এইবার মাকে নিয়ে আমার রসিকতার গল্প। বাবার পোস্টিং তখন কুমিল্লায়। পুলিশের ডিএসপি। আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। ছুটিতে কুমিল্লায় গিয়ে দেখি মা মুরগি পুষছেন। তিনটা মুরগি। মুরগি ডিম পাড়বে। ঐ ডিম খাওয়া হবে। প্রতিদিন সকালে মা খাঁচা খুলে আগ্রহ নিয়ে দেখেন মুরগি ডিম পাড়ল কি না। প্রতিদিন তাকে হতাশ হতে হয়। আমি গোপনে ডিম কিনে এনে রাতে খাঁচায় রেখে দিলাম। সকালে ঘুম ভাঙল মার আনন্দ চিৎকারে। তিনটা মুরলি একসঙ্গে ডিম দিয়েছে। এরপর থেকে প্রতিদিনই খাঁচায় তিনটা করে ডিম পাওয়া যেতে লসগল। সবাই খুশি। একদিন মার আনন্দ-ধ্বনি শোনা গেল না। অথচ আমি রাতে তিনটা ডিমই রেখেছি। তিনি ডিম হাতে আমার কাছে এসে বললেন, এইসব কী! মার সঙ্গে ফাজলামি?
আমি বললাম, কী করেছি?
মা বললেন, এই তিনটা তো হাঁসের ডিম। মুরগি তো হাঁসের ডিম পাড়বে না।
আমি বললাম, মা ভুল হয়েছে। এরকম আর করব না।
মা এই ঘটনায় খুবই আহত হলেন। বাবার কাছে নালিশ করলেন। বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে যমের মতো ভয় পাই। ভয়ে অস্থির হয়ে তার কাছে গেলাম। বাবা বললেন, মুরগির ডিমের বদলে তুই হাঁসের ডিম কিনলি কী মনে করে?
আমি বললাম, মুরগির ডিমই চেয়েছি। ডিমওয়ালা হাঁসের ডিম দিয়েছে।
বাবা বললেন, সবচেয়ে ভালো হতো পচা ডিম রাখলে। তোর মা ডিম ভাঙত, বিকট গন্ধে বাড়ি ভরে যেত। তিনটা মুরগি একসঙ্গে পচা ডিম কেন পড়ল এই নিয়ে আমরা তখন গবেষণায় বসতাম।
পাঠক, আমার বাবার রসবোধ কি ধরতে পারছেন?
মানুষ যেমন রসিকতা করে প্রকৃতিও কিন্তু করে। সেই রকম একটা গল্প বলি। মার প্রতি প্রকৃতির রসিকতা।
মা তখন খুবই অসুস্থ। কিডনি প্রায় অকেজো। বিছানায় বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়েন। ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না। একদিন হঠাৎ অচেতন হয়ে গেলেন।
অ্যাম্বুলেন্স এনে তাঁকে ল্যাব এইড হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। তাকে CCU-তে রাখা হলো। ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর রোগী। তার জ্ঞান ফিরল রাত তিনটায়। তিনি দেখলেন, সবুজ পর্দা ঘেরা একটা ঘরে তিনি শুয়ে আছেন। আরামদায়ক আবহাওয়া। তাঁর সামনে সবুজ পোশাক পরা দুটি রূপবতী (এবং বেঁটে) তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। [এরা নার্স। মার খোঁজ নিতে এসেছিল।]
মার ধারণা হলো তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুর পর তার বেহশত নসিব হয়েছে। কারণ বেহেশত সবুজ, এই খবর তিনি জানেন। মেয়ে দুটি যে হুর এটাও বুঝা যাচ্ছে। নিশ্চিত হবার জন্যে তিনি হুরদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি বেহেশত?
হুর দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে রোগীকে সন্তুষ্ট করার জন্যে বলল, জি খালাম্মা।
মা বললেন, তোমরা আমাকে বেহেশতের আঙ্গুর এনে দাও তো। খেয়ে দেখি কী অবস্থা।
হুর দুজন আঙ্গুর নিয়ে এলে কী হতো আমি জানি না। তার আগেই ডিউটি ভাক্তার ঢুকলেন এবং বললেন, খালাম্মার জ্ঞান ফিরেছে। আপনার ছেলেমেয়েরা সবাই বাইরে আছে। ডেকে দেই কথা বলেন।
এই ঘটনার পর একদিন মাকে বললাম, আপনার কি খুব বেহেশতে যাবার ইচ্ছা?
মা বললেন, হ্যাঁ।
আমি বললাম, আপনি তো লোভী মহিলা না। বেহেশতের লোভ কেন করছেন?
মা বললেন, বেহেশতে না পেলে তার বাবার সঙ্গে তো দেখা হবে না। তোর বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই বেহেশতে যেতে চাই।
আমি বললাম, প্রথম দেখাতে তাঁকে কী বলবেন?
বলব, ছয়টা ছেলেমেয়ে আমার ঘাড়ে ফেলে তুমি চলে গিয়েছিলে। আমি দায়িত্ব পালন করেছি। এদের পড়াশোনা করিয়েছি। বিয়ে দিয়েছি। এখন তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করবে। বেহেশতের সুন্দর সুন্দর জায়গুলি আমাকে দেখাবে। শুধু আমরা দুজন ঘুরব। তুমি তোমার সঙ্গের হুরগুলিকে বিদায় কর।
মৃত্যু একটি ভয়াবহ ব্যাপার। যখন মাকে দেখি সেই ভয়াবহ ব্যাপারটির জন্যে তিনি আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছেন, তখন অবাক লাগে।
যদ্যপি আমার গুরু
অল্প কিছুদিনের মধ্যে কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর নানান পত্রিকায় বেশ কিছু লেখা পড়েছি। উনার জন্মশতবার্ষিকী এক বছর আগেই শেষ হয়েছে। তার পরেও একটি পত্রিকা ঘটা করে জন্মশতবার্ষিকী পালন করল। তাতে আমি কোনো সমস্যা দেখি না। একজন বড় লেখককে সম্মান দেখানো হচ্ছে, এটাই বড় কথা। আমাদেরমধ্যে সম্মান করা এবং অসম্মান করার দুটি প্রবণতাই প্রবলভাবে আছে। কাউকে পায়ের নিচে চেপে ধরতে লামাদের ভালো লাগে, আবার মাথায়। নিয়ে নাচানাচি করত্রে এ ভালো লাগে।
একটা সময় স্বয়ং রবীন্দ্রনাগকে নানান অসম্মানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। তাকে বাকবাকুম কবি বলা হয়েচ্ছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এমএ পরীক্ষায় তাঁর রচনার অংশবিশেষ তুলে ধরে বলা হয়েছে–শুদ্ধ বাংলায় লিখ।
ভাগ্যিস উনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বাঙালিকে তিনি মাথায় তোলার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিশেষ্য বক্তৃতামালা দেবার আমন্ত্রণ জানিয়ে ধন্য হয়েছে।
পশ্চিমা দেশেও (যাদের আমরা সভ্য বলে আনন্দ পাই) এক প্রবণতা আছে। তরুণ আইনস্টাইন চাকরি চেয়ে নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আবেদনের জবাব পর্যন্ত দেয় নি। আইনস্টাইন অতি বিখ্যাত হবার পর তাঁর চাকরির আবেদনগুলি বাঁধিয়ে অহঙ্কারের সঙ্গে প্রদর্শিত হচ্ছে। অহঙ্কারের বিষয় হলো, আইনস্টাইনের মতো লোক এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির আবেদন করেছিলেন।