একমাত্র ব্যতিক্রম ঔপন্যাসিক মইনুল আহসান সাবের। তিনি আমাদের আড্ডায় কম আসেন, তবে বেশির ভাগ সময় তার স্ত্রীকে নিয়ে আসেন।
মহিলারা কেন Old Fools’ Club এড়িয়ে চলেন তা এখনো জানি না। মিসির আলি সাহেবকে কারণটা বের করতে বলেছি। তিনি চিন্তাভাবনা করছেন। সিদ্ধান্তে পৌঁছালেই আমি জানব।
কিছুদিন আগে আমাদের আড্ডা সম্পর্কে আমি একটি ভয়ঙ্কর তথ্য আবিষ্কার করেছি। বন্ধুদের বলেছি। সবাই একমত হয়েছেন। তথ্যটা আপনাদের জানাই।
তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই এমন কেউ যদি হঠাৎ এসে এই আড্ডায় আসক্ত হন, তাহলে বুঝা যাবে তার দিন শেষ হয়েছে। ডাক এসেছে, তাকে চলে যেতে হলে। চারজনের উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। তাদের নাম বলতে মন সায় দিচ্ছে না। সর্বশেষ নামটা শুধু বলি। কেমিস্ট্রির দেলোয়ার ভাই। তিনি যাবেন ইউরোপ। রাত একটায় ফ্লাইট। তারপরেও কিছুক্ষণ আড্ডায় থাকার জন্যে তিনি টেলিফোন করেছিলেন। টেলিফোনে এটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ যোগাযোগ। ইউরোপ থেকে ফিরেই তিনি মারা গেছেন।
এখন হঠাৎ আড্ডায় যোগ দিয়েছেন নতুন একজন। আমার শৈশববন্ধু কঠিন মাওলানা সেহেরি। সন্ধ্যা মিলানোর পর তিনি ঘরে থাকতে পারেন না। যদি কোনো একদিন না আসেন আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর বাসায় টেলিফোন করি। ভাবি টেলিফোন ধরেন। আমি বলি, ভাবি, সেহেরি কেমন আছে? তার কোনো সমস্যা নাই তো? শরীর ঠিক আছে?
ভাবি বলেন, বুড়া ভালো আছে। খাটে বসে বকরবকর করছে।
আমি বলি, শুনে শান্তি পেলাম ভাবি। পৃথিবীতে বকরবকর অবিনশ্বর। আর সবই নশ্বর। Silence is golden কথাটা মিথ্যা। Silence কখনোই Golden না।
আমার আছে জল
আমার আছে জল
(সাধারণ জল না, হট ওয়াটার)
কিছুদিন আগে একটা ছবি বানিয়ে শেষ করেছি। নিজেরই যৌবনকালের রচনা আমার আছে জল উপন্যাসের চিত্ররূপ। প্রযোজক চ্যানেল আই। ছবিতে শর্ত জুড়ে দেওয়া, লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতায় যে মেয়েটি প্রথম হয়েছে সে-ই হবে নায়িকা। অভিনয় জানুক বা না-জানুক। কঠিন শর্ত। শর্ত মানার অর্থ হচ্ছে ঢেঁকির চেয়েও বেশি কিছু গেলা, রাইস মিল গেলা। আমি রাইস মিল গিলে ফেললাম। কারণ অর্থনৈতিক না, কারণ হৃদয়নৈতিক। লেখালেখি করতে গিয়ে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন অন্যকিছু করতে ইচ্ছে করে। ছবি বানানোর সময় আমার মধ্যে প্রবল ঘোর কাজ করে। এমনিতেই আমি ঘোরলাগা মানুষ। বাড়তি ঘোরে কঠিন নেশার অনুভূতি হয়। বড় ভালো লাগে।
ছবি বানাতে প্রথম যে জিনিসটি লাগে তার নাম অর্থ। অর্থের পরেই লাগে একটা নিখুঁত চিত্রনাট্য। চিত্রনাট্য নিয়ে মোটেই মাথা ঘামালাম না। ভাবটা এরকম, আমারই তো ছাগল। ইচ্ছেমতো কেটেকুটে নিব। ছবির শুটিং শুরু হবে ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ থেকে। চিত্রনাট্য বাদ দিয়ে আমি করছি লেখালেখি। মধ্যাহ্ন উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড। আমার চিন্তা-চেতনায় মধ্যাহ্ন, আমার আছে জল না।
লেখালেখি শেষে চিত্রনাট্য নিয়ে বসলাম এবং প্রথম যে বাক্যটি উচ্চারণ করলাম তা হচ্ছে, খাইছে আমারে। পড়লাম গভীর জলে। নানানভাবে চেষ্টা করেও চিত্রনাট্য দাঁড় করাতে পারছি না। এদিকে দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। গান লেখা হয়ে গেছে। গানে সুর দেওয়া হয়েছে। পাত্রপাত্রীরা তৈরি। ক্যামেরা, ক্রেন, ট্রলি, বৃষ্টি, জেনারেটর রেডি। রেডি না চিত্রনাট্য। আমি সারাদিন লিখি, সন্ধ্যাবেলায় যা লিখি ছিঁড়ে কুচিকুচি করি। পুত্র নিষাদ ছেড়া কাগজে হামাগুড়ি দিয়ে বড়ই আনন্দ পায়। আমি ভাবি, নিষাদের বয়সে ফিরে যেতে পারলে কত সুখেই না থাকতাম।
করুণাময় একসময় করুণা করলেন। একদিন অবাক হয়ে দেখি, চমৎকার একটি চিত্রনাট্য দাড় করে ফেলেছি। শাওনকে পড়তে দিলাম। সে পড়ে গম্ভীর হয়ে গেল। আমি বললাম, কোনো সমস্যা? সে বলল, হ্যাঁ, সমস্যা।
কী সমস্যা?
সে বলল, যে-কোনো অগা মগা বগা ডিরেক্টরকে এই চিত্রনাট্য দিলে সে সুন্দর ছবি বানিয়ে দিবে। ভালো ডিরেক্টর লাগবে না।
তার প্রশংসাবাক্য বড় ভালো লাগল। স্ত্রীর প্রশংসা পাওয়া যে কত জটিল বিষয় তা স্বামী মাত্রই জানেন।
.
মহাবিপদ সংকেত (দশ নম্বর)
চিত্রনাট্য তৈরি হবার পর মহাবিপদ সংকেতের ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। ঘণ্টা আগেই বাজছিল। আমি নির্বোধ প্রকৃতির বলে বুঝতে পারি নি। একে একে শিল্পীরা ঝরে পড়তে শুরু করলেন।
প্রথমে সরে দাঁড়াল মাহফুজ। তাকে শুরুতে জামিল নামের একটি চরিত্রে নিয়েছিলাম। আলাভোলা টাইপ চরিত্র। পরে মনে হলো মাহফুজের চেয়ে জাহিদকে এই চরিত্রে ভালো মানাবে। মাহফুজকে মানাবে সাব্বির চরিত্রে। আমেরিকা প্রবাসী এক ফটোগ্রাফার। স্মার্ট, সুদর্শন। মাহফুজ বলল, না। সে জামিল ছাড়া অন্য চরিত্রে কাজ করবে না। তাকে অনেক বোঝালাম। সে বুঝল না।
মাহফুজ তার নানান কর্মকান্দ্রে অনেকবার আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে, ঐদিনের কঠিন না সব আনন্দ ছাপিয়ে প্রবল বেদনায় আমাকে ঢেকে দিল। বারবার মনে হলো, আমি সবসময় আমার স্নেহ অপাত্রে দান করেছি। যেখানে আমার নিজের পুত্রকন্যাই আমার স্নেহ বুঝতে পারে নি, সেখানে দূরের মাহফুজ কী করে বুঝবে?
মাহফুজের পরেই ছিটকে সরে গেল রিয়াজ। তার করার কথা সাব্বির। রিয়াজকে যে মাহফুজের চেয়ে আমি কোনো অংশে কম স্নেহ করেছি তা না। ছেলেটির চেহারা যেমন সুন্দর আচার-ব্যবহারও সুন্দর। অতি মিশুক অতি আড্ডাবাজ মানুষ। ছবির জগতের মানুষদের কিছু অদ্ভুত হিসাব-নিকাশ থাকে। আমার ধারণা রিয়াজ অদ্ভুত হিসাবটা করল। সে ভাবল যেহেতু মাহফুজ সাব্বির চরিত্রটা করছে না কাজেই সেখানে নিশ্চয়ই কিন্তু আছে। রিয়াজ টেলিফোনে জানাল, যে-সময়ে আমার আছে জল-এর শুটিং হবার কথা সে-সময়ে তার অন্য একটা ছবির জন্য সময় দেওয়া। তার মনে ছিল না… ইত্যাদি।