হিলটন খুবই নামিদামি হোটেল। কিন্তু হোটেলের বাইরে বেমানান সস্তা ধরলে বেঞ্চ পাতা। এই বেঞ্চে বসে বিরস মুখে সিগারেট টানছেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। পরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, কোনো মানে হয় হুমায়ুন! সিগারেট খাবার জন্যে প্রতিবার নয়তলা থেকে নেমে হোটেলের বাইরে আসতে হয়। সিগারেট যে পুরোপুরি খারাপ তাও তো না। এর কিছু ভালো দিকও আছে।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, ভালো দিক কী?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, সিগারেটে ৯৮টা দোষ। দুটা মাত্র গুণ। ভালো গুণ দুটি হলো যারা সিগারেট খায় তাদের আলজেমিয়ার্স হয় না। এবং বৃদ্ধ বয়সে তাদের হাড্ডি বেঁকে যায় না।
আমি বললাম, আপনার সঙ্গে শাওনের দেখা হলে এই দুটা ভালো গুণের কথা বলবেন, বিপদে আছি।
বঙ্গ সম্মেলনে আছেন তিন লেখক। সুনীল, সমরেশ, হুমায়ুন। সাহিত্যের জটিল সেমিনার। কঠিন সব প্রশ্ন। একেকটা প্রশ্নের জবাব দেই আর মনে মনে বলি, এইসব সেমিনারে আর আসবি? গাধা তোর শিক্ষা হয় না?
গোদের ওপর ক্যান্সারের মতো সিনেমা-সেমিনারেও আমাকে অংশগ্রহণ করতে হলো। কারণ আমার দুটা ছবি তারা দেখাচ্ছে, ক. আমার আছে জল। খ. চন্দ্রকথা।
আমার আছে জল আমি নিজেও দর্শকদের সঙ্গে বসে কিছুক্ষণ দেখলাম। একজন মহিলা দর্শকদের মন্তব্য উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি পাশের জনকে বললেন, দিদি! বাংলাদেশের এই পরিচালক কিন্তু পানি বলছেন। না। জল বলছেন। ছবির নাম আমার আছে জল। আমার আছে পানি নাম দেন। নি। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ গো। এমনটা দেখা যায় না।
এই জাতীয় সম্মেলনে ভিডিও ক্যামেরা হাতে কিছু সাংবাদিক থাকেন। তারা ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়ান। তাদের একজন আমার মুখের ওপর ক্যামেরা ধরে বললেন, দাদা, তসলিমার দেশে ফেরার ব্যাপারে কী করলেন?
আমি বললাম, ভাই দেশ তো আমি চালাচ্ছি না। আমি দেশ চালালে অবশ্যই তাকে দেশে ফিরতে বললাম। বাংলাদেশের মেয়ে কেন অন্য দেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করবে?
দাদা, এটা কি আপনি মন থেকে বলছেন?
আমি বললাম, লেখকরা মিথ্যা গল্প তৈরি করেন, সেটাকে ব্যালেন্স করার জন্যেই সবসময় সত্যি কথা বলতে হয়।
.
পাদটিকা
বঙ্গ সম্মেলনে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে একটা কবিতা সংকলন বের হয়েছে। সংকলনটির নাম লজ্জার এক বৎসর। সুন্দর সুন্দর কিছু কবিতা সেখানে আছে। বিশেষ করে কবি জয় গোস্বামীর কবিতাটা তো খুবই ভালো লাগল।
তসলিমা নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। ব্যাপারটা কষ্টের। দেশের মেয়ে কেন বাইরে থাকবে? তিনি ভুলভ্রান্তি যদি করে থাকেন তার ফয়সালা দেশেই হবে। বাংলাদেশে এমন কেউ কি আছে যে ভুলের উর্ধ্বে? দেশ মা তার সব সন্তানকে বুকে ধরে রাখতে চান। রাজনীতিবিদরা এই কথা কেন বুঝেন না?
জন্মদিনের উপহার
তাঁর বয়স ৭৫, তিনি অন্য দেশে বাস করেন। হঠাৎ হঠাৎ তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। এই মানুষটির জন্মদিন আমার বাসায় পালন করা হবে। মানুষটি উপস্থিত থাকবেন না। জন্মদিনের উৎসবের ব্যাপারটাও তিনি জানেন না।
জন্মদিন মানেই কেক এবং মোমবাতি। কেক আসবে হোটেল শেরাটন থেকে। তার দায়িত্ব নিয়েছে অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহার। জন্মদিনের গানটি গাইবে গায়িকা মেহের আফরোজ শাওন। কারণ যার জন্মদিন পালিত হবে তিনি শাওনের গান আগ্রহ করে শোনেন।
Happy birth day to you নামের বিখ্যাত গানটি এই উপলক্ষে বাংলায় করা হয়েছে। সুর ঠিক রেখে বাংলায় গানটি গীত হবে। গানটি এরকম—
আহা কী শুভ জনম তিথি!
আহা কী শুভ এ দিন!
বন্ধু তোমাকে ভালোবাসি মোরা
আজ ভালোবাসিবার দিন।
জন্মদিন আয়োজন করছে Old Fools Club, বৃদ্ধ বোকা সংঘ। অনেকেই হয়তো জানেন না, কিছু অতি কাছের বন্ধু নিয়ে আমার একটা ক্লাব আছে। এই ক্লাবের সদস্যরা প্রায়ই উদ্ভট কর্মকাণ্ড করেন। উদাহরণ—
ক্লাবের সব সদস্য সাধুসন্ন্যাসীর গেরুয়া পোশাক পরে এক রাতে ট্রেনে করে সিলেট রওনা হয়ে গেল। তারা যেখানেই যায় তাদের ঘিরে উৎসাহী এবং কৌতূহলী জনতা। সবাই জানতে চায়, ব্যাপারটা কী? আমরা কারো প্রশ্নেরই জবাব দেই না। সাধুসন্ন্যাসীদের মতো স্মিত হাসি।
আরেকটা উদাহরণ, ভাদ্র মাসে চারদিকে পানি থাকে বলে জোছনা হয় তীব্র। সেই জোছনা দেখা এবং চাঁদের আলোয় স্নান করার উৎসব হবে শালবনে। বৃদ্ধ বোকা সংঘের সব সদস্য উপস্থিত। আমরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছি। চন্দ্রদর্শন উৎসব শুরু হলো আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে গান দিয়ে। শাওন দরদ দিয়ে চোখ বন্ধ করে গান করছে, হঠাৎ চোখ খুলেই বলল, ও মাগো। রবীন্দ্রনাথ তার অতি বিখ্যাত গানে ও মাগো ব্যবহার করেন নি। আমরা চমকে তাকালাম এবং দেখলাম প্রকাণ্ড এক সাপ। চারদিকে হুটাহুটি ছোটাছুটি। চন্দ্রদর্শন উৎসব সর্পদর্শনে সমাপ্তি। বৃদ্ধ বোকা সংঘের এক সদস্য ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, হুমায়ুনের পাগলামির সঙ্গে আমি আর নাই। সাপটা আমার পায়ের ওপর দিয়ে গিয়েছে। আমি Old Fools’ Club থেকে পদত্যাগ করলাম।
আমার মনে হয় কার জন্মদিন পালিত হচ্ছে তা বলার সময় এসে গেছে। তাঁর নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
মাসখানেক আগেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। সেন হোজের (সানফ্রানসিসকে) হোটেল হিলটনের সামনে একটা বেঞ্চ পাতা। তিনি সেখানে একাকী বসে সিগারেট টানছেন। তিনি গেছেন বঙ্গ সম্মেলনে যোগ দিতে। আমিও গিয়েছি। এই সূত্রে দেখা। আমি তাঁর পাশে বসলাম।