আমি চোখ বন্ধ করলাম। কোনো সুন্দর দৃশ্যের কল্পনা করা যায় কি না তার চেষ্টা। জোছনাস্নাত অপূর্ব কোনো রজনীর স্মৃতি। কিংবা শ্রাবণের ক্লান্তিবিহীন বৃষ্টির দিনের স্মৃতি। কিছুই মাথায় আসছে না। চোখ মেললাম এনেসথেসিস্টের কথায়। এনেসথেসিস্ট বললেন (তিনি একজন মহিলা), তুমি ভয় পাচ্ছি?
আমি বললাম, না।
আশ্চর্যের কথা, আসলেই ভয় পাচ্ছিলাম না। কেন ভয় পাচ্ছি না তাও বুঝাতে পারছি না। পরে শুনেছি ভয় কমানোর একটা ইনজেকশন না-কি তারা দেয়।
অজ্ঞান করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শরীর হালকা হতে শুরু করেছে। অস্পষ্টভাবে কোনো একটা বাদ্যযন্ত্রের বাজনা কানে আসছে। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে কেউ বাদ্যযন্ত্র বাজাবে না। তাহলে কে বাজাচ্ছে?
আড্ডা
চলন্তিকা ডিকশনারিতে আড্ডার অর্থ দেয়া হয়েছে—কুলোকের মিলনস্থান। আমার ‘দখিন হাওয়া’র বাসায় প্রায়ই আড্ডা বসে। অর্থাৎ কিছু কুলোক একত্রিত হন। আড্ডার প্রধান ব্যক্তিকে বলে আড্ডাধারী। আমি সেই জন। বাকিদের পরিচয় দিচ্ছি।
শাওন। (তার বাড়িতেই আড্ডা বসছে, সে যাবে কোথায়?)
আলমগীর রহমান। (অবসর এবং প্রতীক প্রকাশনীর মালিক। আমার নিচতলায় থাকেন।)
আর্কিটেক্ট করিম। (তিনি আপে দখিন হাওয়াতেই থাকতেন, এখন বিতাড়িত।)
মাজহারুল ইসলাম। (অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক-প্রকাশক, অন্যপ্রকাশ এবং অন্যমেলার স্বত্বাধিকারী। আমার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন।)
কমল বাবু। (নাম কমল বাবু হলেও ইনি মুসলমান। মাজহারুল ইসলামের পার্টনার। শখের অভিনেতা। যে কটি নাটকে উপস্থিত তার প্রতিটি ডায়লগ মুখস্থ। কবিতা আবৃতির মতো তিনি ডায়লগ বলে আনন্দ পান।)
এঁরা আড্ডার স্থায়ী পাখি। সবসময় থাকেন। বেশ কিছু অতিথি পাখিও আছেন। এঁরা হঠাৎ হঠাৎ আসেন। যেমন চ্যালেঞ্জার, মাসুদ আখন্দ।
কিছু আছেন নিমন্ত্রিত পাখি। নিমন্ত্রণ করলে এরা আসেন। অনিমন্ত্রিতভাবে কখনোই উপস্থিত হন না। যেমন, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শফি আহমেদ, আর্কিটের রবিউল হুসাইন…
প্রয়োজনের পাখিও আছে। তাঁদের উপস্থিত দেখলেই বুঝা যায় কোনোকিছুর প্রয়োজন হয়েছে। যেমন, অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর।
আমাদের এই আড্ডার একটি নামও আছে। Old Fools’ Club, বৃদ্ধ বোকা সংঘ। ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আড্ডার নাম বুধসন্ধ্যা। তাঁরা প্রতি বুধবার বসেন। প্রধানত সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা হয়। রচনা পাঠ করা হয়।
আমাদের এখানেও রচনা পাঠ করা হয়। আমার একার রচনা। বৃদ্ধ বোকা সংঘে আমি ছাড়া লেখক কেউ নেই। তবে অত্যন্ত সুখের বিষয়, সাহিত্য নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তুবতা, কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র রচনায় কোনো কৃষক চরিত্র নেই কেন–এ নিয়ে কোনো আলোচনায় কেউ যায় না। তাহলে আমরা কী করি?
শুরুর কিছুক্ষণ আমরা ঝিম ধরে থাকি। যাদের মোবাইল আছে, তারা মোবাইল টিপাটিপি করে। আলমগীর রহমান ঘনঘন হাই তোলেন এবং বলেন, শরীর ভালো লাগছে না। আজ যাই। মুখে বলে, কিন্তু উঠেন না। কেউ তাকে থাকার জন্যে সাধাসাধিও করে না।
বাকি সদস্যরাও আলোচনা শুরুর বিষয় পান না। তারাও উসখুস করেন। তখন আড্ডাধারী হিসেবে আমার দায়িত্ব পড়ে আসর জমানোর। আমি নৌকার পাল তুলে দেই। জানি পাল তুললেই নৌকা চলা শুরু করবে। রাজনীতির কোনো প্রসঙ্গ তুলি। সবাই লুফে দেয়। তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায়। বাঙালিরা হলো নাচুনি বুড়ি। আর রাজনীতি ঢোলের বাদ্য।
উদাহরণ দেই। আমি বললাম, আওয়ামী লীগের ডিজিটাল মন্ত্রীসভায় কিছু মন্ত্রী থাকা উচিত, যাদের কোনো দপ্তর থাকবে না। তাদের একটাই কাজ। তারা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে শুধু টকশো করবেন।
করিম বলল, তাদের গাড়িতে কি ফ্ল্যাগ থাকবে?
আলমগীর বলল, অবশ্যই থাকবে। ডাবল ফ্ল্যাগ থাকবে। একটা আমাদের জাতীয় পতাকা, আরেকটা যে টিভি স্টেশনে টকশোতে অংশ নিতে যাচ্ছেন তাদের মনোগ্রামখচিত পতাকা।
কমল বলল, আর কিছু মন্ত্রী থাকবেন যারা শুধু সংবাদ সম্মেলন করবেন। আর কিছু না। তাদের টাইটেল, চিৎকারক মন্ত্রী।
আলোচনা জমে ওঠে। একটা পর্যায়ে শাওন হতাশ এবং দুঃখিত গলায় বলে, তোমাদের এই রাজনৈতিক আলাপটা কি বন্ধ করবে? এই আলোচনার কোনো ফলাফল কি আছে?
সমস্যা হচ্ছে আড্ডার কোনো আলোচনারই কোনো ফলাফল নেই। শুধু আড্ডা কেন, গোটা বাংলাদেশেরই আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক, চারকোনা টেবিল বৈঠক, চলমান গাড়ি বৈঠক সবই ফলাফল শূন্য। আনক্সা সবাই শূন্য আমাদের এই শূন্য রাজত্বে।
আড্ডায় মাঝে মাঝে গানের আসর বসে। শাওনের মুড ভালো থাকলে একের পর এক গান করতে থাকে। আবার অতিথি পাখি সাব-ইন্সপেক্টর টুটুল (এস আই টুটুল) যখন আসে তখনো গান হয়। তবে সে এই আড্ডায় কখনো হুমায়ুন আহমেদের লেখা গান ছাড়া অন্য কোনো গান করে না। আবার শুনেছি যখন সে অন্য কোনো আড্ডায় যায়, তখন হুমায়ুন আহমেদকে ভাসুরের মতো দেখে। তার গান দূরে থাকুক, নামও উচ্চারণ করে না। হুমায়ূন আহমেদ বিষয়ক পরচর্চায়ও না-কি অনিচ্ছায় অংশগ্রহণ করে।
টুটুল শুধু যে গান চমৎকার করে তা-না। আড্ডাবাজ হিসেবেও সে অসাধারণ। তার মতো সুন্দর করে গল্প আর একজনই শুধু করতে পারে, তার নাম জাহিদ হাসান। আমাদের আড্ডায় সে অতিথি পাখি ক্যাটাগরিতে পড়ে। আরেকজন অতিথি পাখির নাম জুয়েল আইচ। আগে যখন ধানমণ্ডিতে থাকতেন, তখন প্রায়ই আসতেন। এখন প্রায় ভিসা নেবার দূরত্বে চলে গেছেন বলে তার ক্যাটাগরি অতিথি পাখি থেকে বদলে হয়েছে নাই পাখি। তিনিও সুন্দর কথা বলেন এবং কথা বলতে পছন্দ করেন। তবে ইদানীং কথা বলায় তাঁর কিছু সমস্যা যাচ্ছে বলে আড্ডায় ঠিকমত অংশ নিতে পারছেন না।