স্মোকড হিলসা খেতে খেতেই শুনলাম অবসর প্রকাশনা সংস্থার আলমগীর রহমান শতাধিক পদের ইলিশ রান্নার একটি বই কম্পোজ করে রেখেছেন। কাউকে দিয়ে ভূমিকা লেখানো যাচ্ছে না বলে বইটি প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ভূমিকা আমি লিখে দেব।
সাধারণত দেখা যায় লেখকদের লেখার ক্ষমতা পুল্লাপুরি শেষ হবার পর তারা ভূমিকা এবং সমালোচনা জাতীয় রচনা লেখা শুরু করেন। যে আগ্রহে ভুমিকা লিখতে রাজি হয়েছি তাতে মনে হয় আমার ঘণ্টা বেজে গেছে। আচ্ছা বাজুক বণ্টা, আমি ভূমিকাতেই থাকি।
গুরুগম্ভীর ভূমিকা লেখার বিশেষ কায়দা আছে। প্রথমেই নামের উৎপত্তিতে যেতে হয়। ইলিশ নামটা কীভাবে এল, কেন এল। এই প্রজাতির মাছ পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে পাওয়া যায়। যেসব মাছ সমুদ্রে থাকে এবং ডিম পাড়ার জন্যে মিঠা পানিতে আসে তাদের শ্রেণীবিন্যাস। সেই বিন্যাসে ইলিশের স্থান কোথায় সে বিষয়ে আলোচনা। এরপর আসবে ইলিশের ইতিহাস। বাংলা আদি সাহিত্যে (চর্যাপদে) ইলিশ মাছের উল্লেখ কেন নেই সে বিষয়ে গবেষণামুলক সুচিন্তিত মতামত। মোগল রসুইখানায় ইলিশের অনুপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা।… আমি এইসব কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি বাংলা বর্ণমালার শিশুশিক্ষা বইয়ে অ-তে হয় অজগর, আ তে আম, ই-তে ইলিশ.. এই তথ্যই কি ইলিশ রান্না বিষয়ক একটি বইয়ের ভূমিকার জন্য যথেষ্ট নয়?
লেখক বনধ
আমরা যাকে বলি হরতাল, কোলকাতায় তাকে বলে বনধ। কোলকাতা বনধ মানে সে শহর অচল। কাজকর্ম বন্ধ।
লেখক মাঝে মাঝে অচল হয়ে পড়েন। ইংরেজিতে একে বালে Writers block, আমি এর বাংলা করেছি—লেখক বনধ।
রাইটার্স ব্লক নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প প্রচলিত আছে। Adger Alanpoe না কি রাইটার্স ব্লক হলে পকেটে পিস্তুল নিয়ে বের হয়ে পড়তেন। কাউকে খুন করলে ব্লক কাটবে এই আশায়। তাঁর নামে খুনের অভিযোগ অবশ্যি আছে। কে জানে রাইটার্স ব্লক কাটানোর জন্যে এই খুন করা হয়েছে কি না।
বিভূতিভূষণ রাইটার্স ব্লক হলে বনে জঙ্গলে হাঁটতেন। এতে বাংলা সাহিত্যের লাভই হয়েছে। বনভূমি নিয়ে অপূর্ব লেখা আমরা পেয়েছি।
“বাতাবি লেবুর ফুল নয়, ঘেঁটুফুল নয়, আম্রমুকুল নয়, কামিনী ফুল নয়, কী একটা নামগোত্রহীন রূপহীন নগণ্য জংলি কাটাগাছের ফুল। আমার কাছে কিন্তু তাহাই কাননভরা, বনভরা, কুসুমরাজির প্রতীক হইয়া দেখা দিল।… (আরণ্যক)
ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁর কখনো রাইটার্স ব্লক হয়েছে কি না। তিনি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলেছেন, রাইটার্স ব্লক হবার সময় কোথায়? সময় পেলে না হবে। লিখে কূল পাচ্ছি না।
এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতামত জানতে পারলে ভালো হতো। আমি কোনো লেখায় কিছু পড়ি নি। কোলকাতার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি চিঠিতে পড়েছিলাম বেশ কিছুদিন হলো তিনি লিখতে পারছেন না। সেই না পারাটা শারীরিক কোনো অসুস্থতার কারণে কি না তা এখন আর মনে পড়ছে না।
কল্লোল যুগের লেখকদের কেউ কেউ নাকি ব্লক ছুটানোর জন্যে বিশেষ পল্লীতে যেতেন। সেই পল্লীতে তারা ব্লক ছাড়াও যেতেন বলেই ব্লক কাটানোর উপায় বিশেষ পল্লী হতে পারে না।
রাইটার্স ব্লক ব্যাপারটা সম্পর্কে একটু ব্যাখ্যা করে বলি। এটা এক ধরনের অসুখ। সাধারণ পর্যায়ে অসুখের লক্ষণ হচ্ছে–লিখতে ইচ্ছা না হওয়া। মাথায় গল্প আছে, কিন্তু লিখতে ইচ্ছা করছে না। সাধারণ এই অসুখ সর্দিজ্বরের মতো কোনোরকম চিকিৎসা ছাড়াই আরাম হয়। এই অসুখ সাতদিনের মধ্যেই সারে।
এখন বলি জটিল ধরনের রাইটার্স ব্লকের কথা। এই রোগে রোগী (অর্থাৎ লেখক) মারাও যান। নোবেল পুরস্কার পাওয়া জাপানি ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা হারিকিরি করে মারা গিয়েছিলেন। আত্মহত্যার কারণ হিসেবে অনেকেই লিখতে না পারার কষ্টের কথা বলেছেন। যে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বিষয়ে একই কথা। যদিও তাঁর পরিবার থেকে বলা হয়েছে বন্দুকের নল পরিষ্কার করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু। অনেকেই বলেন, হঠাৎ লেখা বন্ধ হবার কষ্ট আত্মহনন।
রোগের কঠিন আক্রমণে লেখক দিশেহারা হয়ে যান। কী করবেন বুঝতে পারেন না। ঘণ্টার পর ঘন্টা লেখার টেবিলে বসে থাকেন। একটি শব্দও তার কলম দিয়ে বের হয় না। তার নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়। সেই রাগ তিনি পরিবারের সদস্যদের প্রতি ছড়িয়ে দেন। এক পর্যায়ে শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেঁচে থাকা তার কাছে অর্থহীন মনে হতে থাকে।
বহুকাল আগে আমি আমেরিকার lowa বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগে গিয়েছিলাম আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে। সেখানে পৃথিবীর নানান দেশের লেখক এসেছিলেন। গল্প, কবিতা পাঠ, সেমিনার এই ছিল প্রোগ্রাম। মোটামুটি হাস্যকর অবস্থা। এক কবিতা পাঠের আসরে দুই কবির মধ্যে মারামারি পর্যন্ত লেগে গেল। কবিরা যে বক্সিং-এ ওস্তাদ হন তা জানতাম না।
একটি সেমিনার ছিল রাইটার্স ব্লকের ওপর। লেখকরা বলেছেন নিজ নিজ অভিজ্ঞতার কথা। রাইটার্স ব্লক হলে তারা কী করে এর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করেন এইসব।
একজন বললেন, (তিনি কোন দেশের লেখক, কী নাম তা এখন আর মনে করতে পারছি না) আমি তখন আপেল খাই। সবুজ আপেল। এতে আমার রাইটার্স ব্লক কাটে। [আমি নিশ্চিত এটা একটা ফাজলামি। তার কোনোদিনই রাইটার্স ব্লক হয় নি। এই অসুখ গৌণ লেখকের হয় না।]