অনেক দিন পর দেখা হলে কিছু সামাজিক কথাবার্তার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যেমন, কেমন আছেন? কবে এসেছেন? শরীর কেমন? বৌদি কেমন? ইত্যাদি।
সুনীল সেইদিকে গেলেন না। রোজিই আমাদের দেখা হচ্ছে এই ভঙ্গিতে বললেন, কাল রাতে কী করেছি শোন। হোটেলের জানালা খুলে মুখ বের করে সিগারেট খেয়ে ফেলেছি। এরা আবার হোটেলের রুমে নোটিশ টানিয়েছে। রুম সিগারেটের গন্ধ পাওয়া গেলে দুশ ডলার জরিমানা। তোমার বৌদি চিন্তায় আছে।
আমার প্রিয় এবং পছন্দের মানুষটিকে নিয়ে কিছু গল্প করি। গল্পগুলিই হচ্ছে তার জন্যে আমার দিক থেকে জন্মদিনের উপহার।
গল্পঃ এক
আমার বড় মেয়ে নোভার বিয়ে। তখন আমি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা বাস করি দখিন হাওয়ার একটা ফ্ল্যাটে। খুব ইচ্ছা মেয়ের বিয়েতে পুরোপুরি যুক্ত হওয়া। তা পারছি না। আমি ঠিক করলাম, এমন একটা উপহার তাকে দেব যে উপহার কোনো মেয়েকে তার বাবা দেন নি। যেন আমার মেয়ে তার সন্তানদের এই উপহারের কথা আগ্রহ করে বলে। আমার বড় মেয়ের অতি পছন্দের লেখকের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বিয়ের আসরে তাঁকে কি উপস্থিত করা যায়? আমি তাঁকে দেখিয়ে নোভাকে বলতে পারি, বাবা! তোমার বিয়েতে এই আমার উপহার। বাংলা সাহিত্যের একজন গ্র্যান্ডমাস্টারের বিয়ের আসরে উপস্থিতি। তাঁর আশীর্বাদ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ঘটনাটা জানানো হলো। তিনি সব কাজ ফেলে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় এসে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন।
আমার হতভম্ব মেয়ে চোখে রাজ্যের বিস্ময় এবং আনন্দ নিয়ে লেখকের পা স্পর্শ করল। এই পবিত্র দৃশ্য আমৃত্যু আমার মনে থাকবে।
গল্প : দুই
কলকাতায় একটি সাহিত্য অনুষ্ঠান। আয়োজক সেখানকার বাংলাদেশ মিশন। অনুষ্ঠানের সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে আমি আছি এবং একজন ঔপন্যাসিক আছেন– হার্ডকোর ঔপন্যাসিক। নাম বলতে চাচ্ছি না। ঐ ঔপন্যাসিক আমার অগ্রজ। আমাকে যথেষ্টই পছন্দ করেন। সেদিন তাঁর কিছু একটা সমস্যা সম্ভবত হয়েছিল। মঞ্চে উঠে সরাসরি আমাকে ইঙ্গিত করে কঠিন সব কথা বলে যেতে লাগলেন। তাঁর মূল কথা, আমি বস্তাপচা প্রেমের উপন্যাস লিখে সাহিত্যের বিরাট ক্ষতি করছি। বাণিজ্য সাহিত্য করছি। প্রেম ছাড়া যার লেখায় কিছুই নেই।
বিদেশ বিভূঁইয়ে এমন আক্রমণের জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। উত্তরে কিছুই বলতে ইচ্ছা করছিল না। চোখে পানি এসে যাবার মতো হলো। সবশেষে সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উঠলেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর বললেন, হুমায়ুন আহমেদকে এককভাবে যে আক্রমণ করা হয়েছে আমাকেও তার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। একজন লেখক প্রেম নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন কেন বুঝলাম না। পৃথিবীর সব সঙ্গীত, চিত্রকলা এবং সাহিত্যের মূল বিষয় প্রেম। যিনি এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করেন তিনি কি আসলেই লেখক?
অনুষ্ঠান শেষ হলো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, আজ গল্পপাঠের একটি আসর আছে। আমি একটি গল্প পড়ব, সমরেশ মজুমদার একটি গল্প পড়বেন। আপনি আসুন, আমার সঙ্গে আপনিও একটি গল্প পড়বেন। সব লেখকই জানেন তিনি কোন মাপের লেখক। আপনি আপনার বিষয়ে জানেন। এবং আমি নিজেও কিন্তু জানি। যার যা ইচ্ছা বলুক, আমরা গল্প তৈরি করে যাব।
অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহারের বাড়িতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গিয়েছেন। ফটোসেশন হচ্ছে। সুনীলভক্তরা একের পর এক ছবি তুলছে। মাজহারের কাজের ছেলেটির নাম আজাদ। সে আমার কানে কানে বলল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সে একটা ছবি তুলতে চায়। তবে সাধারণ ছবি না। তার ঘাড়ে হাত রেখে। আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলতেই তিনি বললেন, অবশ্যই ঘাড়ে হাত রেখে ছবি তুলবে। আজাদ হাসিমুখে এগিয়ে এল।
সুনীল বললেন, তুমি কি আমার কোনো বই পড়েছ?
আজাদ বলল, জি-না স্যার।
সুনীল বললেন, আমার ঘাড়ে হাত রেখে ছবি তোলার অধিকার তো তাহলে তোমার অনেক বেশি। এসো আমরা দুজন দুজনের ঘাড়ে হাত রাখি।
ছবি তোলা হলো।
.
আমার জন্য খুবই বিরক্তির একটি বিষয় হচ্ছে সাংবাদিকদের কাছে ইন্টারভিউ। পত্রিকা সম্পাদকরা তাদের স্টাফদের ভেতর থেকে মেধাশূন্য কাউকে খুঁজে বের করে আমার কাছে পাঠান। তারা চোখমুখ শক্ত করে ইনটারভু শুরু করে। কেন। এক ইন্টারভুর কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কারণ সেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে এসেছেন।
সাংবাদিক : সুনীলদার পূর্বপশ্চিম পড়েছেন?
আমিঃ পড়েছি।
সাংবাদিক : আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে সুনীলদা এত বড় কাজ করে ফেলেছেন। আপনি পারলেন না কেন?
আমি : উনি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেন নি বলে লেখাটা তাঁর জন্যে সহজ হয়েছে।
সাংবাদিকঃ না দেখলে লেখা সোজা?
আমি : অবশ্যই। মীর মশাররফ হোসেন কারবালার যুদ্ধ দেখেন নি বলে বিষাদসিন্ধু লিখে ফেলতে পেরেছেন।
সাংবাদিক : আপনার কিন্তু উচিত পূর্বপশ্চিমের মতো একটা উপন্যাস লেখা।
আমি : ভাবছি লিখব। নামও ঠিক করে ফেলেছি।
সাংবাদিক; কী নাম?
আমি : নামটা একটু বড়। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, উর্ধ্ব-অধ্ব। এই উপন্যাসে সবদিক ধরা হবে। ঠিক আছে?
ইন্টারভুর এই গল্পটি বলার আমার একটা উদ্দেশ্য আছে। পৃথিবীর খুব কম লেখকই সবদিক তাদের লেখায় তুলতে পেরেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের অজান্তেই তা পেরেছেন। এই ধরনের লেখকদের শুধু জন্মদিন থাকে। তাঁদের মৃত্যু হয় না বলে তাদের মৃত্যুদিন বলে কিছু থাকে না।