ঘটনা সেরকম ঘটল না। সে একই উত্তর দিল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ ধরনের রঙ দেখার কারো ক্ষমতা আছে তা আমার চিন্তাতেও ছিল না।
তার মতো ক্ষমতা যে আরো কিছু মানুষের আছে জানলাম রাশিয়ান একটা পত্রিকা পড়ে। পত্রিকার নাম Sputnik। রিডার্স ডাইজেস্ট এর মতো পত্রিকা। সেখানে বিশাল এক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে যার বিষয় কিছু কিছু মানুষের শব্দের রঙ দেখার অস্বাভাবিক ক্ষমতা।
উন্মাদ অফিসে বসে আহসান হাবীব এখনো রঙ দেখে কি না জানি না। আমরা ভাইবোনরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। কেউ কারো খবর রাখি না। বাবা-মা ভাইবোনদের নিয়ে একসময় ভালোবাসার বৃত্তের মধ্যে একটা সংসার ছিল। সেই বৃত্ত ভেঙে গেছে। নতুন বৃত্ত তৈরি করে প্রত্যেকেই আলাদা সংসার করছি। আমাদের সবার ভুবনই আলাদা। এই ভুবনও একদিন ভাঙবে। আমরা অচেনা এক বৃত্তের দিকে যাত্রা শুরু করব। সেই বৃত্ত কেমন কে জানে! পৃথিবীতেই এত রহস্য। না জানি কত রহস্য অপেক্ষা করছে অদেখা ভুবনে।
একটি ভ্রমণ কাহিনী
নুহাশ পল্লী ছাড়া আর কোথাও যেতে আমার ভালো লাগে না। নতুন দেশ দেখা, নতুন জনপদ দেখা আমাকে আকর্ষণ করে না। নিজের দেশই দেখা হয় নি, অন্য দেশ কী দেখব?
মাঝে মাঝে অ্যান্টার্কটিকায় যেতে ইচ্ছা করে। জনমানবশূন্য ধুধু বরফের দেশ দেখতে ইচ্ছা করে। বরফের ঘর ইগলুতে একটা রাত কাটানো। রাতের আকাশে মরুপ্রভার খেলা দেখা।
সমস্যা হচ্ছে অ্যান্টার্কটিকায় বইমেলা হয় না। সেখানে লেখকদের সাহিত্য নিয়ে জটিল জ্ঞানের কথা বলার সুযোগ নেই।
এই সুযোগ আছে নর্থ আমেরিকায়। নিউইয়র্কের মুক্তধারার বিশ্বজিৎ প্রতিবছর বইমেলার আয়োজন করে। ফোবানা বলে বাংলাদেশের বাঙালিরা বৎসরের এক সময় একত্রিত হয়। অনুষ্ঠান শেষ হয় মারামারি এবং চেয়ার ছোড়াছুড়িতে। শুনেছি ফোবানা দুই ভাগে এখন বিভক্ত। আওয়ামী লীগ ফোবানা এবং বিএনপি ফোবানা। দেশের সংস্কৃতি বিদেশে আমরা নিতে পারি বা না-পারি, দেশের দলাদলি ঠিকই import করছি।
ভারতীয় বাঙালিরাও বৎসরে একবার সম্মেলন করেন। নাম বঙ্গ সম্মেলন। সেখানে তাঁরা বাংলাদেশেরর কিছু অতিথিকে নিমন্ত্রণ করেন।
আমার দুর্ভাগ্য যে প্রতিবছরই সবকটি সম্মেলন থেকে আমি নিমন্ত্রণ পাই। দুর্ভাগ্য বলছি, কারণ নিমন্ত্রণের কারণে আমাকে বেশ কিছু মিথ্যা বলতে হয়। যেমন, ভিসা পাই নি বলে যেতে পারছি না। (ভিসার জন্যে অ্যাপ্লাই-ই করি নি। ভিসা পাব কীভাবে?)
ডাক্তার বলেছে হার্টের অবস্থা ভালো না। এক মাসের জন্য কমপ্লিট বেড রেস্টের ব্যবস্থা দিয়েছেন।
ভার্টিগো সমস্যা হচ্ছে। প্লেনে উঠেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। বমি টমি করে একাকার।
এতকিছু করেও এ বছর শেষ রক্ষা হয় নি। আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে শুকনা মুখে প্লেনে উঠলাম। নিউইয়র্কে বিশ্বজিতের বইমেলা। সানফ্রানসিসকোতে বঙ্গ সম্মেলন। এইখানেই শেষ না, নিউজার্সিতে আরেক মেলা।
কেউ ভুলেও ভাববেন না ঐসব অনুষ্ঠানে লেখকদের নিয়ে বিরাট মাতামাতি হয়। ঝোঁকটা হকি নাচ-গানের দিকে। লেখকরা শোভা হিসেবে থাকেন। লেখকদের নানা বক্তৃতা শোনার জন্যে আগ্রহ থাকার কারণও অবশ্যি নেই।
বিশ্বজিতের বইমেলায় তিন লেখক হাসান আজিজুল হক, সমাবেশ মজুমদার এবং আমি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন হাসান ফেরদৌস। গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠান শুরু হলো। আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার দুবছর বয়েসী পুত্র মঞ্চে উঠে এসে ঝাঁপ দিয়ে আমার কোলে উঠে পড়ল। তার মার একক গানের অনুষ্ঠান আছে। সে সঙ্গীতযন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত। পুত্র নিষাদ এই সুযোগ গ্রহণ করেছে।
অনুষ্ঠান সঞ্চালকের কঠিন কঠিন প্রশ্নের জবাব আমি পুত্রকে কোলে নিয়ে দিচ্ছি। একই সঙ্গে পুত্র নিষাদের প্রশ্নের জবাবও দিতে হচ্ছে। তার প্রশ্নগুলি সহজ। যেমন, মা কোথায় গেল? তোমার ঠান্ডা লাগছে?
নিউইয়র্কে ঝামেলা শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই মেলায় আমার একটি প্রাপ্তিও ছিল। জীবনের প্রথম পুত্রকে কোলে নিয়ে স্টেজের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে তার মার গান শুনলাম। দর্শকদের অনুরোধে সে গাইল, যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়। গান শেষ করে শাওন জানতে চাইল, গানটি কার লেখা আপনারা কি জানেন?
শ্রোতাদের একজন বলল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। আমার পাশে বাচ্চাকোলে আরো এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি গলা নামিয়ে বললেন, এটা নজরুল গীতি। আমি যথেষ্ট আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম, কারণ এই গানটির গীতিকার আমার অতি পরিচিত। তার সাথে রোজই আমার দেখা হয়। ভদ্রলোক ভালো মানুষ টাইপ।
.
জায়গাটার নাম San Jone, উচ্চারণ সেন হোজে। ক্রিশ্চিয়ান সেইন্টের নামে নাম। বঙ্গ সম্মেলন হচ্ছে হোটেল হিলটনের কনভেনশন সেন্টারে। লোকে লোকারণ্যের মতো দাদায় দাদারণ্য। আমি কাউকে চিনি না। তারাও আমাকে চেনেন না। একজন এসে বললেন, নমস্কার। আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?
আমি বললাম, জি।
রুনাদির সনে এসেছেন?
আমি বললাম, শাওনদির সঙ্গে এসেছি।
তিনি বললেন, আপনি কি রুনাদির গানের সঙ্গে তবলা বাজাবেন?
আমি বললাম, আপনারা বললে অবশ্যই বাজাব। কিন্তু আমি তো তবলা বাজাতে পারি না।
দুজনই দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আমি তখনো বুঝতে পারি নি রুনাদি হচ্ছেন রুনা লায়লা।