পুতুল (দীপা ইসলাম। বেশ ভালভাবে অডিশনে পাশ করলে। তবু আমার মনে হচ্ছিল, যে অভিনয় তার কাছ থেকে আমি আশা করছি তা পাব না। এই মেয়ে ছোটবেলায় অভিনয় করেছে তবে স্টেজে বাচ্চাদের নাটকে অভিনয় এক জিনিস আর টিভির তিনটি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো অন্য জিনিস। মুখের উপর যখন হাজার ওয়াটের আলো এসে পড়ে তখন সব গুলিয়ে যায়। শিল্পী নামের মেয়েটির বেলায়ও একই কথা মনে হল।
চরিত্র ভাগ করে দেয়া হল। বাবা হিসেবে আবুল হায়াত এলেন তবে মন খারাপ করে এলেন। তিনি চাচ্ছিলেন মামার ভূমিকা। বাবার ভূমিকা পেয়ে এতই বিমর্ষ হলেন যে এক পর্যায়ে আমাদের ধারণা হল তিনি হয়ত অভিনয় করবেন না। অভিনেতা আফজাল হোসেনকেও তাঁর চরিত্র নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হল। তিনি বার বার বলতে লাগলেন, আমি তো ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করি না। কাজেই চরিত্রটি সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাই। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করলাম। বললাম–চরিত্রটিতে আপনি অভিনয়ের সুযোগ পাবেন। তিনি দুটি এপিসোড পড়ে বেশ খুশী মনেই রাজি হলেন। নওয়াজীশ আলি খান হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আফজালকে দলে পাবার জন্যে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। সেই আন্তরিক আগ্রহের মর্যাদা যদিও শেষ পর্যন্ত আফজাল দিলেন না। লেখকের তৈরি চরিত্র তাঁর অপছন্দ হবার কারণে বহুব্রীহি ছেড়ে চলে গেলেন। আমার জন্যে তা বেদনাদায়ক ছিল!
গল্পের কাঠামো
আমি কখনো খুব চিন্তা-ভাবনা করে কিছু লিখতে পারি না। সব সময় ভরসা করি কলমটার উপর কিংবা বলা যেতে পারে কলমের টানের উপর। কলমের টানে কিছু না কিছু এসে যাবেই, এটাই আমার বিশ্বাস। তবে বহুব্রীহি নিয়ে আমি যথেষ্ট চিন্তা-ভাবনা করলাম। একটা পরিবার হল গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। পরিবারের প্রতিটি পুরুষ আধা-পাগল ধরনের কিন্তু মেয়েগুলি সুস্থ ও স্বাভাবিক। যাত্রা দলের বিবেকের মত একটি চরিত্র থাকবে যে বিশেষ মুহূর্তে উপস্থিত হবে এবং বিবেকের দায়িত্ব পালন করবে। পরিবারের বাইরের একজন প্রেমিক বোকা (ডাক্তার) থাকবে। এই চরিত্রটিকে ব্যালান্স করবার জন্যে থাকবে একজন বেকি প্রেমিকা (এশা, মামার সেক্রেটারী)। পরিবারের প্রধান ব্যক্তি একজন নিতান্তই সরল, ধর্মভীরু, ভাল মানুষ যিনি পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যায় কাতর। সমস্যা সমাধানের তাঁর পরিকল্পনা নিয়েই গল্প আবর্তিত হবে।
মুল গল্প হাস্যরস প্রধান হলেও পাশাপাশি একটি করুণ স্রোত প্রবাহিত হবে। মাঝে মাঝে সেই স্রোত ব্যবহার করা হবে।
বিশেষ বিশেষ কিছু বক্তব্যও হাসি তামাশার ফাঁকে ফাঁকে রাখা হবে। কিছু সত্যিকার সমস্যার প্রতিও ইঙ্গিত করা হবে। তবে সমস্যাগুলি নিয়ে বেশিদূর যাওয়া হবে না। সরকার প্রচারিত একটি মাধ্যমে সেই সুযোগও অবশ্যি নেই।
এত ভেবে-চিন্তে কেন গল্পের কাঠামো দাঁড় করালাম। কলমের টানের উপর বিশ্বাস কেন করলাম না? কারণটা খুব সাধারণ। হিউমার করার কাজটা কঠিন। বিশেষ করে আমাদের দেশে। কোন একটি দৃশ্য দেখে হেসে ফেললেও আমরা সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর হয়ে বলি–কুরুচিপূর্ণ ভাঁড়ামে। অন্য কোথাও লজিক খুঁজি না, অথচ হাসির নাটক এলেই ভ্রু কুঁচকে লজিক খুঁজতে বসি। কখনো ভাবি না হাসির নাটক মানেই চড়া রঙের ব্যাপার। জীবন যে রকম আছে হুবহু সেই রকম তুলে আনলে আমাদের হাসি আসে না। জীবনকে কোন এক অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারলেই শুধু হাসা যায়। কলার খোসায় পা পিছলে পড়ে যাওয়া একটা দুঃখজনক ব্যাপার। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার দেখেও আমরা হাসি। কেন হাসি?
জাতি হিসেবে বাঙ্গালীর রসবোধ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সাধারণ কথাবার্তায় আমরা চমৎকার রসিকতা করি। তবুও কেন জানি নাটকে রসিকতা করে তাদের ঠিক হাসানো যায় না। তারা গম্ভীর হয়ে বলেন, এর মধ্যে শিক্ষণীয় তো কিছু দেখছি না।
এ জাতীয় কথাবার্তা যাতে কম শুনতে হয়, যাতে দর্শকদের এক অংশকে অন্তত সন্তুষ্ট করতে পারি, সেই কারণেই আমার আটঘাট বাঁধা। দীর্ঘ প্রস্তুতি পর্ব। তবুও আমি ধরেই নিয়েছিলাম নিম্নলিখিত মন্তব্যগুলি আমাকে হজম করতে হবে।
(ক) এইসব দিনরাত্রির পর এই জিনিস? ওয়াক থু।
(খ) ব্যাটা কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা করছে–গোপাল ভাড় কোথাকার।
(গ) নাট্যকার কি ভেবেছে আমরাও তাক মত ব্ৰেইনলেস?
(ঘ) কত বড় ফাজিল–নাটকের মধ্যে আবার সমস্যাও বলে–আরে তুই সমস্যার জানিস কি?
এই জাতীয় মন্তব্যের জন্যে আমি মানসিকভাবে তৈরি ছিলাম। যার জন্য তৈরি থাকা হয় সচরাচর তা ঘটে না। তার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে। আশার ক্ষেত্রেও ঘটল। একদল মানুষ আমার উপর ক্ষেপে গেলেন।
গোড়ায় গলদ
প্রথম পর্বের মহড়াতেই ঝামেলা বেঁধে গেল। শিল্পী নামের মেয়েটি বলল প্রথম পর্বের শেষ অংশ সে করতে পারবে না। কারণ সে পানিতে নামবে না। প্রথম পর্বটির শেষ দৃশ্যে ডাক্তারকে বাচানোর জন্যে মেয়েটির পানিতে ঝাঁপ দেয়ার কথা। শুরুতেই যন্ত্রণা। আনা হল লুৎফুন্নাহার লতাকে। তিনি পানিতে বাপ দিতে রাজি হলেন। শিল্পীকে দেয়া হল অন্য একটি চরিত্র। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। গল্পের যে কাঠামো আমার মাথায় ছিল তাতে বড় রকমের হেরফের করতে হল। পুতুল ছিল সোবহান সাহেবের ছোট মেয়ে, সে হয়ে গেল এমদাদের নাতনি। আরো কিছু ছোটখাট যন্ত্রণা পার করে প্রথম পর্বের রেকডিং শেষ হল। যথারীতি প্রচারিত হল। দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হল না। শুরু হল বন্যা। চরম দুঃসময়ে কি আর হাসি তামাশা দেখতে ইচ্ছে করে? বহুব্রীহি বাক্স বন্দী হয়ে গেল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম–বহুব্রীহির কপালে অনেক দুঃখ আছে।