আমি যখন পুরোপুরি নিশ্চিত যে নাটক হবে না, তখন একদিন নওয়াজীশ আলি খান বললেন–সুসংবাদ। টিভি এই নটিকের জন্যে কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে তবে আপনাকেও আপনার পরিকল্পনার খানিকটা কাটছাট করতে হবে। রাজি থাকলে চলুন নৌকা ভাসিয়ে দেই।
আমি বললাম–রাজি। খুশি মনে বাসায় ফিরে এসেছি। গুলতেকিনকে বললাম, অয়োময় শেষ পর্যন্ত যাচ্ছে। সে ফ্যাকাশে ভঙ্গিতে হাসল। রাতে ঘুমুতে যাবার আগে বলল, আচ্ছা আমি যদি তোমাকে কোন অনুরোধ করি তুমি রাখবে?
আমি বললাম, অবশ্যই রাখব। কি চাও তুমি?
নাটকটি তুমি এক বছর পিছিয়ে দাও।
সে কি? কেন?
আমি বেবি এক্সপেক্ট করছি। এই অবস্থায় টেনশান নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব। আমি তোমার নাড়ি-নক্ষত্র চিনি। নাটক শুরু হওয়া মাত্র তুমি জগৎ-সংসার ভুলে যাবে। সব সামলাতে হবে আমাকে। আমার পক্ষে তা সম্ভব না। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি একটা বৎসর পিছিয়ে দাও।
আমি বললাম, তা তো সম্ভব না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে, খেলা শুরু হয়েছে। তুমি কোন চিন্তা করবে না। তোমাকে কোন টেনশান নিতে হবে না–সব টেনশান আমি নেব।
গুলতেকিনের কথা না শোনার জন্যে পরবর্তী সময়ে আমাকে চরম মূল্য দিতে হল। সেই গল্প একটু পরেই বলব।
অয়োময়ের গান
গান লিখব কখনো ভাবিনি। আমার সব সময় মনে হয়েছে গীতিকার হবার প্রথম শর্ত সুর, রাগ-রাগিনীর উপর দখল। সেই দখল আমার একেবারেই নেই। কাজেই গান লেখার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু গান তো লাগবেই। ভাটি অঞ্চলের মানুষ ছমাস বসে থাকে। সেই সময়ের বড় অংশ তারা গান বাজনা করে কাটায়। অয়োময় ভাটি অঞ্চলের গল্প। গান ছাড়া চলবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম সেই অঞ্চলের প্রচলিত গীত ব্যবহার করব। সংগ্রহ করা গেল না। শেষটায় বিরক্ত হয়ে নিজেই লিখতে বসলাম। সুর দেবার জন্যে ওমর ফারুককে দেয়া হল–তিনি চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনার লেখা?
আমি চাপা অহংকার নিয়ে বললাম, জ্বি।
ওমর ফারুক বিরক্ত গলায় বললেন, গান লেখার তো আপনি কিছুই জানেন না। মিল কোথায়? সঞ্চারী কোথায়?
সঞ্চারী কোথায় আমি জানি না। কিন্তু মিল তো আছে।
এই মিলে চলবে না।
আমি নরম স্বরে বললাম, কি করে গান লিখতে হয় আপনি শিখিয়ে দিন। আমি দ্রুত শিখতে পারি।
ওমর ফারুক সাহেব শিখিয়ে দিলেন। তাঁর মত করে গান লিখে দিলাম। তিনি সুর দিয়ে আমাকে শোনালেন। আমি অবিকল তাঁর মত চোখ কপালে তুলে বললাম, কি সুর দিয়েছেন? শুনতে জঘন্য লাগছে।
কি বললেন, শুনতে জঘন্য লাগছে?
জ্বি।
এই রকম কথা বলতে পারলেন?
আমি মনে কথা রাখতে পারি না। যা মনে আসে বলে ফেলি।
হুমায়ূন সাহেব, আপনার সঙ্গে আমি কাজ করব না। স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
উনি এক দরজা দিয়ে বের হচ্ছেন, আমি অন্য দরজা দিয়ে। নওয়াজীশ ভাই দুজনকে ধরে এনে মিটমাট করার চেষ্টা করলেন।
ওমর ফারুক সাহেব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হুমায়ূন সাহেব, গানগুলি প্রচার হোক, তখন আপনি বলবেন–ওমর ফারুক দি গ্রেট।
গান প্রচার হল। এদেশের মানুষ গানগুলি ভালবাসার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমি বলতে বাধ্য হলাম–ওমর ফারুক দি গ্রেট।
অয়োময়ের সব কটি গান আমার লেখা নয়। একটি লিখেছেন সালেহ চৌধুরী–আল্লাহ সবুর করলাম সার। অন্য আরেকটি ওবায়দুল ইসলাম–আসমান ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে।
অয়োময়ের গানগুলির মধ্যে আমার সবচে প্রিয় গান হচ্ছে আমার মরণ চাঁদনী পহর রাইতে যেন হয়। আসলেই আমি চাঁদনী পহর রাতের ফকফকা জ্যোৎস্নায় মরতে চাই। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তেও অসহ্য সুন্দর পৃথিবীকে দেখে যেতে চাই। লেখাটা মনে হয় অন্য দিকে মোড় নিয়ে নিচ্ছে–আগের জায়গায় ফিরে যাই।
যাত্রা শুরু
আউট ডোর-এর কাজ হবে ময়মনসিংহে। ব্রহ্মপুত্র নদী, আমিন ডাক্তার নৌকায় করে ভাটি অঞ্চলে যাচ্ছেন–সারাদিন নৌকা চলেছে। এক সময় রাত নামল। আকাশে চাঁদ উঠল। বদরুল গনি শুরু করল–
আসমানে উইঠাছে চান্দি
আমি বসিয়া কান্দি
ভব সমুদ্র একা একা ক্যামনে হব পার?
দৃশ্যটি ধারণ করতে গিয়ে ক্যামেরাম্যান নজরুল সাহেব হিমশিম খেয়ে গেলেন। নদীতে প্রবল স্রোত। নৌকা টালমাটাল করছে। নেমেছে বৃষ্টি। ময়মনসিংহের বিখ্যাত বৃষ্টি একবার শুরু হলে থামার নাম করে না।
রাত তখন একটা গানের দৃশ্যের চিতায় শুরু হয়েছে। আমি উৎসাহদাতা হিসেবে অন্য একটি নৌকায় আমাদের আর্ট ডাইরেক্টরের সঙ্গে বসে আছি। হঠাৎ প্রবল স্রোতে নৌকা এগিয়ে চলল। মুল দলের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা ভেসে যেতে লাগলাম। ঘোর অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না–দূর থেকে ভেসে আসছে বদরুলের গলা সুবীর নন্দী) ভব সমুদ্র একা একা ক্যামনে হব পারি।
আমার জীবনের আনন্দময় মুহূর্তের একটি। আবেগে চোখে পানি এসে গেল। কয়েক ফোঁটা চোখের জল রেখে এলাম ব্রহ্মপুত্র নদীতে।
শুটিং শেষ হল রাত দুটার দিকে। উৎসাহের কারো কোন কমতি নেই। ভোর হওয়ামাত্র আবার বের হয়ে পড়লাম। রাজবাড়িতে সেট পড়েছে। পুকুর ঘাটে বড় বৌ এবং এলাচি বেগম। সারাদিন কাজ হল–সবার মনে প্রবল উৎসাহ। যে করেই হোক একটা ভাল জিনিস করতে হবে। যে কোন মূল্যে করতে হবে। আশেপাশের সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন।
কত সুখস্মৃতি
অয়োময় নিয়ে চমৎকার সব স্মৃতি আছে। কয়েকটা বলি–মির্জা সাহেব খবর পেলেন তাঁর সন্তান হবে। মনের আনন্দে তিনি সব পাখি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। ক্যামেরা তাঁর মুখের উপর ধরা। তাঁর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল। তিনি পাখির খাঁচায় হাত ঢুকাচ্ছেন আর পাখিরা তাঁকে প্রাণপণ শক্তিতে ঠোকরাচ্ছে। হাত রক্তাক্ত। মীর্জা সাহেব ব্যথায় চিৎকার করতে পারছেন না–আবার পাখি জোগাড় করা সমস্যা। ছবি নেয়া শেষ হল। তিনি রক্তাক্ত হাত চেপে ধরে চেঁচাতে লাগলেন–বাবা রে মরে গেলাম রে।