আমাদের গ্রামের যে পাগল ছিল তার নাম নও পাগল। তার পাগলামির লক্ষণ হচ্ছে সে একটা লম্বা লাঠি মাটিতে রেখে বলবে–তিন হাত পানি। সারাক্ষণই সে বিভিন্ন জায়গায় লাঠি রেখে পানি মাপছে। কখনো তিন হাত কখনো পাঁচ হাত। যাই হোক, একবার বরযাত্রী এসেছে, সবাই ধরে নিয়ে এল নশুকে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, পানি কতটুকুরে নও? লাঠি দিয়ে মেপে বল দেখি।
নশু অবাক হয়ে বলল, শুকনা খট খট করতাছে। পানির কথা কী কন?
সবাই রেগে আগুন। কড়া গলায় বলল, লাঠি দিয়ে মেপে ঠিকমতো বল হামারজাদা তিন হাত পানি না পাঁচ হাত পানি।
নশু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, পানি তো দেখি না। এইসব কী কন? পাগলের কথাবার্তা।
নশুকে ধরে শক্ত মার দেওয়া হলো। গ্রামের বেইজ্জতি হয়ে যাচ্ছে, সহ্য করা মুশকিল। মার খেয়ে নশুর বুদ্ধি খুলল। লাঠি মাটিতে ধরে বলল, সাড়ে চাইর হাত পানি।
সবার মুখে হাসি ফিরে এল। বরযাত্রীদের একজন বলল, পানি বাড়ছে না কমছে।
বাড়ছে। এখন হইছে পাঁচ হাত।
ঘামে শান্তি ফিরে এল। আধঘণ্টা ধরে নও বরযাত্রীদের সামনে বিভিন্ন জায়গায় লাঠি রেখে পানির উচ্চতা বলতে লাগল। বরযাত্রীরা মহা খুশি।
আমার মনে হয়, শুধু গ্রামে নয় সমাজের প্রতিটি স্তরে একজন করে পাগল দরকার। লেখক এবং কবিদের মধ্যেও দরকার একজন পাগলা-লেখক কিংবা কবি। ঠিক তেমনি পত্রপত্রিকার মধ্যে একটি পাগল পত্রিকা দরকার, যেমন উন্মাদ।
পুনশ্চ : পাগলদের নিয়ে আমি কয়েকদিন আগে একটা চমৎকার রসিকতা পড়লাম। আপনাদের কেমন লাগবে বুঝতে পারছি না, তবু বলছি। মি. জোনসের ইনসমনিয়া হয়েছে। পরপর চার রাত অনুমো থেকে অবস্থা কাহিল। নানান ধরনের সিডেটিভ দিয়েও কাজ হলো না। তখন মি. জোনসের আত্মীয়স্বজন একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে আনলেন। সাইকিয়াট্রিক্ট বললেন, রোগীকে হিপনোটইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দেব। এই বলে তিনি রোগীর সামনে হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, ঘুম আসছে, আপনার চোখে নেমে আসছে ঘুম। বাইরের জগৎ-সংসার আপনার কাছে বিলুপ্ত। আপনার চোখে তন্ত্ৰা। এই তো চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। নিঃশ্বাস হচ্ছে ভারী। সত্যি সত্যি জোনসের চোখ বন্ধ হয়ে এল। নিঃশ্বাস হলো ভারী। ডাক্তার ভিজিট নিয়ে দরজার বাইরে যেতেই মি. জোনস চোখ মেলে ভয়ার্ত গলায় বললেন, পাগল বিদেয় হয়েছে?
সাহিত্য বাসর
আমাদের পাড়ায় সাহিত্য বাসর নামে চ্যাংড়া ছেলেপুলেদের কী যেন একটা সংগঠন আছে। এদের কাজ হচ্ছে দুদিন পর পর মাইক লাগিয়ে পাড়ার সবাইকে বিরক্ত করা। গল্পপাঠের আসর, কবিতা সন্ধ্যা, ছড়া বিকেল, বৃন্দ আবৃত্তি–একটা-না-একটা লেগেই আছে। এসব ঝামেলা ঘরে বসে সেরে ফেললেই হয়, তা করবে না। প্যান্ডেল খাটাবে, মাইক ফিট সুবে–বিরাট জলসা। পয়সা কোত্থেকে পায় কে জানে। দেশ যখন বন্যার পানিতে ডুবে গেল তখন সাহিত্য বাসর-এর অনুষ্ঠানের ধুম পড়ে গেল। বন্যার্তদের সাহায্যার্থে কমিক অনুষ্ঠান, বিচিত্রা অনুষ্ঠান, আনন্দ মেলা।
এই পর্যায়ের শেষ অনুষ্ঠানটি হলো আপনার কি আছে?
আগে ব্যাপারটি সম্পর্কে আপনাদের একটু বলে নেই। তারপর মূল ঘটনায় যাব।
ছুটির দিন সকালবেলায় আরাম করে দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছি, সাহিত্য বাসরের দলবল উপস্থিত। সবার মুখেই হাসি। হাসি দেখেই আঁতকে উঠতে হয়। কাম এরা সহজে হাসে না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, কী ব্যাপার?
আমরা মারাত্মক একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি স্যার। নাম হচ্ছে আপনাদের কি আছে? বন্যার্তদের সাহায্যের জন্যে।
বাহ, খুব ভালো।
একটা ইউনিক আইডিয়া। গানবাজনা কিছু না। ফাঁকা স্টেজ। স্টেজের মাঝখানে একজন ভিখারি বসে থাকবে, গায়ে কোনো কাপড় নেই। শুধু কলাপাতা দিয়ে লজ্জাটা ঢাকা। তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে মাইকে বলা হবে—আপনার অনেক আছে, এর কিছুই নেই। একে কিছু দিন। তখন দর্শকের মাঝখান থেকে একজন উঠে আসবে। সে তার মানিব্যাগ-শার্ট-গেঞ্জি এসব খুলে দেবে। প্রচণ্ড হাততালি। ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক–;ওই মহামানব আসে। আইডিয়া কেমন স্যার?
খুব ভালো, তোমাদের ধারণা লোকজন সব স্টেজে এসে সব খুলে দিয়ে চলে যাবে?
শুরুতে যাবে না। তবে প্রথম কয়েকজন যখন সাহস করে যাবে তখন ফ্লো এসে যাবে। আপনি তো জানেন স্যার, বাঙালি হচ্ছে হুজুগে জাতি। ফ্লোর ওপর চলে।
তা ঠিক।
এখন আপনি হচ্ছেন আমাদের ভগরসা।
আমি মনের উদ্বেগ বহুকষ্টে চাপা দিয়ে বললাম, আমি রসা মানে?
প্রথম যে মানুষটি যাবে সে হচ্ছে আপনি। এপাড়ায় আপনার একটা ইজ্জত আছে। প্রফেসর মানুষ, প্রথম আপনি গেলে অন্যরকম এফেক্ট হবে। একটু হাইড্রামা, স্যার করতেই হবে–উপায় নেই।
কী রকম হাইড্রামা?
সব কাপড়চোপড় আপনাকে খুলে ফেলতে হবে। তারপর আমরা আপনাকে ঠিক ভিখিরির মতো একটা কলাপাতা দিয়ে জড়িয়ে দেব। আপনি কিন্তু না বলতে পারবেন না। রিকোয়েস্ট।
উন্মাদ-এর পাঠক-পাঠিকা, আমি কী করে সেই বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম সেই দীর্ঘ কাহিনী বলতে চাই না। তবে অনুষ্ঠানটি শেষ পর্যন্ত কী রকম হলো সেটা বলছি।
অনুষ্ঠান শুরু হলো সন্ধ্যায়। প্রধান অতিথি চলে এলেন। তার নাম বলছি না। কারণ তিনি একজন পেশাদার প্রধান অতিথি। সবাই একে চেনেন। ঢাকা শহরের শতকরা আশি ভাগ অনুষ্ঠানে তিনি হয় প্রধান অতিথি, কিংবা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন। চমৎকার একটি বক্তৃতা দেন। যে ফুলের মালাটি তাকে দেওয়া হয় সেটি তিনি একটি শিশুর গলায় পরিয়ে অত্যন্ত নাটকীয় কায়দায় শিশুটির কপালে চুমু খান। তখন বিক্ষিপ্তভাবে হাততালি পড়ে। যাই হোক, এই প্রধান অতিথি ভদ্রলোক সম্ভবত অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগে কিছু জানতেন না। যখন দেখলেন স্টেজে কলাপাতা গায়ে এক নেংটো ভিখারি বসে আছে তখন স্বভাবতই ঘাবড়ে গেলেন।