তারপর যখন মাইকে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয় তখন প্রধান অতিথি শুকনো গলায় বললেন, এসব এরা কী বলছে? হোয়াট ডু দে মিন।
আমি তাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ততক্ষণে মাইকে উদাত্ত গলায় বলা হচ্ছে এবার আমাদের এই অনুষ্ঠানে প্রথম যিনি তার সর্বস্ব দিয়ে এক অনুপম আদর্শের সূচনা করবেন তিনি হচ্ছেন আমাদের অতি আদরের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট সাহিত্যবোদ্ধা অনলবর্ষী বক্তা, সমাজের বন্ধু, অভাজনের চোখের মণি…। প্রধান অতিথি কাঁপাগলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় বোধহয় নেই। আমি কোনো উত্তর দিলাম না। সাহিত্য বাসরের কর্মীরা কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঠেলাঠেলি। করে স্টেজে উঠিয়ে দিল। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হতে লাগল ওই মহামানব… ও… আসে। যেরকম আশা করা হয়েছিল সেরকম হলো না। বাঙাল হুজুগে জাতি হলেও এই হুজুগে তারা মাতলো না, দ্রুত মাঠ খালি হয়ে গেল। শুধু প্রধান অতিথি একটি কলাপাতায় লজ্জা নিবারণ করে ত্রিভ মুরারী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন গলায় ফুলের মালা, সামনে পিরিচে ঢাকা পানির গ্লাস নিয়ে যিনি শান্ত সমাহিত ভঙ্গিতে বসে থাকেন তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অন্য শ্রোতাদের মতো তিনি ঘুমিয়ে পড়তে পারেন না। অসুবিধা জায়গায় চুলকানি শুরু হলে চুলকাতে পারেন না। হাসিমুখে বসে থাকতে হয় এবং ভান করতে হয় বিমলানন্দ উপভোগ করছেন। প্রফেশনালরা এই কাজটা ভালোই করেন। অসুবিধা হয় যারা প্রফেশনাল না তাদের। আমার নিজের দেখা একটি দৃশ্য বলছি। বাংলাদেশ পুষ্পপ্রেমীদের একটি অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি হচ্ছে হাজী আসমত আলী বেপারী। ইনি কিছুদিন হলো শুকনো মরিচের ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা করেছেন। তাকে প্রধান অতিথি করার একটিই উদ্দেশ্য, কিছু পয়সাকড়ি পাওয়া।
হাজী আসমত আলী বেপারী চোখ বড় করে দুঘণ্টার মতো সময় মূর্তির মতো কাটালেন। তারপরই সম্ভব-অসম্ভব জায়গায় চুলকাতে শুরু করলেন। প্রধান অতিথিকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো এবং কানে কানে বলা হলো ফুলের ওপর দুএকটা কথা বলবেন। বেশি কিছু বলার দরকার নেই।
হাজি সাহেব রু করলেন গোলাপ দিয়ে। গোলাপের বর্ণ গন্ধ এইসব নিয়ে প্রচুর উচ্ছাস করে বললেন, গোলাপ হচ্ছে আমাদের জাতীয় ফুল।
তাকে কানে কানে বলা হলো, গোলাপ নয়, জাতীয় ফুল হচ্ছে শাপলা। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কোন শালায় বলে শাপলা জাতীয় ফুল? কোথায় গোলাপ আর কোথায় শাপলা? কোথায় আইয়ুব খান আর কোথায় খিলি পান! ভাইসব, আপনারা বলেন, শাপলা কি একটা ফুল? শাপলা হচ্ছে একটা তরকারি।
বুঝতেই পারছেন প্রফেশনাল নন এসব লোকদের প্রধান অতিথি করা খুব রিস্কি ব্যাপার।
আবার প্রফেশনালদের নিয়েও কিছু সমস্যা আছে। এরা এই কাজ করতে করতে একটু বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েন। যা নাকি মাঝে মাঝে জটিলতার সৃষ্টি করে। আমি এরকম একজনকে চিনি। তিনি সভাতে এসেই খোঁজ নেন সভা কতক্ষণ চলবে। সময় জেনে নিয়ে চট করে ঘুমিয়ে পড়েন। দর্শকরা কেউ তা বুঝতে পারে না। সবাই ভাবে চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগে তিনি শুনছেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আধঘন্টা আগে জেগে ওঠেন এবং যথাসময়ে একটি চমত্তার বক্তৃতা দেন। একবার গণ্ডগোল হয়ে গেল। উদ্যোক্তারা বলছে অনুষ্ঠান তিন ঘণ্টার মতো চলবে। সেই হিসেবে তিনি গতার এ অভিভূত হলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান দুঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে গেল। তাকে জাগানো তার ভাবভঙ্গি দিশাহারার মতো। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একজন কানে কানে। বলল, স্যার কিছু বলুন। তিনি হুঙ্কার দিলেন, কেন?
আপনি স্যার প্রধান অতিথি।
তিনি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। দর্শকদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন উঠল এবং এক সময় সবাইকে হতভম্ব করে তিনি বললেন, যুথির মা, আমাকে আধাকাপ চা দাও।
প্রধান অতিথি প্রসঙ্গে আমার নিজের একটি ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা আছে। বেশ অনেকদিন আগের কথা। একদল ছেলে এসে আমাকে ধরল প্রধান অতিথি হতে হবে। আমি এককথায় রাজি। ওদের বলে দিলাম নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে আমি উপস্থিত থাকব। চারটার সময় যাওয়ার কথা। আমি অবশ্যি চারটার সময় গেলাম না। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি এদের একটু দেরিতে উপস্থিত হতে হয় এটাই নিয়ম। আমি কুড়ি মিনিটের মতো দেরি করলাম। অনুষ্ঠান তখনো শুরু হয়নি। কিন্তু কী সর্বনাশ! ডায়াসে প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি দুজনই উপস্থিত। এ-কী কাণ্ড! আমি কী করব ভাবছি। উদ্যোক্তাদের একজন এগিয়ে এসে নিচুগলায় বলল, আপনি হচ্ছেন স্যার স্ট্যান্ডবাই প্রধান অতিথি। আসল জন না এলে আপনাকে বসিয়ে দিতাম।
বলো কী তুমি?
কী করব স্যার বলেন, কেউ কথা রাখে না। বলে আসবে কিন্তু আসে না। এইজন্যে স্ট্যান্ডবাই রাখতে হয়। আসেন স্যার, এক কাপ চা খান। চা না খেলে বুঝব আপনি রাগ করেছেন।
গেলাম চায়ের দোকানে। সেখানে আরেকজন স্ট্যান্ডবাই বিশেষ অতিথি বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। আমাকে দেখে মুখ কালো করে বললেন, আমি একা এলে একটা কথা হতো। স্ত্রী এবং ছোট শালীকে নিয়ে এসেছি, এদের কাছে কী বলি? আপনি বলুন তো ভাই!
আমি উনাকে কী বলব! আমি নিজেও আমার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছি। জীবনের প্রথম প্রধান অতিথি আর স্ত্রী সেটা দেখবে না, তা কি হয়?
এবারের এলেবেলে ডাক্তারদের নিয়ে
এবারের এলেবেলে ডাক্তারদের নিয়ে। কাজেই ভয়ে ভয়ে লিখছি। ডাক্তাররা রাজনীতিবিদদের মতোই সেনসেটিভ। কেউ হা করলেই মনে করে গাল দিচ্ছে। রসিকতা একেবারেই ধরতে পারে না। রসিকতার কারণেই আমার দীর্ঘদিনের ডেনটিস্ট বন্ধু এ, করিমের সঙ্গে আমার কথাবার্তা বন্ধ। এক সন্ধ্যাবেলা তার চেম্বারে দাঁত দেখাতে গিয়ে ডেনটিস্টদের নিয়ে একটা গল্প বললাম। এই গল্প হলো আমার কাল। বন্ধু রেগে অস্থির। গল্পটা এরকম :