খুব সম্ভব বহুব্রীহির দ্বিতীয় পর্বে পাকুন্দিয়া থেকে এলেন এমদাদ সাহেব। টাউট ধরনের লোক। সোবাহান সাহেব এমদাদের কাছে জানতে চাইলেন–তাঁর কলেজ কেমন চলছে। যে কলেজ তিনি নিজের টাকায় গড়ে তুলেছেন। টাউট এমদাদ বলল–কলেজ খুব ভাল চলছে। নকলের এমন সুযোগ আর অন্য কলেজে নেই। শিক্ষকরাও নকলের ব্যাপারে সাহায্য করেন।
এই চরিত্রটি কিন্তু বেশ কিছু প্রাইভেট কলেজের বাস্তব ছবি। কিন্তু নাটকে বলা মাত্র পাকুন্দিয়া কলেজের অধ্যক্ষ আইনের আশ্রয় নেবেন বলে কঠিন চিঠি পাঠালেন নওয়াজীশ আলি খানকে। কারণ তাঁর কলেজের সম্মান হানি করা হয়েছে।
এই ভদ্রলোক একবারও ভাবলেন না যে তাঁর কলেজটি সোবাহান সাহেবের টাকায় তৈরি হয়নি। যে কলেজের কথা নাটকে বলা হয়েছে সেই কলেজ সোবাহান সাহেবের দানে তৈরি। অথচ পাকুন্দিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ধরে নিলেন যে তাঁর কলেজ সম্পর্কে বলা হচ্ছে। কলেজের অধ্যক্ষের বিচার বিবেচনা যদি এরকম হয় তাহলে অন্যদের দোষ দিয়ে লাভ কি?
আমার তো মনে হয় মেডিকেলের ছাত্ররা ঠিকই করেছে। আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করে বাড়াবাড়ি করেনি। যেমন গুরু তেমন শিষ্যই তো হবে।
শেষ কথা
বহুব্রীহিতে যা করতে চেয়েছিলাম তার সবটাই কি জলে গেছে? মনে হয় না। আমার দুঃসময়ের অনেকেই আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কঠিন আক্রমণের জবাব তারাই দিয়েছেন–আমাকে কোন জবাব দিতে হয়নি। যে মমতা ও ভালোবাসা তাঁরা আমাকে দেখিয়েছেন আমি দীর্ঘদিন তা মনে রাখব।
একটা বিরাট দর্শক শ্রেণীর ভালবাসাও আমি পেয়েছি। আমার সমস্ত অক্ষমতা তাঁরা দেখেছেন ক্ষমার চোখে এবং কিছুটা প্রশ্রয়েরও চোখে।
এই ভালবাসার মূল্য দেবার সাধ্য আমার নেই। যদি থাকত বড় ভাল হত।
অয়োময় : বেদনা ও আনন্দময় অভিজ্ঞতার গল্প
অয়োময়
বেদনা ও আনন্দময় অভিজ্ঞতার গল্প
নিউমার্কেটে আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে দেখা। তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, কি লিখছেন?
আমি বললাম, অয়োময় লিখছি।
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, সাহিত্য কিছু লিখছেন না?
এই দিয়েই অয়োময় প্রসঙ্গ শুরু করি। তবে শুরুর আগে বলে নেই সৈয়দ হকের এই কথায় আমি আহত হয়েছি। টিভির জন্য নাটক লিখলে সাহিত্য হবে না, মঞ্চের জন্যে লিখলে সাহিত্য হবে, এই অদ্ভুত ধারণা তিনি কোথায় পেলেন কে বলবে। যে অয়োময় আমি টিভিতে দিচ্ছি মঞ্চে তা দিয়ে দিলেই সাহিত্য হয়ে যাবে? আমি কেমিস্ট্রির ছাত্র, এইসব ব্যাপার বুঝি না, তাঁর মতামত মেনে নিয়েই(!) আজকের লেখা শুরু করি–
অয়োময়ের আগে আরো দুটি অসাহিত্য টিভির জন্যে লিখেছিলাম–এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি। বহুব্রীহি শেষ করবার পর একটা বড় কাগজে লিখলাম–এই জীবনে আর ধারাবাহিক নাটক লিখব না। আমার বড় কন্যা সেই লেখা ফ্রীজের গায়ে আটকে দিল। ঠাণ্ডা পানির জন্যে যতবার ফ্রীজের দরজা খুলি ততবার লেখাটার দিকে চোখ পড়ে। এক সময় মনে হল সেলফ হিপনোসিস প্রক্রিয়া কাজ করেছে–মাথা থেকে ধারাবাহিক নাটকের ভূত নেমে গেছে। ফ্রীজের গা থেকে লেখা তুলে ফেলা হল। আমি অন্য লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বৎসর দুই কেটে যাবার পর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মাথার গভীর গোপনে এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করছি। যন্ত্রণার কারণ ঠিক বুঝতে পারছি না। স্ত্রী এবং তিন কন্যাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলাম। গারো পাহাড় দেখতে যাব, পথে ময়মনসিংহ শহরে থামলাম। বিকেলে দেখতে গেলাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। মুক্তাগাছার জমিদারের বসত বাড়ি। কলেজের শিক্ষকরা খুব আগ্রহ নিয়ে সব ঘুরে দেখালেন। রাজবাড়ির চারদিকে বিচিত্র সব গাছ। তাঁরা এইসব গাছপালা খুব আগ্রহ নিয়ে
আমাকে চেনাতে লাগলেন–
এটা এলাচি গাছ, এটা লবঙ্গ গাছ, এটা দারুচিনি গাছ।
মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল, এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি।
তাঁরা নিয়ে গেলেন পুকুর ঘাটে। কি সুন্দর ডিমের মত পুকুর। শ্বেত পাথরের কি চমৎকার বাঁধানো ঘাট। পানিতে পা ডুবিয়ে ঘাটে বসেছি। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিল্পকলার শিক্ষক জমিদার সম্পর্কে মজার মজার গল্প বলছেন, মুগ্ধ হয়ে শুনছি—
বুঝলেন হুমায়ূন সাহেব, এই জমিদারের তিন স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের একজন বিষ খাইয়ে স্বামীকে হত্যার চেষ্টা করেন। জমিদার সাহেব অনেক চেষ্টা করেন বের করতে–তিনজনের ভেতর কে বিষ দিয়েছে। বের করতে পারেন না। তিনি মন্ত্রীদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। নতুন ধরনের শাস্তি–তিন স্ত্রীকে সামনে নিয়ে তিনি বসলেন। একটা বিড়ালকে বিষ খাইয়ে তাঁদের সামনে রাখলেন। তাঁরা দেখলেন কি করে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বিড়াল মারা যায়। জমিদার স্ত্রীদের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। এই ঘটনা মাসে একবার করে ঘটতে লাগল।
গল্প শুনে আমি মুগ্ধ। চট করে মাথায় এল–আচ্ছা এদের নিয়ে একটা লেখা লিখলে কেমন হয়? কিন্তু এদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। কেমন ছিল তাদের জীবনচর্যা? পুরোপুরি কল্পনাকে আশ্রয় করে এগোনো কি ঠিক হবে? গবেষণা করব, এত সময় কোথায়?
কখনো যা করি না তাই করলাম, ঠিক করলাম কিছু খাটাখাটনি করব, তথ্য জোগাড় করব। ভাটি অঞ্চলের জমিদারদের জীবিত বংশধরদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম–তাঁরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। এঁদের মধ্যে আছেন গচিয়া চৌধুরী বাড়ির সালেহ উদ্দিন চৌধুরী এবং বাজিতপুর জমিদার বাড়ির বংশধর হারুনুর রশীদ। খসড়া লেখা তৈরি হল–পরিকল্পনা উপন্যাস লেখার। ধারাবাহিক নাটকের চিন্তা তখনো মাথায় আসেনি।