আমি বললাম, কারণটা কী?
সে বলল, জীবনের একটা পর্যায়ে আমরা চরম দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছি। এখন আপনার বই পড়ে আমরা শক্তি ও সাহস পেয়েছি।
আমার বইয়ের যে শক্তি এবং সাহস দেয়ার ক্ষমতা আছে এই তথ্য জানতান। না। আমি বললাম, আমি নুহাশপল্লীতে যাচ্ছি। চল আমার সঙ্গে সারাদিন থাকবে।
সে সারাদিন থাকল। সন্ধ্যাবেলা বলল, স্যার, আমি বাকি টাকা আপনার পাশে থাকতে চাই। নানানভাবে আপনার সেবা করতে চাই। আপনার কাজকর্ম খানিকটা হলেও সহজ করতে চাই। সুইডেনে আমার গাড়ি আছে। আমি ভালো গাড়ি চালাই। আপনি ড্রাইভার বিদায় করে দিন। আপনার গাড়ি আমি চালাব।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, এ হলো বিদেশী আপদ। এর হাত থেকে অতিদ্রুত মুক্তি না পেলে সমস্যা আছে। আমি বললাম, আমি আমার নাটক এবং ছবির কাজে টেকনিক্যাল লোকের সাহায্য নেই। ক্যামেরাম্যান, এডিটর এইসব। সেই যোগ্যতা তোমার নেই। যদি কোনোদিন যোগ্যতা হয় তখন দেখা যাবে। এখন বিদায়।
তিন বছর পর (চার বছরও হতে পারে) এই যুবক আবার উপস্থিত। আমাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে হাসিমুখে বলল, স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন?
আমি বললাম, না।
আমার নাম মাসুদ আখন্দ। এখন চিনেছেন?
না।
যুবক আহত পুলায় বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে বাকি জীবন থাকার জন্য আমি টেকনিকাল কাজ শিখেছি। সুইডিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে এডিটিং, স্পেশাল এফেক্ট এবং ডিরেকশনে ডিগ্রি নিয়েছি।
আমি মনে মনে বললাম, খাইছে আমারে! প্রকাশ্যে বললাম, এখন তোমাকে চিনেছি। তোমার সরকারি চাকরির কী হলো?
চাকরি ছেড়ে দিয়েছি স্যার।
বাকি জীবন বাংলাদেশে থাকবে?
অবশ্যই। বাংলাদেশে থাকব এবং আপনাকে সাহায্য করব।
তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে বাংলাদেশে আসতে রাজি হবে?
স্ত্রী রাজি না হলে ডিভোর্স দিয়ে চলে আসব।
.
মাসুদ আখন্দ তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে এখন বাংলাদেশে আছে। তার স্ত্রীর ধারণা হুমায়ুন আহমেদ নামক লেখকের কারণে তাদের সুখের সংসার ভেঙে গেছে।
মাসুদকে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করি নি। তাকে বলেছি নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে। যেদিন আমার সত্যিকারভাবেই তাকে প্রয়োজন পড়বে সেদিন ডাকব। যখন পুরোপুরি চুলৎশক্তিহীন হব তখন আমাকে বিছানা থেকে বাথরুম নেয়া-আনার পবিত্র দায়িত্ব সে পাবে। এই মহান দায়িত্ব অন্য কাউকেই দেয়া হবে না।
মাসুদ আখন্দ বিপুল উৎসাহে বাংলাদেশে তার কার্যক্রম শুরু করেছে। Fishbone Films নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছে, সেখানে ভিডিও নাটক এবং ফিল্লা তৈরি হবে। একটি নাটক (উড়াল ফানুস) সে তৈরি ও করেছে। নাটকটা আমাকে দেখানোর মাতো উন্নতমানের হয় নি বলে আমাকে দেখাচ্ছে না। অন্যদের দেখিয়ে বেড়াচ্ছে।
আমার শুভ কামনা তার প্রতি এবং তার প্রতিষ্ঠানের প্রতি। প্রার্থনা করি একদিন তার প্রতিষ্ঠান নুহাশ চলচ্চিত্রকে ছাড়িয়ে অনেক দূর যাবে। পরাজয় অতি দুঃখজনক ঘটনা। শুধু ছাত্র এবং পুত্রের কাছে পরাজয় গৌরবময়।
মাসুদ আখন্দ নামক কঠিন আপদকে আমি ছাত্র এবং পুত্রের মতোই দেখি। পরম করুণাময়ের করুণা তার ওপর শ্রাবণধারার মতো বর্ষিত হোক। এই শুভ কামনা।
বোথাম সাহেবের বই
আমি যখন ফাইভ-সিক্সে পড়ি তখন বাজারে প্রথম কোকাকোলা, ফান্টা আসা শুরু হলো। তারপর এল 7up। এর আগে সোডা ওয়াটার পাওয়া যেত। বোতলের মুখ মার্বেল দিয়ে বন্ধ থাকত। বোতল ভালোমতো ঝাঁকালে কার্বন ডাই অক্সাইডের চাপে বন্দুকের গুলির মত মার্বেল ছুটে যেত। বড়ই মজার খেলা।
যাই হোক, প্রথমদিন 7up খেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। এর নাম সেভেন আপ কেন? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। কারণটা কী? শৈশবে কৌতূহল সহজে যায় না। যাকে পাই তাকেই জিজ্ঞেস করি। কেউ বলতে পারে না। ওপরের ক্লাসের এক বড় ভাই বললেন, এটা খেলে সাতবার ঢেঁকুর ওঠে। কাজেই সেভেন আপ নাম। এরপর থেকে পয়সা জমাতে পারলেই সেভেন আপ কিনি। খেয়ে ঢেঁকুর ওঠে। তিনটা, বড়জোর চারটা ঢেঁকুর ওঠে। এর বেশি না।
কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই সেভেন আপ নামকরণের তাৎপর্য জানতে পেরেছি। পাঠকদের জানাচ্ছি। এই জ্ঞানে তাদের কোনো উপকার হবার কথা না। তারপরেও জানা রইল।
সাত এসেছে সাত আউন্স থেকে। প্রথম যে 7Up-এর বোতল ছাড়া হয়েছিল তাতে সাত আউন্স পানীয় ধরত। Up হলো বুদবুদ কোন দিকে উঠবে তার নির্দেশনা।
শৈশবের একটি কৌতুহল মিটল জীবনের শেষ দিকে। আমার কাছে ব্যাপারটা গুরুরুপূর্ণ। আমরা অসংখ্য অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বড় হই। একসময় অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে কবরে চলে যাই।
সম্প্রতি আমার হাতে দুটা বই এসেছে। একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর, লেখক আইজাক অ্যাসিমভ। নাম Book of Facts। অন্যটির নাম The Book of Useless Information। লেখক নোয়েল বোথাম। দুটি বইতেই মজার মজার সব তথ্য।
উদাহরণ দেই। জীবন্ত কবর দিয়ে দেওয়া হবে এই ধরনের ভীতি নাকি কিছু মানুষের মধ্যে কাজ করে। এই ভীতির নাম Taphephobia। এই ভীতির কথা আমি প্রথম আমার মার কাছে শুনলাম। তিনি এক সন্ধ্যায় মাগরেবের নামাজের পর আমাকে ডেকে বললেন, প্রায়ই একটা কথা ভেবে আমার খুবই ভয় লাগে।
আমি বললাম, কী নিয়ে ভয় লাগে?
মা বললেন, তোরা যদি আমাকে মৃত মনে করে জীবন্ত কবর দিয়ে ফেলিস। হঠাৎ অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরল। তখন আমি করব কী? এরকম ঘটনা যে ঘটে না, তা তো না। ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছে তখন হঠাৎ ডেডবডি নড়ে উঠল।