না।
রানিদের গল্প? শেখ হাসিনা, খালেদা?
না।
ভূত-প্রেত রাক্ষস-খোক্কস?
না।
তাহলে কিসের গল্প শুনবে?
এসির গল্প।
এসি নামক যন্ত্রটি তার মাথায় কীভাবে ঢুকে গেছে আমি জানি না। একটা কারণ হতে পারে গরমে যখন কষ্ট পায় তখন এসির ঠাণ্ডা বাতাসে আরাম পায়। দ্বিতীয় কারণ, চারকোনা একটা বড় বোতাম টিপলেই হিম হাওয়া দেয় এই রহস্য।
যাই হোক, আমি এসির গল্প বলার প্রস্তুতি নিলাম। গল্প বানানো তো আমার জন্যে তেমন কঠিন না (চল্লিশ বছরের অভ্যাস)। কিন্তু পড়লাম মহাবিপদে। এসি নিয়ে কী গল্প বলব! বাবা এসি, মা এসি এবং তাদের শিশুসন্তান এসির মানবিক গল্প? সেটা তো বিশ্বাসযোগ্য হবে না। যে-কোনো গল্পকেই বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। আমি শুরু করলাম, একদেশে ছিল একটা এসি।
নিষাদ বলল, আর ছিল একটা এসি রিমোট।
আমি বললাম, গল্পের মাঝখানে কথা বলবে না বাবা। গল্পের মাঝখানে কথা বললে গল্প বন্ধ হয়ে যায়।… একদিন কী হলো শোনো। এসিটা বলল, মানুষকে ঠান্ডা বাতাস দিতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমার শরীর গরম হয়ে যায়। তখন জ্বর আসে। আমি সারারাত মানুষকে ঠান্ডা বাতাস দেই। আর সারারাত আমার গা এত গরম হয়ে থাকে। এত জ্বর আসে।
হঠাৎ তাকিয়ে দেখি এসির প্রতি মমতায় আমার পুত্রের ঠোঁট ভারী হয়ে এসেছে। সে বলল, বাবা, এসি বন্ধ করে দাও, আমার ঠান্ডা লাগবে না।
এই ঘটনা আমি কীভাবে দেখব? গল্প সৃষ্টির ক্ষমতা হিসেবে, না-কি দু বছর বয়সী শিশুর বিশুদ্ধ আবেগ হিসেবে? লেখক হিসেবে আত্মশ্লাঘা অনুভব করার জন্যে আমি প্রথমটা নিলাম।
আমার বড় পুত্র নুহাশের কাছ থেকেও আমি আত্মশ্লাঘা অনুভব করার মতো উপকরণ একবার পেয়েছিলাম। তার বয়স তখন বারো। সে আমাকে বলল, বাবা, আমি তোমার কোনো বই যখন পড়ি তখন বাথরুমে বসে পড়ি।
আমি বললাম, বাথরুমে বসে পড়তে হবে কেন বাবা?
তোমার বই পড়তে গেলে কিছুক্ষণ পর পর চোখে পানি আসে। সবার সামনে কাঁদতে ভালো লাগে না। এই জন্যে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে পড়ি।
পুত্র নিষাদের কাছে ফিরে যাই। তার গল্প দিয়ে নিষাদনামার ইতি টানি।
নিষাদ খুব গানভক্ত। তার অতিরিক্ত সঙ্গীতপ্রীতি আমার মধ্যে সামান্য হলেও টেনশন তৈরি করে। কারণ গানের প্রতি অস্বাভাবিক দুর্বলতা অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।
নিষাদের পানপাগল হবার অনেকগুলি কারণ অবশ্যি আছে। তার মা শাওন গায়িকা। তার নানি তহুরা আলিও বেতার এবং টিভির তালিকাভুক্ত একজন সঙ্গীত শিল্পী। তার বড় মা (শাওনের নানিজান) একজন গায়িকা।
নিষাদের বাবা গায়ক না, গলায় কোনো সুর নেই, কিন্তু গানপাগল। তার দাদার গলাতেও সুর ছিল না, তিনিও ছিলেন গানের মহাপাগল। তার বড়দাদা (আমার দাদা) মাওলানা মানুষ ছিলেন। বাড়িতে গানবাজনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। তিনি একদিন আমার ছোটবোন শেফুর গাওয়া তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে ঘোষণা করলেন বাড়িতে ইসলামি গান চলতে পারে। শেফুকে পর পর তিনবার একবৈঠকে গান শোনাতে হলো এবং দাদাজান কয়েকবার আহা আহা করলেন।
নিষাদ যেহেতু এই ঘরানার, গানের প্রতি তার মমতা হওয়াটাই স্বাভাবিক। মায়ের সব গান এবং মনপুরা ছবির সব গান তার মুখস্থ।
এক দুপুরের কথা। লেখার টেবিলে বসেছি। মাতাল হাওয়া উপন্যাস লিখছি। জটিল অংশে আছি। এই অবস্থায় হাতি দিয়ে টেনেও টেবিল থেকে আমাকে নড়ানো সম্ভব না। পুত্র নিষাদ এসে তার কোমল হাতে আমাকে ধরে বলল, বাবা আসো।
আমি বললাম, কোখায় যাব?
নিষাদ বলল, ছাদে। ঝড় হবে। তুমি ঝড় দেখবে।
আমি ঝড় দেখতে গেলাম। বৈশাখ মাসের দুপুর হঠাৎ করেই মেঘে মেঘে অন্ধকার। আকাশে এমন ঘন কালো মেঘ দেখেই রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রথম ভাব সমাধি হয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে আকাশের ঘন কালো মেঘ দেখছি। হঠাৎ বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করল। আর তখন আমাকে ভয়ঙ্করভাবে চমকে দিয়ে পুত্র নিষাদ গাইল—
আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে।
এই গানটি তার মা গিয়েছে। নয় নম্বর বিপদ সংকেত ছবিতেও ব্যবহার করেছি। ছবিতে তানিয়া প্রচণ্ড ঝড় বাদলায় নাচতে নাচতে গানটি করছিল। এই গান পুত্র নিষাদ মুখস্থ করে রাখবে, এটাই স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো, গানটা ঝড় বাদলায় গীত হতে হবে এই বোধ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শতবর্ষ পরে তাঁর রচনা পঠিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। শত বছরেরও পরে দুবছরের একটি শিশু তাঁর গান করবে, এটি কি কখনো ভেবেছিলেন? আমার হঠাৎ মনে হলো, রবীন্দ্রনাথ এই দৃশ্যটি দেখছেন। এবং নিজের কবিতা থেকেই বলছেন, আমারে তুমি অশেষ করে একি এ লীলা তব!
নুহাশ পল্লীতে হিমু উৎসব
কাউকে মুখের ওপর না বলা আমার স্বভাবে নেই। না বলতে না-পারার অক্ষমতার খেসারত আমাকে নানানভাবে দিতে হয়। যেমন—
ক) চিনি না জানি না তরুণীর বিয়েতে উকিল বাবা।
খ) অপরিচিত্র শিশুর খৎনা অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি।
গ) নতুন লেখকের অখাদ্য উপন্যাসের ভূমিকায় লেখা– তরুণ ঔপন্যাসিকের গল্প বলার মুন্সিআনায় আমি বিস্মিত।
না বলতে না-পারার জটিল ব্যাধিতে যিনি আক্রান্ত তাকে দিয়ে ঢেঁকি বা রাইসমিল গেলানো তেমন কঠিন কর্ম না। কাজেই এক দুপুরে আমি দেখলাম যে নুহাশ পল্লীর হিমু উৎসব নামক রাইসমিল আমি গিলে বসে আছি।