নাপিত নিবারণকে পাগল তাড়া করছে–নিবারণ ছুটছে। এক সময় সে বুকে হাত দিয়ে বসে গেল। নাওয়াজীশ আলি খান ছুটে গেলেন। নির্ঘাৎ হার্ট এ্যাটাক। নিবারণ-রূপী এ,বি সিদ্দিক ছটফট করছেন, তাঁকে হাওয়া করা হচ্ছে, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। আমি একটু দূরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছি। নওয়াজীশ ভাইয়ের মুখ ছাই বর্ণ। মোবারক উচ্চস্বরে কলেমা শাহাদৎ পড়ছে।
দারোগা সাহেব ঘোড়ায় করে এসেছেন–কাশেমকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাবেন। ঘোড়ার পেছনে একদল গ্রামবাসী। গ্রামবাসীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্যে এক যুবক এগিয়ে এল, সে রীতিমত পাংক। মাথা কামানো–মাঝখানে এক চিলতে চুল। নওয়াজীশ আলি খানের মেজাজ গেল বিগড়ে। তিনি তাকে নেবেন না। ছেলে অভিনয় করবেই। শেষ পর্যন্ত রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ঠিক আছে তুমি আস ঘোড়ার পেছনে পেছনে। ছেলে দুপ এগুতেই ঘোড়া প্রচণ্ড লাথি দিয়ে ছেলেকে শুইয়ে দিল। আমরা বললাম–সাবাস ঘোড়া। পাংকবিহীন দৃশ্য ধারণ করা হল।
দুঃখময় স্মৃতি
আমার সব ধারাবাহিক নাটকে যা হয়–একদল মানুষ ক্ষেপে যান। এবারো তার ব্যতিক্রম হল না। আমাকে নারী বিদ্বেষী হিসেবে দেখানো হল। কঠিন সব চিঠি ছাপা হল–একটি লিখলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈকা অধ্যাপিকা। একটি সংলাপে মীর্জার মার চরিত্রে রূপদানকারী মিসেস দিলারা জামানও আপত্তি করলেন। সংলাপটি হচ্ছে, ঢোল, পশু ও নারী–এদের সব সময় মারের উপর রাখতে হয়।
সংলাপটি দেয়ার উদ্দেশ্য সমাজে সেই সময়ের নারীর অবস্থান বোঝানো। আজ এই কথা কেউ বলবে না, কিন্তু তখন বলতো। ময়মনসিংহের একটি প্রবচন হচ্ছে, জরু ও গরুকে মারের উপর রাখতে হয়। তারো আগে যদি যাই তাহলে দেখি রামায়ণেও এই উক্তি আছে। তুলসীদাসের রামচরিত মানসে লেখা–
ঢোল, গঁবার, শুদ্র,পশু, নারী–এদের মারের উপর রাখতে হয়।
আমি এ-জাতীয় সংলাপ ব্যবহার করছি বলেই এটা আমার মনের কথা তা মনে করার কোনই কারণ নেই। বহুব্রীহিতে এমদাদ খোন্দকার বলতেন, মেয়েছেলের পড়াশোনার কোনই দরকার নাই–তারা থাকবে রান্নাঘরে। এটা এমদাদ খান্দকারের কথা। আমার না। অথচ শিক্ষিত লোকজন ভেবে বসলেন, প্রচণ্ড নারী-বিদ্বেষ নিয়ে আমি অয়োময় লিখছি। কি অসম্ভব কথা!
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের এক অংশ তিন তালাকের একটি দৃশ্যেও খুব আহত হলেন। আমি দেখিয়েছিলাম রাগের মাথায় তিনবার তালাক বললেই তালাক হয় না। তাঁরা বললেন–হয়। অথচ আমি খুব ভালমত জেনেশুনেই নাটকে এই দৃশ্য ব্যবহার করেছি। ইসলামিক পারিবারিক আইনেও বলা আছে–পর পর তিনবার তালাক বললেই তালাক হবে না। এই আইন বড় বড় আলেমদের সাহায্যে হাদিস কোরআন ঘেঁটে তৈরি করা। আমার বিপক্ষে কঠিন কঠিন সব চিঠি একের পর এক ছাপা হতে লাগল। হায়, একজন কেউ আমার পক্ষে একটি কথা বললেন না।
শেষ কথা
রচনাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। এখন শেষ করা উচিত। সুন্দর কিছু কথা বলে শেষ করলে ভাল হত–অন্য ধরনের কিছু কথা দিয়ে শেষ করি—
নাটকের চতুর্থ পর্ব প্রচারের পর আমার স্ত্রী একটি অসম্ভব রূপবান ছেলের জন্ম দিলেন। ছেলেটি দুদিন বেঁচে রইল–তৃতীয় দিনের দিন মারা গেল। শোক ও দুঃখে পাথর হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে ফিরেছি। বাচ্চারা চিৎকার করে কাঁদছে। আমার মাকে ঘুমের অষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর আমি কি করছি–মাথা নিচু করে লিখে যাচ্ছি অয়োময়ের নবম, দশম পর্ব। আমি দুদিন পর আমেরিকা চলে যাব। আমাকে পান্ডুলিপি দিয়ে যেতে হবে। নাটক যেন বন্ধ না হয়–Show must go on.
লিখতে লিখতে হঠাৎ কি মনে হল। বিছানায় শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালাম। দেখি সে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে, এই পাষাণ হৃদয় মানুষটির সঙ্গে আমার বিয়ে হল?
আমি তার পাশে গিয়ে বসলাম না। মাথায় হাত রাখলাম না। সান্ত্বনার কথাও কিছু বললাম না। আমার হাতে সময় নেই। আমার কাজ শেষ করতে হবে–
I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go beore I sleep.
একদিন আমার সব কাজ শেষ হবে। চাঁদনী পহর রাতে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হব। তখন এ জীবনে সঞ্চিত সমস্ত ব্যথার কথা ভেবে চিৎকার করে কাঁদব। আজ আমার কাঁদার অবসর নেই। I have promises to keep.
আপনি কি সেই লেখক
ভদ্রলোক কঠিন গলায় বললেন, আপনি কি সেই লেখক?
আমি হ্যাঁ বলব না না বলব বুঝতে পারলাম না। সেই লেখক বলতে ভদ্রলোক কি বোঝাতে চাচ্ছেন কে জানে? তিনি যে আমার সঙ্গে রসালাপ করতে আসেননি তা বুঝতে পারছি। সাপের চোখের মত কঠিন চোখে তাকাচ্ছেন। চোখে পলক পড়ছে না।
ভদ্রলোক চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ঘরে কি বাংলা অভিধান আছে? আমি বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, জ্বি আছে।
: নিয়ে আসুন।
পাগল টাইপ মানুষদের বেশী ঘাটাতে নেই–আমি অভিধান নিয়ে এলাম! ভদ্রলোক বললেন, আপনার একটি উপন্যাসে গণ্ডগ্রাম শব্দটা পেয়েছি। গণ্ডগ্রাম শব্দের মানে কি বলুন।
: গণ্ডগ্রাম হচ্ছে অজ পাড়া গাঁ।
: অভিধান খুলে দেখুন।
অভিধান খুললাম। অভিধানে লেখা–গণ্ডগ্রাম হচ্ছে বড় গ্রাম, প্রধান গ্রাম, বর্ধিষ্ণুগ্রাম। কি সর্বনাশের কথা।
ভদ্রলোক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, বাংলা না জেনে বাংলা লিখতে যান কেন? আগে তো ভাষাটা শিখবেন, তারপর গল্প উপন্যাস লিখবেন।