পুনশ্চ : উন্মাদ-এর পাঠকদের জন্যে একটি রসিকতা। এই রসিকতা অনেকটা আইকিউ টেস্টের মতো। এটা শুনে যদি কেউ যদি হাসে তাহলে বুঝতে হবে তার বুদ্ধি কম। যে যত শব্দ করে হাসবে সে তত বোকা। যদি না হাসে তাহলে বুদ্ধিমান। যদি বিরক্ত হয় তাহলে আঁতেল।
এক লোক কানে কম শোনে।
সে তার বেগুনক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পথচারী এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলেপুলে কী?
লোকটি বলল, বছরে দুই একটা হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে খাই।
পাগলরা সবচেয়ে ভালো উপদেশ দেয়
কোথায় যেন পড়েছিলাম পাগলরা সবচেয়ে ভালো উপদেশ দেয়। কথাটির তেমন গুরুত্ব দিইনি। কারণ উপদেশ দেয় এ জাতীয় পাগল আমার চোখে পড়েনি। বহুকাল আগে যখন ফুলবাড়িয়াতে রেলস্টেশন ছিল তখন একজনকে দেখেছিলাম। সে ট্রেনের ইঞ্জিনগুলিকে গম্ভীর গলায় উপদেশ দিচ্ছিল–বাবারা লাইনে থাকিস। নিঃসন্দেহে ভালো উপদেশ। তবে ইঞ্জিনগুলি এই উপদেশকে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা বলা মুশকিল।
কিছুদিন আগে আমি কি এক পাগলের কাছ থেকে সত্যি সত্যি একটা ভালো উপদেশ পেলাম। এই পাগল হচ্ছেন আমার দূরসম্পর্কের মামা। ঝিগাতলায় থাকেন। অত্যন্ত ভালোজাতের পাগল। হইচই নেই, গোলমাল নেই–মধুর স্বভাব। মুখে হাসি লেগেই আছে। কথাবার্তাও খুব স্বাভাবিক। তাঁর পাগলামির একমাত্র নমুনা হচ্ছে, মামিকে দেখলেই শিশুদের মতো এক বিঘৎ জিহ্বা বের করে ভেংচি দিতে থাকেন। যতক্ষণ মামি সামনে থাকেন ততক্ষণ এই অবস্থা। মামি প্রথমদিকে খুব কান্নাকাটি করতেন। দেয়ালে কপাল। তন। এখন সহ্য করে নিয়েছেন। পারতপক্ষে সামনে আসেন না, আর এলেও লম্বা ঘোমটা দিয়ে থাকেন।
এই মামার সঙ্গে এক সন্ধ্যাবেলায় আমার দেখা। তিনি বললেন, সেজেগুঁজে যাচ্ছিস কোথায়?
বিয়েবাড়িতে যাচ্ছি মামা। বৌ-ভাতের দাওয়াত।
মামা সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে একটি উপদেশ দিলেন। নিচুগলায় বললেন, যেতে বসার সময় গুনে গুনে তিন নম্বর চেয়ারে বসবি। শুরু থেকে এক দুই করে তিন নষটায়।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন?
রেজালার বাটি সবসময় তিন নম্বর চেয়ারের সামনে পড়ে।
আমি সেদিন সত্যি সত্যি তিন নম্বর চেয়ারে বসেছিলাম এবং সামনে রেজালার বাটি পেয়েছি। এখনো তাই করি এবং হাতে হাতে ফল পাই। যেসব পাঠক-পাঠিকা আমার এলেবেলে পড়েন তাদেরকে বলছি, ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখুন।
আগের কথায় ফিরে যাই। মামার উপদেশ শোনার পর থেকে পাগলদের উপর আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়। আমার ধারণা, এরা নিজের এবং চারপাশের পৃথিবী সম্পর্কে বেশ ভালো রকম চিন্তাভাবনা করে এবং এদের লজিকও বেশ পরিষ্কার। তার চেয়েও বড় কথা, এদের বসবোধ আমাদের চেয়েও ভালো।
আমি এক রাজনৈতিক সভায় জনৈক পাগলের কাণ্ডকারখানা দেখে এদের রসবোধ সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হই। বেশ উষ্ণ বক্তৃতা হচ্ছিল। রোগামতো এক নেতা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন, তখন অঘটন ঘটল। এক পাগল উঠে দাঁড়াল এবং অবিকল ওই নেতার মতো হাত-পা নেড়ে বক্তৃতা শুরু করল। তার বক্তৃতা আরও জ্বালাময়ী। আমরা সবাই নেতাকে বাদ দিয়ে তার কথা শুনছি এবং বিমলানন্দ ভোগ করছি। রোগা নেতা তীব্ৰদৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন পাগলের দিকে। বুঝতে পারছি ভদ্রলোক যথেষ্ট অপ্রস্তুত বোধ করছেন। তিনি বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টি ওয়ান, টু, থ্রি বলে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। কারণ ততক্ষণে পাগলের ভেতর জজবা এসে গিয়েছে, সে অত্যন্ত উঁচুগলায় বস্ত্র সমস্যার সমাধান করিতে হইবে বলে নিজের লুঙ্গি খুলে গামছার মতো কাঁধে ফেলে দিয়ে হাসিমুখে তাকাচ্ছে সবার দিকে। আমরা তুমুল করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দিত বুলাম। নোগা নেতার ইশারায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে ঘাড় ধরে বের করে আবার সভার কাজ শুরু হলো। কিন্তু সভা আগের মতো আর জমল না। নেতা আবেগকম্পিত গলায় যা-ই বলেন শ্রোতারা দাঁত বের করে হাসে। নেতা তার বক্তৃতায় ফর্মুলামতো যেই বস্তু-সমস্যার কথায় এসেছেন অমনি লোকজন চেঁচাতে শুরু করল-পায়জামা খুইল্যা তারপরে কন। আগে পায়জামা খুইলা কান্দে ফেলেন। হে হে হে। হো হো হো।
পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে কেউ কেউ ভাবতে পারেন নেতাদের ব্যঙ্গ করার জন্যে উপরের ঘটনাটি আমি বানিয়েছি। এত সাহস আমার নেই। নেতাদের আমি বড় ভালোবাসি। যে পাগলটির কথা বললাম, সে ঢাকা শহরের একজন পুরনো পাগল। যেসব মেয়ে ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে রোকেয়া হলে থাকতেন তারা এই পাগলকে ভালো করেই চেনেন। সেই সময়ে এই পাগলকে প্রায়ই হলের গেটের কাছে দেখা যেত। লাজুক ধরনের মেয়েদের কাছে গিয়ে অত্যন্ত বিনয়ী ভঙ্গিতে বলত–আপা, একটা জিনিস দেখবেন? মেয়েটি হ্যাঁ-না কিছু বলার আগেই সে লুঙ্গি খুলে ফেলার একটা ভঙ্গি করত। মেয়েটি চিৎকার করে ছুটে যেত হল গেটের দিকে। পাগল মজা পেয়ে মিটিমিটি হাসত শুনেছি একবার নাকি একটা সাহসী মেয়ে বলেছিল–হ্যাঁ, দেখব। এতে পাগল খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ে। মুখ কালো করে চলে যায়। এরপর থেকে এই অঞ্চলে তাকে আর তেমন দেখা যায়নি।
নাগরিক পাগলদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। সেই তুলনায় গ্রামের পাগলদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক থাকে। সবাই নিশ্চয়ই জানেন, প্রতিটি গ্রামে একজন মহা বোকা এবং একজন পাগল থাকে। এদের দুজনের কাজ হচ্ছে গ্রামবাসীর জন্যে নির্দোষ বিনোদন সরবরাহ করা। বিশেষ করে গ্রামে যখন বরযাত্রী আসে বা অতিথি আসে তখন পাগল এবং মহা বোকাকে সমাদরের সঙ্গে তাদের সামনে উপস্থিত করা হয়। যাতে অতিথিরা পাগলামি এবং বোকামি দেখে বিমলানন্দ উপভোগ করতে পারেন।