তিক্ত
লবণ
মিষ্টি
ঝাল
টক
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মতো পঞ্চ স্বাদ। সবাই কুইজে ফেল করেছেন। স্বাদ ছয় রকমের। ষষ্ঠ স্বাদের নাম Umami, সব খাবারেই কিছু Umami স্বাদ থাকে। মাংসে আছে, টমেটোতে আছে। সয়াসসে আছে প্রচুর পরিমাণে। Umami স্বাদটা এসে একধরনের লবণ থেকে। লবণের নাম Monosodium glutamate.
প্রকৃতি মানুষের মুখে পাঁচ রকমের স্বাদ কেন দিয়েছেন? দিয়েছেন আমাদের সর্তক করার জন্যে। পৃথিবীর যাবতীয় বিষাক্ত জিনিসের স্বাদ তিতা। আমরা যেন তিতা না খাই। নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবারের স্বাদ হবে টক। আমাদের নষ্ট খাবার বিষয়ে সতর্ক করার জন্যেই টক স্বাদ বুঝার টেস্ট বাড জিভে দেয়া আছে।
এখন আমরা বুঝে শুনে খেতে শিখেছি। আদি মানুষের সেই বোধ ছিল না। তাদেরকে নির্ভর করতে হতো জিভের ওপর।
পশ্চিমে রান্নাবান্নার পুরোটাই পুরুষদের দখলে। বাংলাদেশে ঘটনা সেরকম না। তার প্রধান কারণ আমাদের কালচারে পুরুষদের রান্নাঘরে ঢোকাকে মেয়েলি ভাব বলে মনে করা হয়। স্বামীদের রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলে বিরক্ত হন না এমন স্ত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। বাংলাদেশে বাবুর্চি শব্দটাও বুদ্ধিজীবীর মতো তুচ্ছার্থে ব্যবহার করা হয়। বিখ্যাত শেফ টমি মিয়াকে বাবুর্চি টমি মিয়া বললে তিনি নিশ্চয়ই রাগ করবেন।
আমার ধারণা সব পুরুষের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় রান্নার শখ আছে। আমার নিজের তো আছেই। শখ মেটাই রান্নার বই পড়ে। আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির একটা বড় অংশে আছে রান্নার বই। আমার গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররাও ভালো খাবার পছন্দ করে। হিমু তো করেই। সে মাজেদা খালার বাড়িতে যায় ভালো ভালো খাবারের লোভে।
মিসির আলির মতো নিরাসক্ত লোকও খাবার খেয়ে তৃপ্তির বিরাট বর্ণনা দেন।
আমার বইয়ে অনেক রেসিপিও দেয়া থাকে। অনেকে আবার সেই রেসিপি দেখে রাঁধতে গিয়ে ধরা খান। যাই হোক, একটি অতি সহজ রেসিপি দিচ্ছি। আমি এর নাম দিলাম ডিজিটাল জাউভাত।
আতপ চাল লাগবে। পাটপাতা লাগবে। পেঁয়াজ-লবণ নিশ্চয়ই ঘরে আছে।
পরিমাণ?
মেপে পরিমাণ দিতে পারছি না।
হাঁড়িতে আতপ চাল সেদ্ধ করুন। সঙ্গে সামনি পেঁয়াজ এবং লবণ। চাল সেদ্ধ হয়ে জাউ জাউ হয়ে যাবার পর কিছু পাটপাতা (তেতোটা) দিয়ে দিন ঘোঁটা। তৈরি হয়ে গেল ডিজিটাল জাউ।
গরম গরম পরিবেশন করুন।
চেহারা দেখে কেউ খেতে চাইবে না। তবে রাঁধুনীর প্রতি মমতাবশত কিংবা ভদ্রতাবশত কেউ যদি এক চামচ মুখে দেয়, সে দ্বিতীয়বারও নেবে।
এই রেসিপি আমি পেয়েছি নিউইয়র্ক প্রবাসী এক মহিলা কবির কাছ থেকে। তাঁর নাম নার্গিস আলমগীর।
অতি সাদামাটা রেসিপি দেখে যারা নাসিকা কুঞ্চন করছেন তাদের জন্যে মিশরের ফারাওদের খাবারের একটি রেসিপি। সম্রাটদের খানা বলে কথা।
চাল, ঘি, ভেড়ার মাংস হাঁড়িতে নিন। হাঁড়ির ঢাকনা আটা দিয়ে আটকে দিল। অল্প আঁচে সাত আট ঘণ্টা রাখুন। রেসিপিতে মসলাপাতির উল্লেখ নেই বলে দিতে পারছি না। মসলা এবং লবণ দিতে ভুলবেন না।
(সুত্র : বিরিয়ানির নেপথ্য কাহিনী, শাহরিয়ার ইকবাল।)
.
রান্নার ওপর কোনো বই না লিখলেও একটা রান্নার বইয়ের ভূমিকা আমার লেখা। বইটি হলো অবসর প্রকাশনীর ইলিশ রান্না।
পাঠকদের জন্য ইলিশ রান্না বইটির ভূমিকাটা দিয়ে দিলাম।
ভূমিকা
তখন আমেরিকার কার্গো শহরে থাকি। জানুয়ারি মাস, হাড়কাঁপানো শীত। থার্মোমিটারে পারদ নেমে গেছে শূন্যেরও কুড়ি ডিগ্রি নিচে। সকাল থেকেই তুষারপাত হচ্ছে। দৃশ্য খুবই সুন্দর, তবে বাইরে বের হয়ে দেখার দৃশ্য না। ঘরে বসে জানালা দিয়ে দেখার দৃশ্য।
এমন দুর্যোগের দিনেও বিকেল থেকেই আমার বাসায় অতিথিরা আসতে শুরু করল। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং মুরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশী ছাত্র। কারণ আজ আমার বাসায় ইলিশ মাছ রান্না হচ্ছে। ইলিশ মাছ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সিল করা টিনে ইলিশ। যতদূর মনে পড়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরির পাইলট প্রকল্পের জিনিস। যে প্রকল্পটি শেষ পর্যন্তু কাজ করে নি।
কৌটা খুলে দেখা গেল হলুদ রঙের আলুভর্তা জাতীয় পদার্থ। সেই জিনিস তেলে ভাজা হলো। সবাই চায়ের চামচের ছ’চামচ করে পেল। সবার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। যেন অমৃত চাখা হচ্ছে।
খাওয়াদাওয়ার পর রাতভর শুধুই ইলিশের গল্প। পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি, না যমুনার ইলিশের? সুরমা নদীতে যে ইলিশ ধরা পড়ে তার স্বাদ গভীর সমুদ্রের ইলিশের মতো। তার কী কারণ? এই নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা। একজন আর শুনালেন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের স্প্যানে ধাক্কা খাওয়া ইলিশের গল্প। স্প্যানে ধাক্কা খেয়ে ইলিশ মাছের নাক থেঁতো হয়ে যায়। সেইসব নাকভাক্তা ইলিশই আসল পদ্মার ইলিশ।
এরপর শুরু হলো ইলিশ রান্নার গল্প। দেখা গেল সবাই ইলিশ রান্নার কোনো-না-কোনো পদ্ধতি জানে। ভাপে ইলিশ, চটকানো ইলিশ, শুধু লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে সেদ্ধ ইলিশ। গভীর রাত পর্যন্ত গল্প চলতেই থাকল।
পঁচিশ বছর আগের আমেরিকার এক দুর্যোগের রাতের সঙ্গে এখনকার অবস্থা মিলানো যাবে না। এখন আমি ঢাকা শহরে বাস করি। ইলিশ মাছ কোনো ব্যাপার না। প্রায় রোজই রান্না হয়। নতুন নতুন পদও হয়। এই তো সেদিন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত শেফ টমি মিয়া নিজে রান্না করে ইলিশ মাছের একটা পদ খাওয়ালেন–স্মোকবিহীন ‘স্মোকড হিলসা’। সাহেবদের পছন্দের খাবার।