আমি ভয়ে অস্থির হয়ে স্যারের সঙ্গে গেলাম। স্যার একটা টিনের হাফ বিল্ডিং-এ ঢুকলেন এবং ডাকলেন জমিলা বা এই ধরনের কিছু। স্যারের নাম এবং তার স্ত্রীর নাম মনে পড়ছে না। অল্পবয়েসী এক তরুণী বের হয়ে এলেন। স্যার বললেন, এ আমার ছাত্র। এদের আমি সবসময় বকাঝকা করি। তুমি একে কোলে নিয়ে আদর করে দাও। এতে সমান সমান হবে। ঘরে কোনো খাবার থাকলে খেতে দাও।
ক্লাস ফাইভে যে ছেলে পড়ে সে অনেক বড়। স্যারের বালিকা বধূ তারপরেও টেনে আমাকে কোলে তুললেন। লজ্জিত গলায় বললেন, ঘরে তো কিছু নাই। স্যার বললেন, কোলে নিয়ে বসে থাক। আমি গরম জিলাপি নিয়ে আসি। গরম জিলাপি পুলাপানের পছন্দ। এই বলেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, গাধা গরম জিলাপি খাবি?
আমি বললাম, খাব।
ঝিম ধরে কোলে বসে থাক, আমি জিলাপি নিয়ে আসছি।
পৃথিবীর অনেক প্রাণী extinct হয়ে যাচ্ছে। তাদের রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা শৈশবে যেসব শিক্ষক পেয়েছি তাঁরাও Extinct হয়ে যাচ্ছেন। তাদের রক্ষার কোনো চেষ্টা নেই।
রান্নাবান্না
রান্নার সঙ্গে সবসময় বান্না যুক্ত হয় কেন?
খেলাধুলার তাও অর্থ করা যায়। খেলার সময় ধুলা উড়ে এলেই খেলাধুলা। খাবারের সঙ্গে যুক্ত হয় দাবার। খাবারদাবার। দাবার আবার কী? দাবারের একটি অর্থ আমি করেছি। তেমন সুবিধার খাবার যেটা না সেটাই দাবার। কোথাও দাওয়াতে গেলে (সচরাচর যাওয়া হয় না, তারপরও হঠাৎ…) টেবিলে প্রচুল খাবার দেওয়া হয়। আমি সেখান থেকে খাবারগুলি আলাদা করি, দাবারের কাছে যাই না। সাত পদ রান্না হলে পাঁচ পদই যে দাবার হবে, এটা কিন্তু নিপাতনে সিদ্ধ।
যাই হোক, রান্নাবান্নায় ফিরে যাই। চৈত্র মাসের এক দুপুরে খেতে বসেছি। টেবিলে খাবার সাজানো। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললাম। প্রতিটি আইটেম দেখাচ্ছে রোগীর পথ্যের মত। পানি পানি ঝোলে ধবধবে সাদা শিং মাছের টুকরা। সঙ্গের সবজি হলো কাঁচকলা। যে মেয়েটি রান্না করে তাকে ডেকে শাওন বলল, তোমাদের স্যার তরকারিতে লাল রং পছন্দ করেন। তেল-মসলা ছাড়া খান না।
শাওনের বক্তৃতার ফল রাতে ফলল। খেতে বসে দেখি রঙের হোলি উৎসব। করলা ভাজির রঙও টকটকে লাল। দুপুরে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম, রাতে বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, আমি রান্নার একটা বই লিখব।
অন্যপ্রকাশের মাজহার এই কথা শুনে আল্লাদিত হলো। এবং সিরিয়াস মুখ করে বলল, বইয়ের নামটা বলুন, আমি ধ্রুবকে কভার করতে বলে দেই। কাজ এগিয়ে রাখি।
আজকাল টিভি খুললেই রান্না এবং টকশোর অনুষ্ঠান। দুটো অনুষ্ঠানের মধ্যে মিলও আছে। রান্নার অনুষ্ঠান থেকে কেউ রান্না শিখতে পারছে না, টকশোর অনুষ্ঠান থেকে কেউ কিছু শিখছে না।
সেলিব্রেটি রান্না নামের আরেক বস্তু বের হয়েছে। গায়ক-গায়িকা, চিত্রশিল্পী, নায়ক-নায়িকারা অনুষ্ঠানে নতুন নতুন রান্না শেখাচ্ছেন। (অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকাই সব তৈরি করে রাখছেন। সেলিব্রেটিরা হাসিমুখে চামচ নাড়ছেন।) শাওন গায়িকা এবং অভিনেত্রী হিসেবে এক রান্নার অনুষ্ঠানে গেল। কড়াইয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে তাকে চার লাইন গানও করতে হলো।
আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা ভাঙা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে…
খুন্তি কড়াই এবং রঙধনু কোপ্তার (শাওনের রান্না করা খাদ্যদ্রব্যটির এটাই নাম) সঙ্গে অবাক জোছনার সম্পর্ক ঠিক বুঝলাম না।
অনেকক্ষণ হালকা কথা বললাম, এখন মাঝারি টাইপ ভারী কথা বলি। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক পার্ল এস বাকের (গুড আর্থ) সীমাহীন আগ্রহ ছিল রান্নাবান্নায়। তিনি রান্নার একটি বইও লিখেছেন। এই বইটির কপি আমার কাছে আছে।
কবি সৈয়দ আলী আহসান সাহেবও রান্নার বই লিখেছেন। তাঁর বইয়ের রেসিপি ব্যবহার করে শুধু রসুন দিয়ে আমার বাসায় মুরগি রান্না হয়েছিল। খেতে অসাধারণ হয়েছিল। যদিও বই দেখে রান্না কখনো ভালো হয় না, এই তথ্য নিউটনের সূত্রের মতো সত্য।
বর্তমানে এলজিআরডি মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ সাহেব যখন মন্ত্রী ছিলেন না, তখন একরাতে আমার বাসায় আড্ডা দিতে এসেছিলেন। আড্ডায় রান্নার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি মোটামুটি অভিভূত গলায় বললেন, হুমায়ুন ভাই, শেখ হাসিনা যে কত ভালো রাঁধতে পারেন তা কি আপনি জানেন?
আমি বললাম, জানি না। জানার কোনো সুযোগ নেই।
সৈয়দ আশরাফ বললেন, তাঁর রান্না শুধু যে অসাধারণ তা-না, অসাধারণের অসাধারণ।
বঙ্গবন্ধু কন্যার এই গুণটির কথা কেউই মনে হয় জানেন না। সুযোগ পেয়ে জানিয়ে দিলাম।
প্রধানমন্ত্রীর কেবিনেটে কিছু নারীমুখ দেখছি। টিভি পর্দায় তাদের যখন দেখি তখন প্রথমেই মনে হয়, আচ্ছা এই অতি ব্যস্ত মহিলা বি এখন রাঁধেন? বা রান্নাবান্না নামক ব্যাপারটা জানেন? তাঁদের প্রিয়জনরা কি তাঁদের হাতের রান্না খেয়ে কখনো বলেছেন, বাহ অসাধারণ!
আমার নিজের ধারণা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন রান্না জানেন না। রাঁধার মতো সুযোগই পান নি। রাজনীতি করে এবং বক্তৃতা দিতে দিতেই তাঁর জীবন কেটে গেছে। টিভিতে তাকে মাঝে মধ্যে দেখি। যাই বলেন বিকট চিৎকার দিয়ে বলেন।
মনে হয় পলটন ময়দানে ভাষণ দিচ্ছেন, মাইক কাজ করছে না বলে চেঁচিয়ে বলতে হচ্ছে।
উনি চিৎকার করতে থাকুন, আমি রান্নাবান্নায় ফিরে আসি। প্রথমেই কুইজ—স্বাদ কত রকমের?