দিনকাল পাল্টে গেছে–এ কথাটি সবার মুখেই শোনা যায়, কিন্তু কী পরিমাণ পাল্টেছে তা বলতে পারেন টিনএজদের বাবা-মা। আমার মামাতো বোন বিনুর কথাটা বলি। টিনএজ বলা ঠিক হবে না, অনার্স ফাইনাল দিয়েছে। একদিন দেরি করে বাসায় ফিরল। মেয়ের মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন–দুই কানেই নানা জায়গায় ফুটো করা হয়েছে। কান দুটি দেখাচ্ছে মুরব্বার মতো। তিনচার জায়গায় ফুটো করে গয়না পরাই নাকি এখনকার স্টাইল।
গত রমজানের ঈদে তার সঙ্গে আমার দেখা। কানের বিভিন্ন জায়গা থেকে গয়না ঝুলছে। (দুল না বলে গয়না বলছি, কারণ যেসব জিনিস ঝুলছে তার কোনোটাকেই দুলের মতো লাগছে না। একটি দেখতে ঘণ্টার মতো, তার ভেতর থেকে কালো সূতা বের হয়ে এসেছে।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে বিনু বলল, এরকম করে তাকিয়ো না ভাইয়া, চারটা করে ফুটো করা এখনকার স্টাইল; আমি মোটে তিনটে করিয়েছি।
আমি বিস্ময় গোপন করে বললাম, স্টাইল যখন উঠে যাবে তখন তুই কী করবি? ফুটো বন্ধ করবি কীভাবে?
বিন বড়ই বিরক্ত হলো। কিন্তু সে জানে না বাংলাদেশে চোখধাঁধানো স্টাইল কোনোটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এটিও হবে না। বাড়তি ফুটো নিয়ে মেয়েগুলি বড়ই অশান্তিতে পড়বে। কিংবা কে জানে হয়তো এখনি পড়েছে। মাথার চুল দিয়ে কান ঢেকে রাখতে হচ্ছে।
লেখা শেষ করার আগে আবার আমার ভাগ্নির কাছে ফিরে যাচ্ছি। তার ডেটল ভক্ষণের পর থেকে সবার আচার-আচরণে একটা পরিবর্তন হলো। সে যা বলে সবাই তা-ই শোনে। সেনসেটিভ মেয়ে, আবার যদি কোনো কাণ্ডটাও করে বসে। তার এবং তার মায়ের কথাবার্তার কিছু নমুনা দিচ্ছি।
মেয়ে : আজ আমি কলেজে যাব না।
মা : ঠিক আছে মা, যেতে হবে না।
মেয়ে : আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে? আমি এখন থেকে সাইকেলে করে কলেজে যাব।
মা : বিকেলে নিউমার্কেটে গিয়ে কিনে নিস। তোর বাবাকে বলে দেব।
বাসার অবস্থাটা বোঝানোর জন্যে এই ডায়ালগ কটিই যথেষ্ট। গত বুধবারে গিয়েছি, ওদের ওখানে দেখি এক বখা ছেলে ড্রইংরুমে বসে আছে। ছোকরার গেঞ্জিতে লেখা পুশ মি। তার হাতে সিগারেট। সে সিগারেট টানছে দম দেওয়ার ভঙ্গিতে। ঘর ধোয়ায় অন্ধকার।
আমি আপাকে বললাম, ওই চিজটা কে?
আপা গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ও লীনার একজন চেনা ছেলে। তুই লীনাকে কিছু বলিস না। সেনসেটিভ মেয়ে কী করতে কী করে বসবে। আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।
আমি কিছুই বললাম না। গুম হয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই উজ্জ্বল চোখে লীনা ঢুকল। হাতটাত নেড়ে বলল, মামা, কী কাণ্ড হয়েছে দেখে যাও। সবুজ একটা চিরুনি দিয়ে তার দাড়িতে আঁচড় দিতেই তেরটা উকুন পড়েছে। এদের মধ্যে চারটা লাল রঙের। প্লিজ মামা, দেখে যাও।
আমি কঠিন মুখে বসে রইলাম। আপা মৃদুস্বরে বলল, যা দেখে আয়। এত করে বলছে। সেনসেটিভ মেয়ে।
আমি দেখতে গেলাম। টেবিলের ওপর একটা সাদা কাগজ। সেখানে সত্যি সত্যি তেরটা মিডিয়াম সাইজের উকুন। কয়েকটির পেট লালাভ।
সবুজ আমাকে দেখে দাঁত বের করে বলল, মামার কাছে সিগ্রেট আছে? আই এ্যাম রানিং শর্ট।
আমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব
আমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব নামে পুলিশের একজন রিটায়ার্ড এসপি থাকেন। তার স্বভাব হচ্ছে দেখা হওয়া মাত্র অত্যন্ত চিন্তিত মুখে হাই ফিলসফি গোছের একটা প্রশ্ন করা। মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। সেদিন মোড়ের দোকানে সিগারেট কিনছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম মজিদ সাহেব হনহন করে আসছেন। আমি চট করে একটু আড়ালে চলে গেলাম। লাভ হলো না। ভদ্রলোক ঠিক আমার সামনে এসে ব্রেক করলেন এবং অত্যন্ত গম্ভর গলায় বললেন, প্রফেসর সাহেব, মানুষ হাসে কেন একটু বলুন তো?
আমি বিরক্তি চেপে বললাম, হাসি পায় সেইজন্যে হাসে।
হাসি কেন পায় সেইটাই বলুন।
এ তো মহা যন্ত্রণা। ভদ্রলোক যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তাতে মনে হচ্ছে জবাব না বনে তিনি যাবেন না। তাঁর না হয় কাজকর্ম নেই, রিটায়ার্ড মানুষ; কিন্তু আমার তো কাজকর্ম আছে। আমি বললাম, মজিদ সাহেব আমি আপনাকে একটা গল্প বলি। গল্পটা শুনে আপনি হাসবেন। তারপর আপনি নিজেই চেষ্টা করে বের করুন কেন হাসলেন।
এটা মন্দ নয়। বলুন আপনার গল্প।
আমি গল্প শুরু করলাম–এক লোক একটি সিনেমা একত্রিশবার দেখেছে শুনে তার বন্ধু বলল, একত্রিশবার দেখার মতো কী আছে এই সিনেমায়? লোকটি বলল, সিনেমার এক জায়গায় একটি মেয়ে নদীতে গোসল করতে যায়। সে যখন কাপড় খুলতে শুরু করে ঠিক তখন একটা ট্রেন চলে আসে। একত্রিশবার ছবিটা দেখেছি, কারণ আমার ধারণা কোনো না কোনোবার ট্রেনটা লেট করবে।
মজিদ সাহেব আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। অবাক হওয়া গলায় বললেন, ট্রেন লেট হবে কেন? প্রতিবার তো একই ব্যাপার হবে।
আমি বললাম, হাসিটা তো এইখানেই।
একই ব্যাপার প্রতিবারই ঘটেছে, এর মধ্যে হাসির কী?
মজিদ সাহেব গম্ভীর মুখে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। মনে হলো আমার ওপর খুব বিরক্ত। আমি যে অভিজ্ঞতার কথা বললাম, এ জাতীয় অভিজ্ঞতা আপনাদের সবারই নিশ্চয়ই আছে। অনেক আশা নিয়ে একটি রসিকতা করলেন। সেই রসিকতাটা ব্যাঙের মতো চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে গেল।
আমেরিকান এক বইতে একশটি রসিকতা দেওয়া আছে এবং বলা হয়েছে এই রসিকতাগুলির সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বই দশমিক তিন দুই ভাগ। আমি এর একটা এক বিয়েবাড়ির আসরে চেষ্টা করে পুরোপুরি বেইজ্জত হয়েছি। একজন শুধু আমার প্রতি করুণার বশবর্তী হয়ে একটু ঠোঁট বাঁকা করেছিলেন। কিন্তু অন্যদের গম্ভীর মুখ দেখে সেই বাকা ঠোঁট সোজা করে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। জনৈকা তরুণী চশমার ফাঁক দিয়ে এমনভাবে আমাকে দেখতে লাগল যেন আমার মাথায় দোষ আছে।