দুমাস পর রুগী আবার এল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ, এইবার সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করতে পারেন।
রুগী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাঁচালেন ডাক্তার সাহেব। পানির পাইপ বেয়ে উঠানামা যে কি কষ্ট তা এই দুমাসে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
গল্প শেষ হওয়া মাত্র ভদ্রলোক হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়লেন। আমি তুপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, কি বাঁচা গেল। চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছি তখন ভদ্রলোক হাসি থামিয়ে বললেন, হার্ট এ্যাটাক হবার পর এই গল্প আমি খুব কম হলেও পনেরো জনের কাছে শুনেছি। এর মধ্যে হাসির কি আছে বলুন তো? হার্টের রুগী পানির পাইপ বেয়ে উঠবে কি করে বলুন? আপনার একবার হাট এ্যাটাক হোক তখন বুঝবেন ব্যাপারটা কি? হেসেছি কেন জানতে চান? হেসেছি কারণ আপনি এই রাতের বেলা আমাকে হাসাবার জন্যে কষ্ট করে এসেছেন। এটা হচ্ছে ভদ্রতা।
বিদায় নিয়ে চলে আসছি। ভদ্রলোক বললেন, লোক হাসানোর কাজটা ছেড়ে দিন। মানুষকে রাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। এই দেশের জন্যে এখন দরকার কিছু রাগী মানুষ।
মন খারাপ করে বাসায় ফিরলাম। তবে ভদ্রলোকের কথা একেবারে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। ভাবছি আগামী এলেবেলেতে মানুষকে রাগিয়ে দেবার একটা চেষ্টা চালালে কেমন হয়?
আঁতেল বাবা মার পুত্র কন্যা
কিছু কিছু জিনিসের প্রতি আমার এলার্জি আছে। আঁতেল বাবা মার পুত্র কন্যারা হচ্ছে সেই সব জিনিসের একটি। আঁতেল সহ্য করা যায় কিন্তু তাদের অফ-স্প্রীং অসহনীয়। এই সব অফ-স্ত্রীং জ্ঞানী জ্ঞানী আবহাওয়ায় থেকে কেমন যেন ভ্যাবদা মেরে যায়। বুদ্ধি শুদ্ধি নতুন লাইনে চলে। সেই লাইন ভয়াবহ লাইন।
উদাহরণ দেই। উদাহরণটা একটু স্থূল ধরণের। সূক্ষ রুচির পাঠকরা দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন। এক সন্ধ্যায় জনৈক প্রথম সারির আঁতলের বাসায় কিছুক্ষণ ছিলাম। এই কিছুক্ষণেই তিনি তার জ্ঞান বুদ্ধি ও বিশ্লেষণ দিয়ে আমাকে অভিভূত করে ফেললেন। আমি প্রথম জানলাম যে জীবনানন্দ দাশের সব বিখ্যাত কবিতাই ইংরেজী কবিতা থেকে নেয়া। বিভুতিভূষণের সাহিত্য কোন সাহিত্যই নয় এক ধরনের রূপকথা, ইত্যাদি। আলোচনা যখন মায়াকোভস্কিতে চলে এসেছে তখন রঙ্গমঞ্চে আঁতেলের পুত্রের আবির্ভাব ঘটল।
পুত্রের বয়স পাঁচ ছ। সম্পূর্ণ দিগম্বর। মুখ ভর্তি হাসি। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, কি খবর খোকা? খোকা সঙ্গে সঙ্গে বলল, হাইগা আইলাম।
আতেঁল ভদ্রলোক স্তম্ভিত। তিনি পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন–অরূপ, যাও ভেতরে যাও।
অরূপ বলল, আমি হাইগা আইলাম।
ভেতরে যাও বলছি।
অরূপ আবার সেই ভয়াবহ বাক্যটি উচ্চারণ করল।
আঁতেল রাগে প্রায় কাঁপতে লাগলেন। তাঁর মুখে কথা জড়িয়ে যেতে লাগল। আমি বললাম, বাদ দিন ছেলেমানুষ। মায়াকোভস্কি সম্পর্কে কি যেন বলছিলেন?
ভদ্রলোক কর্কশ গলায় তার কাজের মেয়েটিকে ডাকতে লাগলেন। সেই মেয়ে এসে অরূপকে ধরে ভেতরে নিয়ে যাবার পর ভদ্রলোক খানিকটা শান্ত হলেন এবং কপালের ঘাম মুছে বললেন, শিশুদের সাইকোলজি খুব অদ্ভুত, কি বলেন?
তাতো বটেই।
শিশুরা কোন কাজ করতে পারে না। কাজেই বাথরুম করাটাকে তারা মনে করে বিরাট একটা কাজ। তারা মনে করে এই কাজের খবর সবাইকে জানিয়ে দেয়া উচিত। সে তখন তাই করে। অনেকটা মুরগীর ডিম পাড়ার মত।
আমি বললাম–চমৎকার বলেছেন। কারেক্ট।
ভদ্রলোক বললেন, আপনি ডঃ মেয়ারের লেখা শিশু সাইকোলজির অসাধারণ বই রাইজ অব দি রিজনিং সম্ভবত পড়েননি। সেখানে ডঃ মেয়ার দেখিয়েছেন–
ভদ্রলোক কথা শেষ করবার আগেই অরূপ আবার ঢুকল। এবার তার পরনে প্যান্ট। টুকটুকে লাল রঙের একটা শার্ট।
ভদ্রলোক ছেলেকে দেখেই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। খড়খড়ে গলায় বললেন, এখানে কি চাই?
অরূপ বলল, হাগা নিয়া আসলাম।
বলেই প্যান্টের পকেটে হাত দিল। সম্ভবত প্যান্টের পকেটে করেই সে তার কর্মকাণ্ড নিয়ে এসেছে। আমাদের তা দেখিয়ে অবাক করে দিতে চায়। অরূপ তা করার সুযোগ পেল না। তার আগেই কাজের মেয়েটি এসে হেঁ মেরে তাকে নিয়ে গোল।
আঁতেল ভদ্রলোক কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, চাইল্ড সাইকোলজির চমৎকার নমুনা দেখলেন। অরূপের ধারণা হয়েছিল প্রথম বার তার কথা আমরা বিশ্বাস করিনি। কাজেই শুধুমাত্র আমাদের বিশ্বাস করানোর জন্য নোংরা কাজটা সে বাধ্য হয়ে করেছে। হাতে নাতে সে প্রমাণ করে দিতে চাচ্ছে। তাই না?
অবশ্যই।
এই জিনিসটা যদি গ্রোণআপদের মধ্যে থাকতো তা হলে পৃথিবীর চেহারাটাই পাল্টে যেত, তাই না?
জ্বি, তাতো বটেই।
আমরা যেন কি নিয়ে আলাপ করছিলাম?
মায়াকোভস্কি।
হ্যাঁ মায়াকোভস্কি। আপনি কি জানেন–
এতক্ষণ প্রথম সারির আঁতেলের পুত্রের গল্প বললাম। এখন শুনুনু দ্বিতীয় সারির মহিলা আঁতেলের পুত্রের গল্প।
এই মহিলা সব সময় চেষ্টা করেন পুত্রের প্রতিভা যেন নানা দিকে বিকশিত হয়। ছেলে যেন নিজেই নতুন ধরনের খেলা ভেবে ভেবে বের করে এবং খেলে। একদিন সোশ্যাল ওয়ার্ক সেরে মহিলা বাসায় ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, খোকন আজ কি খেলা খেললে?
আজ নতুন একটা খেলা খেলেছি মা।
বই চমৎকার। খেলাটার নাম কি? কি ভাবে খেললে?
খেলাটার নাম ডাক পিওন।
বাহ খুব ভাল–ডাক পিওন। তা কিভাবে খেললে?
তোমার ট্রাঙ্ক খুলে চিঠিগুলি প্রথম বের করেছি।