যে যা বলে বলুক, আমার ধারণা বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির মধ্যে এটি একটি। উপন্যাসটি আমাকে কতটুক আচ্ছন্ন করেছে তার প্রমাণ দেই। আমার উপন্যাস শ্রাবণ মেঘের দিনের প্রধান চরিত্র কুসুম। এই কুসুম এসেছে পুতুলনাচের ইতিকথা থেকে। শশী ডাক্তারের প্রণয়িনী। স্ত্রী শাওনকে আমি ডাকি কুসুম নামে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমি তখন নিজেকে শশী ডাক্তার যে ভাবি না তা কে বলবে!
আমার মেজো মেয়ের নাম শীলা। এই নামটিও নিয়েছি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প শৈলজ শিলা থেকে। গল্পের শেষে তিনি বলছেন—শৈলে যাহার জন্ম, শিলা যাহার নাম সে শিলার মতো শক্ত হইবে জানি কিন্তু রসে ডুবাইয়া রাখিলেও শিলা কেন গলিবে না ভাবিয়া মাথা গরম হইয়া উঠে।
.
তাঁর কোন লেখা কেমন, কোন গ্রন্থে জাদুবাস্তবতা আছে, কোনটিতে নেই, এইসব তাত্ত্বিক আলোচনায় যাব না। সাহিত্যের সিরিয়াস অধ্যাপকদের হাতে এই দায়িত্ব থাকুক। আমি ব্যক্তি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি।
নিঃসঙ্গ মানুষটার কোনো বন্ধু ছিল না। এতগুলি বই লিখেছেন, কাউকে কোনো বই উৎসর্গ করেন নি।
.
এই পর্যন্ত লিখে আমি থমকে গেলাম। অন্যদের মতো আমিও কি মানুষটাকে গ্ল্যামারাইজড করার চেষ্টা করছি না? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো বন্ধু নেই। একজন কাউকে পান নি বই উৎসর্গ করার জন্যে, এটা তো তার ব্যর্থতা। কোনো অর্জন না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়াশোনা বাদ দিয়ে সাহিত্যে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন।–এই বাক্যটাতেও তাঁকে বড় করার প্রচ্ছন্ন চেষ্টা থাকে। মূল ঘটনা সেরকম না। তিনি দুবার B.Sc. পরীক্ষা দিয়ে ফেল করার পরই তাঁর ডাক্তার ভাই পড়াশোনার খরচ দেয়া বন্ধ করেন। বাধ্য হয়েই তাঁকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়।
তাঁর কঠিন মৃগী রোগের চিকিৎসায় সেই সময়কার সবচেয়ে বড় চিকিৎসক এগিয়ে এসেছিলেন–ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়। তিনি তখন শুরু করেন মদ্যপান। এই সময় অতুল চন্দ্র সেনগুপ্তকে এক চিঠিতে লেখেন–
ডাক্তারের সব উপদেশ মেনে চলা বা সব অষুধ নিয়মিত খাওয়া সম্ভব হয় নি। কারণ অর্থাভাব এবং অতিরিক্ত খাটুনি। আজ এখন অষুধ খেয়ে ঘুমোলে কাল হাঁড়ি চড়বে না। খানিকটা এলকোহল গিললে কিছুক্ষণের জন্যে তাজা হয়ে হাতের কাজটা শেষ করতে পারব। এ অবস্থায় এলকোহলের আশ্রয় নেয়া ছাড়া গতি কি?
খোঁড়া যুক্তি। যারা মদ্যপান করেন তারা জানেন এই জিনিস কাউকে তাজা করে না। আচ্ছন্ন করে। বোধশক্তি নামিয়ে দেয়।
আমার খুবই কষ্ট লাগে যখন দেখি এতবড় একজন যুক্তিবাদী লেখক নিজের জীবনকে পরিচালিত করেছেন ভুল যুক্তিতে।
তাঁর শেষ সময়ের চিত্র শরৎচন্দ্রের চরিত্রের চিত্রের মতো। তাঁর নিজের লেখা চরিত্রের মতো না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তখন আশ্রয় নিয়েছেন বস্তিতে। তাঁকে জাপ্টে ধরেছে চরম দারিদ্র, মদ্যপানে চরম আসক্তি এবং চরম হতাশা। তাঁকে দেখতে গেলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অবস্থা দেখে তিনি গভীর বেদনায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে বললেন, এমন অবস্থা! আগে টেলিফোন করেন নি কেন? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী অস্ফুট গলায় বললেন, তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই।
১৯৫৬ সনের ডিসেম্বর মাসে বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র মারা। যান। তাঁর বয়স তখন মাত্র ৪৮।
যদ্যপি আমার গুরু শুড়ি বাড়ি যায়
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
এই লেখাটির জন্যে প্রতীক ও অবসর প্রকাশনার আলমগীর রহমান নানান বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
রসকষ
ছোটবেলায় একটা খেলা খেলতাম। এই খেলায় অতি দ্রুত একটি ছড়া আবৃত্তি করতে হতো–
রস
কষ
সিঙ্গাড়া
বুলবুলি
মস্তক
একটি শব্দের সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। ননসেন্স রাইম যেরকম হবার কথা সেরকম। শুধু প্রথম দুটি শব্দ সবসময় একসঙ্গে ব্যবহার করার রীতি আছে। যেমন, লোকটির রসকষ নেই। ব্যাপারটা এরকম যার রস থাকবে তার কষও থাকতে হবে। রসবোধের সঙ্গে কষবোধ।
আমরা রসিক মানুষ পছন্দ করি। শৈশবে দেখেছি গ্রাম্য মজলিশে ভাড়া করে রসিক মানুষ নিয়ে আসা হতো। তাদের কাজ হাসিতামাশা করে আসর জমিয়ে দেয়া। নেত্রকোনা অঞ্চলে এদের নাম আলাপি অর্থাৎ যিনি আলাপ করেন। শৈশবে আলাপিলের আলাপ শুনেছি। তাদের আলাপের বড় অংশ জুড়েই আদি রস। কাজেই শিশুদের জন্যে নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশের মেয়েরাও মনে হয় স্বামী হিসেবে রসিক পুরুষ পছন্দ করে। কী ধরনের স্বামী পছন্দ? প্রশ্নের জবাবে দেখি একটা সাধারণ উত্তর হলো, তাকে রসিক হতে হবে। রসবোধ থাকতে হবে।
আমার আড্ডার আড্ডাধারিরা সবাই রসিক। রসিকতা করেন এবং বুঝতেও পারেন। বাসায় আড্ডা চলছে আর কিছুক্ষণ পর পর হো হো হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে না তা কখনো হয় না। যারা নিয়মিত আড্ডায় আসেন না তারাও ভালো কোনো রসিকতা পেলে sms করে আমাকে পাঠিয়ে দেন।
সম্প্রতি এরকম একটি sms পেয়েছি। যিনি পাঠিয়েছেন তিনি গুরুগম্ভীর মানুষ। পরিচয় প্রকাশ করে তার গাম্ভীর্যে কালো স্পট ফেলার অর্থ হয় না বলেই নাম অপ্রকাশিত। রসিকতাটা বলা যাক।
ইন্ডিয়াতে গে সমাজ (সমকামী সমাজ) স্বীকৃতি পেয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দরজিদের ওপর। কেউ ট্রাউজার বানাতে গেলে দরজি বলছে, স্যার জিপার কি শুধু সামনে হবে? নাকি পেছনেও হবে?