একজন অত্যন্ত নামী বুদ্ধিজীবী (নাম বলছি না কারণ তাকে লজ্জা দিতে চাই না। নাটকের এই পর্ব প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে টেলিফোন করে বললেন, হুমায়ূন সাহেব, আপনার কাজের মেয়েটি কি আপনার সঙ্গে এক সঙ্গে খেতে বসে?
আমি বললাম–না।
যদি আপনার কাজের মেয়ে আপনাদের সঙ্গে খেতে না বসে তাহলে কোন স্পর্ধায় আপনি টিভিতে এই জিনিস দেখালেন?
আমি ঠাড়া গলায় বললাম, আমার কাজের মেয়ে আমার সঙ্গে খেতে বসে না তার কারণ আমি আপনার মতই একজন। সাম্যের কথা মুখে বলি কাজে দেখাই
কিন্তু সোবহান সাহেব আপনার বা আমার মত নন। তিনি অন্তরে যা বিশ্বাস করেন কাজেও তা প্রতিফলিত হয়।
একদিনের কথা। বহুব্রীহির রিহার্সেল হচ্ছে। রহিমার মা আমার কাছে এসে ক্লান্ত গলায় বললেন, বাবা লোকজন আমাকে খুব গালাগালি করে।
আমি বললাম, কেন?
আমি যে খাওয়ার টেবিলে খাইতে বসছি।
আমি বললাম, আপনি বলবেন এটা একটা পাগলদের নটিক। এখানে অনেক কিছুই হবে এর কোনটাই সত্যি না।
ডাক্তার ডাক্তার!!
পনেরো বছর আগে আমার বড় মামীর ইউরিনারী ব্লাডার ফুটো হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ পনেরো বছর তিনি অমানুষিক জীবন-যাপন করলেন। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তাররা বললেন–কিছু করার নাই। শেষ পর্যন্ত সিলেট মেডিক্যাল কলেজের সার্জারীর প্রফেসর (নাম খুব সম্ভব রাজা চৌধুরী) সাহস করে এগিয়ে এলেন। তিনি একটি সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন–মামীর জরায়ু কেটে–সেই কাটা জরায়ু দিয়ে ব্লাডারের ফুটো বন্ধ করে দিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, মামী সুস্থ হয়ে গেলেন। বলা যেতে পারে তার নব জন্ম হল। আমি ঐ সার্জনের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য লিখলাম টিভি নাটক অবসর। একজন নিবেদিতপ্রাণ সার্জনকে নিয়ে গল্প। যিনি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন ছুরি কাঁচি হাতে। যাদের তিনি সারিয়ে তোলেন, তাদের প্রতি তার কোন মমতা নেই। মমতা নেই–স্ত্রী এবং কন্যার প্রতি। ভালবাসেন ছুরি ও কাঁচিকে।
সমাজের সব ডাক্তার তার মত নয়। এই সমাজের দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাক্তার আছেন। অর্থলোলুপ ডাক্তার আছেন। এমন ডাক্তার আছেন যিনি ঠান্ডা মাথায় নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেন। এঁদের নিয়ে নাটক লেখার কথা আমার কখনো মনে হয়নি। মানুষের চরিত্রের অন্ধকার দিক আমাকে কখনো আকর্ষণ করে না। আমি সবসময় মানুষের চরিত্রের আলোকিত অংশ নিয়ে কাজ করি। আমার লেখা সেই কারণে অনেকের কাছে বাস্তবতা-বর্জিত এক ধরণের কল্পকাহিনী বলে মনে হয়। তার জন্য আমার মনে কোন ক্ষোভ নেই।
মানুষের হৃদয়ের অন্ধকার অলিগলি নিয়ে তো সব লেখকরাই কাজ করেন। আমি না করলে কোন ক্ষতি হবে না। তাই আমার বহুব্রীহির ডাক্তার বোকা, কিন্তু সে দরিদ্র মার অনুরোধে নিজের বিয়ের কথা ভুলে গিয়ে হাসপাতালে ছুটোছুটি করতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, একজন বোকা ডাক্তার দেখে ডাক্তাররা এবং হবু ডাক্তাররা আমার উপর ক্ষেপে যান। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের আইডেনটিফাই করতে থাকেন বহুব্রীহির ডাক্তারের সঙ্গে। অথচ ভুলে যান সোবহান সাহেবের বড় মেয়েটিও ডাক্তারী পড়ে। সে বোকা নয়। শান্ত, বুদ্ধিমতী ও হৃদয়বান একটি মেয়ে। তারা সেই মেয়েটির কথা মনে না করে আফজালের কথা মনে করেন। তারা তাদের ক্ষোভের প্রকাশ যে ভঙ্গিতে কৃরন তা ভাবতেও লজ্জা লাগে। আমার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়, বইপত্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনবরত টেলিফোন করে আমাকে বলা হয় আমার বা আমার পরিবারের কোন সদস্যদের চিকিৎসা ডাক্তাররা করবেন না।
একদিনের কথা বলি। নওয়াজীশ আলী খান বহুব্রীহির ইউনিট নিয়ে গিয়েছেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। অপারেশনের একটি দৃশ্যের চিত্রায়ন হবে। ডাক্তাররা যেই শুনলেন ইউনিটটি বহুব্রীহির তাঁরা সহযোগিতা করতে অস্বীকার করলেন।
বেয়াদব শিশু
নিষা এবং টগর।
যথেষ্ট মমতা নিয়ে এই দুটি চরিত্র তৈরি করেছিলাম। মা নেই, দুটি শিশু–বাবার স্নেহে বড় হচ্ছে। যারা বিশ্বাস করে একদিন তাদের মা ফিরে আসবে–অথচ আসে না। এরকম দুটি শিশুর আচরণ যা হওয়া উচিত আমি চেষ্টা করেছি। বাচ্চা দুটিকে সে রকম রাখতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কোন কোন পত্রিকায় লেখা হতে থাকল, আমি শিশুদের বেয়াদব বানাচ্ছি। শিশুরা কিছুই শিখছে না। নাটক দেখে দেখে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রেস ক্লাবের সামনে পাগল
বহুব্রীহির এক পর্বে একটি ডাক্তার আনিসকে বলল কোথায় একটা ভদ্র পাগল। পাওয়া যায় বলতে পারেন? আনিস বলল, অনেক জায়গায় আছে তবে প্রেস ক্লাবের সামনে প্রায়ই একজনুকে দেখা যায়।
এরপর পরই একটা কঠিন চিঠি ছাপা হল। সংবাদ কিংবা ইত্তেফাঁকে। পরলেখক অতি কঠিন ভাষায় আমাকে আক্রমণ করলেন। কারণ আমি নাকি প্রেস ক্লাবের সামনে যেসব বিপ্লবী মানুষ অনশন করেন তাদের অপমান করছি। এই হাস্যকর চিঠি সংবাদপত্রের সম্পাদকরা যখন ছাপেন তখন তা অরি হাস্যকর থাকে না। কারণ সম্পাদক চিঠির বক্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছেন বলেই ছাপছেন।
জাপানী একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে।
বল দেখি কোথা যাই
কোথা গেলে শান্তি পাই
ভাবিলাম বনে যাব
তাপিত হিয়া জুড়াব,
সেখানেও অর্ধরাতে
কাঁদে মৃগী কম্প গাত্রে।
পাকুন্দিয়া কলেজ