃশ্য মনিটরে (আমাদের এই ক্যামেরায় মনিটর আছে) দেখে আমার চোখে পানি এসেছে। আমি মনে মনে বলেছি, জিতে রহ ব্যাটা।
জাহিদের স্ত্রী মৌ এই ছবিতে কাজ না করেও সরব উপস্থিত ছিল। হলদিরামের সনপাপড়ি আমি আগ্রহ করে খাই জানতে পেরে সে শুটিং-এর পুরো সময় সনপাপড়ির সাপ্লাইয়ের দিকে নজর রাখল। আমি মনের সাধ মিটিয়ে সনপাপড়ি খেলাম।
ছবি শেষ। সনপাপড়িও শেষ। জাহিদের সঙ্গে কথা ছিল ঢাকায় পৌঁছে সে সনপাপড়ির দোকানের ঠিকানা দেবে। ঢাকায় পৌঁছেই সে মোবাইল বন্ধ করে রেখেছে। মনে হচ্ছে সনপাপড়ির জন্যে আরেকটা ছবি পর্যন্ত আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।
.
প্রথম রাতে বনবিড়াল বধ
সব স্বামীই বিয়ের রাতে বিড়াল মারতে চান। বিড়াল নিয়ে আসেন। বিছানার পাশে বেঁধে রাখেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেইসব বিড়াল স্ত্রীরা মেরে ফেলেন। বিড়ালবধি স্ত্রীদের হাতে স্বামীদের বাকি জীবন ভেড়া হয়ে থাকতে হয়।
ছবির শুটিং এক ধরনের বিবাহ প্রক্রিয়া। কাজেই এই বিবাহ প্রক্রিয়ায় বিড়ালবধ জরুরি। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, কোনো একটা কারণ বের করে শুটিং-এর প্রথম দিন খুব হৈচৈ করে এক পর্যায়ে বলব, কাজই করব না। প্যাক আপ। সবাই বুঝবে, বাপরে, এত কঠিন পরিচালক!
আমাকে কারণ খুঁজতে হলো না। শুটিং-এর প্রথম দিন কারণ আপনাআপনি হাতে ধরা দিল।
টিলাগাঁও রেলস্টেশনে শুটিং। আইজি সাহেব দলবল নিয়ে ট্রেন থেকে নামবেন। ক্যামেরা ওপেন হবে সাড়ে নটায়। আমি নটায় উপস্থিত হলাম। ক্যামেরাম্যান মাহফুজুর রহমান তার আগেই এসেছেন। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে চা খাচ্ছেন। তার চিন্তার কারণ শত শত মানুষ। এদের সরিয়ে শুট কীভাবে নেয়া হবে? চ্যানেল আই যে দুজনকে (প্রোডাকশন কন্ট্রোলার) সবকিছু দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছে তারা অনুপস্থিত। জানা গেল দুজনই ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙলে আসবে। ক্যামেরা চলে এসেছে, লাইটের লোকজন আসে নি। গাড়ি নেই। যে মাইক্রোবাস ক্যামেরা নিয়ে এসেছে সেটা নড়বে না। কারণ তাদের ওপর নাকি কঠিন নির্দেশ–ক্যামেরা ছাড়া এই মাইক্রোবাস আর কোনো কিছুই বহন করতে পারবে না।
ক্যামেরাম্যান মাহফুজুর রহমান বললেন, চা খান। রাগ কন্ট্রোলে রাখুন। আল্লাহপাক যা ঠিক করে রেখেছেন তারচেয়ে বেশি কিছু হবে না, কমও হবে না।
চায়ে চুমুক দিয়ে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। জাহিদের শ্বশুরবাড়ির চায়ের মতো চা। মুখে দেওয়া যায় না (জাহিদের শ্বশুরবাড়ির চা আমি কখনো খাই নি। জাহিদ আমাকে বলেছে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ চা হয় তার শ্বশুরবাড়িতে)।
আমার চা পানে বিঘ্ন ঘটল। মধ্যবয়স্ক টাকমাথার এক ভদ্রলোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন, সিলেটি ভাষায় বললেন, আপনারা সিলেটের ঐতিহ্য নষ্ট করছেন। জীবন থাকতে আমি সিলেটের ঐতিহ্য নষ্ট করতে দিব না।
ভদ্রলোককে সমর্থন দেবার জন্যে সমবেত জনতার এক অংশ বলল, অয় অয়। (অয় শব্দটির বাংলা মানে হ্যাঁ।
আমি বললাম, ঐতিহ্য কীভাবে নষ্ট করেছি? সিলেটে কি ছবির শুটিং হয় না?
হয়। কিন্তু ঐতিহ্য রক্ষা করার পর হয়।
সমবেত জনতা বলল, অয় অয়।
আমি বললাম, কী ঐতিহ্য নষ্ট করেছি?
স্টেশনের নাম টিলাগাঁও। আপনার সেই স্টেশনকে বানিয়েছেন সোহাগী। স্টেশনের ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হয়েছে।
সমবেত জনতা গর্জে উঠল, অয় অয়।
আমি তাকিয়ে দেখি, ঢাকা থেকে তৈরি করে আনা সোহাগী নামফলক বিভিন্ন দিকে বসে গেছে।
ভদ্রলোক বললেন, শুটিং যদি করতেই হয় টিলাগাঁও নামে করতে হবে।
আমি বললাম, লেখক তার বইয়ে স্টেশনের নাম দিয়েছেন সোহাগী। লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য নাম দেয়া যাবে না। সোহাগী নামই ব্যবহার করতে হবে।
লেখকের কাছ থেকে অনুমতি নেন। তাকে মোবাইল করেন।
আমিই লেখক। আমি অনুমতি দিলাম না।
আমার এই কথায় দর্শকদের এক অংশ হেসে ফেলল। ভদ্রলোক ছুটে বের হয়ে গেলেন।
আমি ভাবছি, না জানি নতুন কী যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে। মাহফুজুর রহমান ফিসফিস করে বললেন, সব সাইকোলজি প্রেডিক্ট করা মুশকিল। কী হয় না হয় কে জানে। সোহাগী নামফলক তুলে দিন। আমি বললাম, না।