বাকি থাকল চ্যালেঞ্জার। সেই বাকি থাকে কেন? একদিন জানলাম টাকাপয়সা বিষয়ক কিছু সমস্যা তার হচ্ছে। ইদানীং নাটক এবং টেলিফিল্ম করে যে টাকা সে পায় চ্যানেল আই তাকে তারচেয়ে অনেক কম টাকা দিচ্ছে। সে দশদিন কাজ করে এর থেকে বেশি টাকা পায়। সেখানে একমাস! চ্যালেঞ্জারকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। টাকাপয়সা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এরকম আমার কখনোই মনে হয় নি।
অবশ্যই টাকাপয়সা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারপরেও জীবন মাপার ব্যারোমিটার কখনোই অর্থ হতে পারে না। চ্যালেঞ্জারকে আমি নিজেই ছবি থেকে বাদ দিলাম। শাওন প্রবল আপত্তি করল। তার একটাই যুক্তি, চিত্রনাট্যে তুমি আইজি সাহেবের চরিত্র চ্যালেঞ্জারকে মাথায় রেখে তৈরি করেছ। চ্যালেঞ্জারকে বাদ দিয়ে অন্য যাকেই তুমি নিবে তার মধ্যে চ্যালেঞ্জারকে দেখতে চাইবে। যখন দেখবে না, তখন নিজেরই খারাপ লাগবে। তুমি চ্যালেঞ্জারকে বাদ দিও না।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, তোমার যুক্তি মানলাম, কিন্তু তালগাছটি আমার। আমি চ্যালেঞ্জারকে বাদ দিলাম।
কে করবে আইজি চরিত্র?
কাউকে না পাওয়া গেলে আমি নিজেই করব।
পাগল হতে তোমার বেশি বাকি নেই।
আমি বললাম, নিশ্চিন্ত থাকে। ছবি শেষ হবার আগেই পুরোপুরি পাগল হয়ে যাব।
আমার সমুদ্রশয্যা দেখে শাওন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল। একে টেলিফোন তাকে টেলিফোন– শিল্পী যোগাড় করা যায় কি না।
একরাতে হতাশ হয়ে চ্যানেল আই-এর হাসানকে টেলিফোন করে বললাম, চিত্রনাট্যটা তৈরি আছে। তুমি তৌকীর আহমেদকে চিত্রনাট্যটা দিয়ে ছবি করতে বলো। সে আগেও আমার চিত্রনাট্যে দারুচিনি দ্বীপ বানিয়েছে। ভালো বানিয়েছে। এবারেরটা আরো ভালো হবে। তৌকীর পরিচালনা করলে আইজি সমস্যার সমাধান হবে। আবুল হায়াত সাহেব আনন্দের সঙ্গেই আইজি করবেন।
হাসান বিড়বিড় করে বলল, বিশ তারিখ থেকে শুটিং শুরু, আজ সতের তারিখ, এখন আপনি এইসব কী বলছেন?
সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন আসাদুজ্জামান নূর। শাওনকে তিনি মা ডাকেন। শাওন যখন করুণ গলায় বলল, নূর চাচা, হুমায়ুন আহমেদ মহাবিপদে পড়েছে। তার শরীর কত খারাপ সেটা তো আপনি জানেন। তাকে দেখলে মনে হয় যে-কোনো সময় হার্ট অ্যাটাক হবে। আইজি চরিত্রটি আপনি করে দিন, কিংবা আলী যাকের চাচাকে রাজি করান।
নূর বললেন, মা, তুমি হুমায়ূনকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করো। আমি বিশ তারিখের আগেই আলী যাকেরকে রাজি করাব। সে রাজি না হলে আমি তো আছিই। তুমি হুমায়ূনকে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে বলো।
শাওন বলল, নুর চাচা থ্যাংক ইউ।
বলতে বলতে সে চোখ মুছল। গভীর আবেগে এবং আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেছে। সে আমাকে ধরা গলায় বলল, এখন তোমার অশান্তি দূর হয়েছে তো? চলো কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে দুজনে ডিনার করি। তুমি তো খাওয়াদাওয়াই ছেড়ে দিয়েছ।
আমরা বিশাল সাইজের লবস্টার দিয়ে ডিনার সারলাম। রাতে খুব আরামের ঘুম হলো।
উনিশ তারিখ আসাদুজ্জামান নুর জানালেন, তিনি বা আলী যাকের দুজনের কেউই অভিনয় করতে পারবেন না।
আমি শাওনের আহত এবং দুঃখিত মুখের দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। সে করুণ গলায় বলল, চ্যালেঞ্জারকে বলি? আমাদের এত বড় বিপদে তিনি পাশে দাঁড়াবেন না এটা হতেই পারে না।
আমি বললাম, না।
ছবির কী হবে?
ছবি হবে। আগামীকাল থেকেই শুটিং। Countdown শুরু হয়েছে। মাঝখানে থামা যাবে না।
আইজি চরিত্র কে করবেন?
জানি না।
আইজি চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে এগিয়ে এলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। যে করুণা এই মানুষটি আমার প্রতি দেখিয়েছিলেন সেই করুণা যেন বহুগুণে এই মানুষটির প্রতি বর্ষিত হয়, তাঁর প্রতি এই আমার শুভ কামনা। গুরু নানক বলেছেন—
দুগুনা দত্তার
চৌগুনা জুজার
যে দুগুণ দেয় সে চারগুণ ফেরত পায়। গুরু নানকের এই বাক্যটি আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
ফটোগ্রাফার সাব্বির
ফটোগ্রাফার সাব্বির চরিত্রে অভিনয় করতে এগিয়ে এলেন চিত্র জগতের আরেক নায়ক ফেরদৌস। তার সঙ্গে আমি চন্দ্রকথা ছবিতে কাজ করেছি। চিত্রনায়কদের নায়কসুলভ সমস্যা থেকে সে বহুলাংশে মুক্ত। বিয়ের পর তার স্বভাবে এবং আচরণে অন্য ধরনের স্থিরতা এসেছে। আমার আছে জল ছবিতে সাতদিনের নোটিশে তাকে যে রাজি করিয়েছে তার নাম হাসান। হাসান এই দায়িতু পালন করে মহানন্দে ইউরোপ বেড়াতে চলে গেল। আমি এবং শাওন খুবই আনন্দ পেলাম। আমরা সাব্বির নামের কঠিন একটি চরিত্রে একজন Dependable আর্টিস্ট পেলাম।
ফেরদৌসকে অনেক শিডিউল (এ দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গের) উলটপালট করতে হলো। তার মধ্যে যতটুকু ফাঁক পাচ্ছিল সে সিলেট থেকে বিমানে চলে যাচ্ছিল, অন্য সিডিউলে কাজ করে আবার ফিরে আসছিল।
ফেরদৌসের একটা ছোট্ট গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছি না। পাঠকরা জানেন কি না জানি না, ছবির সব নায়ক এবং নায়িকাদের আলাদা চেয়ার এবং বিশাল রঙিন ছাতা থাকে। নায়ক-নায়িকাদের সহকারীরা চেয়ার এবং ছাতা বহন করে।
আমি একদিন ভুল করে ফেরদৌসের চেয়ারে বসে পড়েছি। খুবই আরামদায়ক চেয়ার। ফেরদৌস ব্যাপারটা লক্ষ করল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার স্ত্রীকে টেলিফোন করল।
স্যার আমার চেয়ারটায় বসে খুব আরাম পেয়েছেন বলে আমার মনে হয়েছে। তুমি তো এখন লন্ডনে। তুমি অবশ্যই লন্ডনের যে দোকান থেকে আমার এই চেয়ারটা কিনেছ, অবিকল সেরকম একটা চেয়ার কিনে সিলেটে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে।