নওয়াজীশ আলি খান
এক দুপুরে টিভি থেকে টেলিফোন করলেন নওয়াজীশ আলি খান। মহা ক্লানন্দিত। আনন্দের কারণ হচ্ছে তাঁকে টিভি থেকে সরিয়ে নিমকো বা এই জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানে নির্বাসিত করা হয়েছিল, তিনি আবার টিভিতে ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, হুমায়ূন ভাই, আসুন চা খেয়ে যান। অনেকদিন আপনার পাগলামী কথাবার্তা শুনি না। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে আমার পাগালামী কথাবার্তা শোনাবার জন্যে রওনা হয়ে গেলাম। তিনি বললেন, একটা ধারাবাহিক নাটক করলে কেমন হয়?
আমি বললাম, উত্তম হয়। কিন্তু আমি তো ভাই প্রতিজ্ঞা করেছি আর ধারাবাহিক নাটকে যাব না।
প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবেন না?
জি-না।
প্রতিজ্ঞা করা হয় ভাঙ্গার জন্যে, এটা জানেন?
জানি।
তাহলে আসুন শুরু করা যাক।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আপনার উপন্যাসকে ভিত্তি করে একটা ধারাবাহিক নাটক করি–বড় উপন্যাস আছে?
না, তবে যে কোন উপন্যাসকেই আমি টেনে রবারের মত লম্বা করতে পারব।
তাহলে একটা নাম দিন, এবং সিনপসিস লিখে দিন–আজই টিভি গাইডে যাবে।
আমি নাম দিলাম, আমিন ডাক্তার। একটা সিনপসিসও লিখে দিলাম–সেই সিনপসিস এমন যে, পড়ে কেউ কিছুই বুঝবে না। বাসায় ফিরেই ধারাবাহিক নাটকের প্রথম পর্বটি লিখে ফেললাম। লেখা শেষ হল রাত তিনটার দিকে। গুলতেকিনকে পড়তে দিলাম। সে পড়ে বলল, নাটকের নাম আমিন ডাক্তার কিন্তু গল্প তো দেখা যাচ্ছে জনৈক ছোট মীর্জাকে নিয়ে। আমি বললাম, শুরুতে আমিন ডাক্তার অপ্রধান চরিত্রে থাকলেও শেষটায় ঝলসে উঠবেন। গুলতেকিন বলল, নাটক ভাল হয়েছে তবে নামটা পছন্দ হচ্ছে না। আমি বললাম, যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলবে না। সে বলল, পৃথিবীর সব কিছু তুমি বোঝ আর কেউ কিছু বোঝে না–এটা মনে করারও কোন কারণ দেখি না। দুজন দুপাশে ফিরে ঘুমুতে গলাম।
প্রথম পাণ্ডুলিপি পাঠ
আমার জীবন বন্ধুহীন। মাঝে মাঝে অল্প কিছু সময়ের জন্যে দুএকজন বন্ধু বান্ধব জোটে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ এক বছরের বেশি কখনো থাকে না। আমার তেমনি এক বন্ধু কবি ওবায়দুল ইসলাম আগ্রহ প্রকাশ করলেন যে প্রথম পাণ্ডুলিপি তাঁর বাসায় পাঠ হবে। সেই উপলক্ষে অনেককে নিমন্ত্রণ করা হল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আছেন। আবুল খায়ের, আসাদুজ্জামান নূর, ডঃ এবং মিসেস ইনামুল হক, সপরিবারে আবুল হায়াত। আসরের মধ্যমণি হিসেবে আছেন নওয়াজীশ আলি খান। খাবার-দাবারের বিপুল আয়োজন। পাণ্ডুলিপি পকেটে নিয়ে সন্ধ্যার পর সেই বাসায় উপস্থিত হলাম। অতিথিরা সবাই এসে গেছেন কিন্তু তাদের সবার মুখই শুকনো। কথা বলছেন নিচু গলায়। খবর যা শুনলাম তা ভয়াবহ। ওবায়দুল ইসলাম সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র খেলতে গিয়ে বাঁ চোখে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। চোখে দেখতে পাচ্ছে না বলে বলছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, চোখের ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিছুমাত্র নড়াচড়া না করে দুসপ্তাহ একভাবে শুয়ে থাকতে হবে। ভাগ্য ভাল হলে রক্ত শরীর শুষে নেকে। ভাগ্য খারাপ হলে, …
ছেলেটি শুয়ে আছে। নড়াচড়া করছে না। এই অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া করা বা পাণ্ডুলিপি পড়ার প্রশ্নই উঠে না। আমি বললাম, আজ বাদ থাক, অন্য একদিন পড়া যাবে। নওয়াজীশ আলি খান বললেন, বাদ দিন, বাদ দিন।
গৃহকর্তা এবং গৃহকত্রী রাজি হলেন না। তাদের বাড়ির সবাই অভিনয় কলায় বিশেষ পারদর্শী। সবাই এমন ভাব করতে লাগলেন যেন কিছুই হয়নি। চোখে আঘাত পেয়ে দেখতে না পাওয়া যেন নিত্যদিনের ব্যাপার। তাদের কারণেই খাওয়া দাওয়া হল, পান্ডুলিপি পাঠ হল। তর্ক-বিতর্ক, মন্তব্য, রসিকতা চলতে লাগল। এক সময় বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম–মড়ার মত পড়ে থাকা বাচ্চা ছেলেটির কথা কারোরই মনে নেই। প্রথম দিনের আলোচনায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আমিন ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করবেন জনাব আবুল খায়ের। নাটকটির নাম বদল করা হবে।
অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন
নাটকের পাত্র-পাত্রী নিবার্চন সব সময় প্রযোজকই করে থাকেন। নওয়াজীশ আলি খান বললেন, নিবচিনের ব্যাপারটি আপনাকে নিয়ে করতে চাই। এই নাটকে চরিত্র অনেক বেশি। চরিত্রের মেজাজও বিচিত্র। আপনি সঙ্গে থাকলে ভাল হবে।
আমি সঙ্গে রইলাম। দেখা গেল আমি সঙ্গে থাকায় সমস্যা কমল না, বাড়ল। পছন্দের অভিনেতা-অভিনেত্রী যাকেই নিতে চাই তিনিই না করেন। মদিনার স্বামী হিসেবে মামুনুর রশীদকে নেয়ার খুব ইচ্ছা ছিল। তিনি ভদ্রভাবে বললেন–না। মীর্জার ছোট বৌ হিসেবে খুব শখ ছিল সুবর্ণাকে নেবার। তিনি বললেন–না। তাঁর না বলার কারণ হচ্ছে, তিনি অন্য একটি ধারাবাহিক নাটক গ্রন্থিকগণ কহে-তে কথা দিয়ে রেখেছেন। ডলি জহুরকেও বলা হল। তিনি বললেন–মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের একটি সিরিজে তাঁকে কাজ করতে হবে। শান্তা ইসলামকে মদিনার চরিত্রে ভাবা হয়েছিল, তাঁর চরিত্র পছন্দ হল না। বললেন–বিদেশ যাবেন, কাজেই করতে পারবেন না।
আমার দীর্ঘ দিনের বন্ধু জনাব আবুল হায়াত সাহেবকে যখন কাশেমের চরিত্র করতে বলা হল তখন তাঁর ফর্সা মুখ কালো হয়ে গেল। চরিত্র পছন্দ নয়। তাঁকে বাসায় গিয়ে নানান কথাবার্তায় ভোলাতে হল।
ফেরদৌসী মজুমদারকে মা চরিত্রে ভাবা হল। আমি নিজে এক দুপুরে তাঁকে পর পর তিনটি পর্ব পড়ে শোনালাম। তিনি শুকনো গলায় বললেন–এর মধ্যে অভিনয় করার কি আছে? যে কেউ এই চরিত্র করতে পারে।