আরেকজন বললেন, আমি চলে যাই সমুদ্রের কাছে। সমুদ্রের ঢেউ কীভাবে আছড়ে পড়ে তা দেখি। ধারাবাহিক ঢেউ দেখতে দেখতে লেখার ধারাবাহিকতা ফিরে আসে। [আমি সেমিনারের শেষে আলাপ করে জেনেছি এই, লেখক থাকেনই সমুদ্রের পাড়ের এক বাংলোবাড়িতে।]
ইন্দোনেশিয়ার এক কবি বললেন, আমি তখন যোগব্যায়াম করি। এবং চোখ বন্ধ করে ফিবোনাচ্চি সিরিজ ভাবি। এতে আমার ব্লক কাটে। [ব্যায়ামের অংশটা ঠিক হতে পারে, তবে ফিবোনাচ্চি সিরিজের ব্যাপারটা পুরোটাই ভুয়া বলে আমার ধারণা। কারণ এই সিরিজ কিছুক্ষণের মধ্যেই যথেষ্ট জটিল হয়ে দাঁড়ায়। খাতাকলম ছাড়া সিরিজের সংখ্যা বের করা অসম্ভব ব্যাপার। যদি না তিনি রামানুজন বা ইউলারের মতো বড় কোনো ম্যাথমেটিশিয়ান না হন। ফিবোনাচ্চি সিরিয়েল হলো ১ ১ ২ ৩ ৫ ৮ ১৩ ২১…]
লেখকরা নিজেদের প্রসঙ্গে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলতে পছন্দ করেন। তারা সারাক্ষণ এক ধরনের ঘোরের মধ্যে থাকেন বলেই অন্যরা যে বানিয়ে বলা বিষয়টা ধরে ফেলেছে তা বুঝতে পারেন না।
এখন আমি আমার নিজের রাইটার্স ব্লক বিষয়ে বলি। না, এই জিনিস আমার হয় না। কাগজ-কলম নিয়ে লেখার টেবিলে বসলেই হলো। মনে করা যাক, হিমু নিয়ে একটা লেখা লিখছি। হঠাৎ লেখা আটকে গেল। তখন অন্য একটা খাতা টেনে নেই। লিখি মিসির আলি বা সায়েন্স ফিকশান। এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? দুটি জিনিস প্রমাণিত হয়।
ক) আমি একজন গৌণ লেখক। কারণ শুধুমাত্র গৌণ লেখকরাই রাইটার্স ব্লক থেকে মুক্ত।
খ) আমি একজন শ্রমিক লেখক। শুধুমাত্র শ্রমিক লেখকরাই সারাক্ষণ লিখতে পারেন।
তবে আশার কথা এইসব নিয়ে আমি মোটেই চিন্তিত না। আমার এই লিখে যাওয়াতেই আনন্দ।
.
পাদটিকা
শাওন আমার এই লেখার প্রুফ দেখছিল। সে বলল, রাইটার্স ব্লক বিষয়ে নিজের সম্পর্কে যা লিখেছ তা ঠিক না। আমার পরিস্কার মনে আছে লীলাবতী উপন্যাস লেখার সময় হঠাৎ লেখা বন্ধ হয়ে গেল। রাতে ঘুমাতে পার না। সারারাত টিভি দেখ, হাটাহাটি কর। খাওয়া প্রায় বন্ধ হবার জোগার। তোমার ব্লক বিশদিনের মতো ছিল।
শাওনের কথায় যথেষ্ট আহ্লাদ বোধ করলাম। রাইটার্স ব্লক যেহেতু হচ্ছে মনে হয় আমি গৌণ লেখক না। হা হা হা। বেঁচে থাকুক রাইটার্স ব্লক।
স্লাইড রুল
আজকালকার ছেলেমেয়েরা স্লাইড রুলের নাম শোনে নি। স্লাইড রুল হলো গুণভাগ করার স্কেল। একটা স্কেলের ভেতর ছোট্ট একটা স্কেল। ছোট স্কেলটা slide করতে পারে বলে স্লাইড রুল নাম। রুল এসেছে রুলার থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কাজ ছিল ফার্স্ট ইয়ারের কেমিস্ট্রি ছাত্রছাত্রীদের স্লাইড রুলের ব্যবহার শেখানো। বড় বড় অংক কত সহজে রুলার নাড়াচাড়া করেই সমাধান করা যায় তা দেখে সবাই মুগ্ধ হতো। চোখ বড় বড় করে বলত—বাহ! তাদের এই বিস্ময় ধ্বনি শোনার জন্যেই আমি আগ্রহ করে স্লাইড রুল বিষয়ক ক্লাসগুলি নিতাম।
এখন অনেক জটিল অংক নিমিষেই ক্যালকুলেটারের বোতাম টিপে করা যায়। যারা অংকগুলি করে তারা কেউ বিস্ময়সূচক বাহ ধ্বনি করে না। ক্যালকুলেটর জটিল অংক করবে এটা নিপাতনে সিদ্ধ। এই নিয়ে বিস্মিত হবার কিছু নেই।
আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের হাত থেকে স্লাইড রুল কেড়ে নিয়েছে। বিস্মিত হবার বিষয়গুলি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
চলে গেছে টেলিগ্রাম। মোর্স সাহেবের টরে টক্কা। ট্রেনে যাবার সময় রেল লাইন ধরে টেলিগ্রাফের খুঁটি। তারের ওপর পাখিদের বসে থাকার দৃশ্য দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আজ আর কোনো যুবা পুরুষের কাছে টেলিগ্রাম আসে না– Mother serious. Come sharp.
এই টেলিগ্রামের অর্থ যে মা অসুস্থ তা কিন্তু না। এর গূঢ় অর্থ, তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। চলে এসো। মায়ের অসুখের খবর জানিয়ে ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া।
টেলিগ্রামের আলাদা ভাষাই ছিল। মাত্র সাতটা শব্দের মধ্যে যা বলার বলতে হতো। শব্দ বেশি ব্যবহার করার অর্থ বেশি চর্জি। অল্প শব্দে টেলিগ্রাম করার জন্যে বিচিত্র ভাষা তৈরি হয়ে গেল।
উদাহরণ দেই। ছেলেকে জানানো হবে–বাবা এখন অনেক সুস্থ। সবাইকে চিনতে পারছেন। তোমাকে দেখতে চাচ্ছেন। আঙুর খেতে চাচ্ছেন। কিছু আঙুর নিয়ে চলে এসো। দেরি করবে না।
BABA BETTER RECOGNIZING SEE YOU COME GRAPE.
অন্যরা এই টেলিগ্রামের মর্মার্থ বুঝবে না। যার কাছে পাঠানো হয়েছে সে ঠিকই বুঝবে।
হারিয়ে যাচ্ছে চিঠি। আজকাল কেউ আর চিঠি লিখে না। SMS চালাচালি করে। SMS-এর কী বিচিত্র ভাষা–KFC CHICKEN KHABE? Love U
অর্থ–KFCর চিকেন খাবে? তোমাকে ভালোবাসি।
ফাউনটেন পেন চলে গেল।
এখন বলপয়েন্ট। কালি শেষ কলম ফেলে দাও। আমাদের সময় চালু ঝর্ণা কলমের নাম ছিল রাইটার আর পাইলট। সবার বুকপকেটে কলম শোভা পেত। জামাইদের উপহার ছিল শেফার্স কলম। তারো আগে নিবের কলম। আমার শৈশবের কলম হলো নিবের কলম। আমাদের সময়ে ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত দোয়াত থাকত। একটা দোয়াত ছিল, উল্টে গেলেও কালি পড়ত না। দোয়াতের কালি আমরা নিজেরা বানাতাম। এক আনা দামের কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত। এক দোয়াল কালি বানাতে একটা টেবলেটই যথেষ্ট ছিল। যে সব ছেলেমেয়ের বাবার টাকাপয়সা আছে, তারা দুটা ট্যাবলেট দিত। তাদের কালির রঙ ছিল দর্শনীয়।