সাবিহা চরিত্রে মধ্যম মানের একজন অভিনেত্রীকে ডাকা হয়েছিল (ডালিয়া)। তিনিও শুকনো মুখে জানালেন–চরিত্রে অভিনয়ের কিছু নেই।
শেষ পর্যন্ত চরিত্র ঠিক হল।
অভিনেতা অভিনেত্রীদের নাম শুনে সবাই বলল–ডুবেছে, এইবার হুমায়ুন আহমেদ ডুবেছে। বিশ বাঁও পানির নিচে পড়ে যাবে। তাদের এ-জাতীয় চিন্তার কারণ হচ্ছে–মীর্জা চরিত্র করছেন আসাদুজ্জামান নূর। যিনি সব সময় হালকা আমোদী ধবনের চরিত্র করেন। মীর্জা চরিত্রের কাঠিন্য আনা তাঁর কর্ম নয়।
দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র করছেন সারা যাকের। টিভি দর্শকরা যাকে আগে কখনো পছন্দ করেননি।
আরেকটি প্রধান চরিত্র করছেন আমজাদ হোসেন। সবার ধারণা হল, তিনি উচ্চগ্রামের অভিনয় করে নাটকে আউলা ভাব নিয়ে আসবেন।
হায়াত সাহেবকে নিয়েও ভয়–মাঝি চরিত্রে তাঁকে মানাবে না।
মুস্তাফিজুর রহমান আমাকে বললেন, মিসকাস্ট হয়েছে। মিসকাস্টের জন্যে সমস্যায় পড়বেন। এখনো সময় আছে নূরের জায়গায় আলি যাকেরকে নিন। বিশাল দেহ আছে, মানিয়ে যাবে।
আমি বললাম, জমিদারকে কুস্তি করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই–দেখা যাক না।
নৌকা ভাসানোর ব্যবস্থা হল। দুটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত হল এবং পাঠ করা হল। একেকদিন একেক জনের বাসায়। যে বাড়িতে পাঠ করা হবে সেই বাড়ির দায়িত্ব হচ্ছে চমৎকার ডিনারের ব্যবস্থা করা। আমি পান্ডুলিপি নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে খেয়ে বেড়াতে লাগলাম। সে বড় সুখের সময়।
ইতিমধ্যে নাম বদল হয়েছে। এখন আর আমিন ডাক্তার নাম নয়। এখন নাম হল অয়োময়।
এই অদ্ভুত নাম কোথায় পেলাম? দেশ পত্রিকায় একবার একটা কবিতা পড়েছিলাম। কবির নাম অয়োময় চট্টোপাধ্যায়। অয়োময় নামটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। গাঁথুনি থেকে খুলে নিয়ে মাথা খানিকটা হালকা করলাম।
কারা কারা অভিনয় করবেন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেল। সবাই পূর্ব পরিচিত। তাদের সঙ্গে আগে কাজ করেছি–নতুনের মধ্যে আছেন মোজাম্মেল হোসেন। একদিন নওয়াজীশ আলি খানের অফিসে গিয়ে দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নওয়াজীশ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন–ইনি অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন। তাঁকে মীর্জার লাঠিয়াল চরিত্রে ভাবছি।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। অধ্যাপক মানুষ, সামান্য লাঠিয়াল চরিত্র করবেন? চরিত্রও তো তেমন কিছু না। আমি বললাম, ভাই আপনি কাশতে পারেন? তিনি তৎক্ষণাৎ খুক খুক করে দেখিয়ে দিলেন–ফলেন পরিচয়তে।
অয়োময়ের অল্প কিছু ব্যাপার দর্শকরা খুব আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেছেন–হানিফের কাশি তার একটি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে ডাকা হয় কাশার জন্য। শিল্পীরা অনুষ্ঠানে গান গান, নাচেন, কবিতা আবৃত্তি করেন–হানিফ সাহেব কাশেন। সেদিন শুনলাম এক ক্যাসেট কোম্পানী হানিফ সাহেবের কাশির একটা ক্যাসেট বের করতে চান। এই বিচিত্র দেশে সবই সম্ভব।
আমাদের সবচে বড় সমস্যা হল মদিনা চরিত্রে। আমি নওয়াজীশ ভাইকে বলে দিয়েছিলাম–পাগলের থাকবে অল্পবয়স্কা রূপবতী এক বালিকা বধু। যে মেয়েকে নেয়া হল তার নাম মনে পড়ছে না–সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী। চরিত্রের জন্যে মানানসই। একদিন রিহার্সেল দিয়ে সে পিছিয়ে পড়ল।
জানাল–নাটক করবে না। শান্তাকে ভাবা হল। তিনিও পিছিয়ে পড়লেন–দেখা গেল এই চরিত্র কারোরই পছন্দ নয়। একটা সমস্যায় পড়া গেল।
আহমেদ ছফা তখন এক মহিলাকে পাঠালেন যদি তাঁকে কোন সুযোগ দেয়া যায়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমার ধারণা হল, তিনি পারবেন। আমি তাঁকে নিয়ে টিভি ভবনে গেলাম। ভদ্র মহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই যেহেতু আপনি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন আমার একটি চরিত্র পাওয়া অবশ্যই উচিত কিন্তু আমার সিক্সথ সে অত্যন্ত প্রবল। আমি জানি এই নাটকে অভিনয় করতে পারব না।
ভদ্রমহিলা রিহার্সেলে অংশগ্রহণ করলেন। কন্ট্রাক্ট ফরমে সই করলেন। আমি তাঁকে হাসিমুখে বললাম, দেখলেন তো আপনার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল নয়।
তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, তাই তো দেখছি কিন্তু আমি জানি আমার দ্বারা হবে না। বিশ্বাস করুন আমার সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, ভদ্রমহিলার কথাই শেষ পর্যন্ত সত্য হল। তাকে নেয়া হল না। কেন নেয়া হল না তা তাঁকে বলা উচিত ছিল। বলিনি। আজ এই লেখার মাধ্যমে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং স্বীকার করছি তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আসলে ভাল।
মদিনা চরিত্রে শেষ পর্যন্ত এলেন–তারানা। আমি সব সময় তাঁর অভিনয়ের ভক্ত। বহুব্রীহি নাটকে তাঁকে নেয়ার খুব আগ্রহ ছিল। তিনি রাজি হননি। এইবার বাজি হলেন।
অয়োময় হবে না
সব যখন ঠিকঠাক তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পক্ষ থেকে নওয়াজীশ আলি খান আমাকে জানালেন, অয়োময় করা সম্ভব হচ্ছে না। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, কারণ কি?
তিনি করুণ গলায় বললেন, কারণ খুব সহজ। টিভির অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এই নাটক যা দাবি করছে টিভির পক্ষে তা মেটানো সম্ভব নয়। হাতি, ঘোড়া, ছিপ নৌকা, হাওড়ে দিনরাত শুটিং–অসম্ভব। এই একটি ধারাবাহিকের জন্যে টিভির পক্ষে বিশেষ কোন ব্যবস্থা করাও সম্ভব নয়। কাজেই বাতিল।
আমি মন খারাপ করে বাসায় বসে রইলাম। আমাকে আরেকটি সহজ নাটক লিখে দেবার জন্যে মুস্তাফিজুর রহমান অনুরোধ করলেন। আমি বালকদের মত অভিমানী গলায় বললাম–না।