সুপারিশমালা হাতে আসার আগেই অবশ্যি ত্রাণশিবির খালি হয়ে গেল। কারণ এখানে সাহায্য কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষকরা নিজেরা যা পারছেন দিচ্ছেন, বাইরের সাহায্য নিচ্ছেন না। কার দায় পড়েছে বিনা সাহায্যে কা কা কু কু করতে?
অবশ্যি পঁচাত্তর বছর বয়সের মুনশিগঞ্জের ছমির উদ্দিন মোল্লা একা ঝুলে রইলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার একটা সুযোগ তিনি পেয়েছেন এই সুযোগ হারাতে রাজি নন। একটা ডিগ্রী না নিয়ে তিনি যাবেন না।
এইসব দেখে আমার ধারণা হয়েছে ভিক্ষুকদের ঘোড়ার মত আমাদের শিক্ষকদেরও একটা ঘোড়া আছে। সেই ঘোড়াও বিশেষ বিশেষ জায়গা ছাড়া যেতে পারে না।
একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা
কিছুদিন আগে আমার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমার সব অভিজ্ঞতাই তিক্ত, তবে এই অভিজ্ঞতাটা একটু বেশী রকম তিক্ত। সন্ধ্যাবেলা টিভির সামনে বসামাত্র টেলিফোন এল। অতি মিষ্টি গলায় এক তরুণী বলল, আপনি কি আমাদের বাসায় একটু আসবেন? তরুণীদের মিষ্টি গলায় আমি সচরাচর বিভ্রান্ত হই না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি মিষ্টি গলার তরুণীরা সাধারণত মৈনাক পর্বতের মত বিশাল হয়। যে যত মোটা তার গলা তত চিকণ।
এই ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হলাম। মেয়েটির গলা শুনে মন কেমন করতে লাগল। সে গলায় এক কেজি পরিমাণ মধু ঢেলে বলল, প্লীজ, আমাদের বাসায় কি একটু আসবেন? প্লীজ! প্লীজ!
আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, অবশ্যই। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালাম। আগ বাড়িয়ে আগ্রহ দেখানো ঠিক না। মেয়েদের চরিত্রের একটা বিশেষ দিক হল যেই মুহূর্তে তারা অপর পক্ষের আগ্রহ টের পায় সেই মুহূর্তে নিজেরা দপ করে নিভে যায়। কাজেই আমার পক্ষ থেকে কোন রকম আগ্রহ দেখানো ঠিক হবে না। তাছাড়া একালের তরুণীরা অনেক রকমের ফাজলামি জানে। এটাও বিচিত্র কোন ফাজলামির অংশ কিনা কে জানে?
আমি অবহেলার ভঙ্গিতে বললাম, ব্যপারটা কি? তরুণী মধুর স্বরে বলল, আমার বড় চাচাকে একটু হাসাতে হবে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তার মানে?
: উনার হার্ট এ্যাটাক হয়েছে। এখন রেস্টে আছেন। খুব মনমরা। আপনি এসে উনাকে একটু হাসিয়ে দিয়ে যান। প্লীজ।
আমি রাগ করব কি না বুঝতে পারলামনা। তার বড় চাচাকে হাসাবার জন্যে আমাকে যেতে হবে কেন? আমি কি গোপাল ভাড়? উন্মাদে কয়েকটা এলেবেলে লেখার এই কি পুরস্কার?
: প্লীজ, আসুন। প্লীজ।
তরুণীর কণ্ঠের কাতর আহ্বান মুনী ঋষিরাও ঠেলতে পারেন না। আমি হচ্ছি একজন এলেবেলে লেখক। তবু চট করে রাজি হওয়াটা ভাল দেখায় না। আমি অনিচ্ছার একটা ভঙ্গি করে বললাম, বাসা কোথায় তোমাদের?
: আপনি আসছেন। সত্যি আসছেন? ইশ কি যে খুশী হয়েছি। এত অনিন্দ হচ্ছে। জানেন, আমার চোখে পানি এসে গেছে।
আমার মধ্যে খানিকটা দ্বিধার ভাব ছিল। তরুণীর এই কথায় সমস্ত দ্বিধা দূর হয়ে গেল। রাত আটটার দিকে কলাবাগানের এক বাসায় উপস্থিত হলাম। উপস্থিত হওয়া মাত্র আবিষ্কার করলাম মিষ্টি গলার ঐ তরুণীর বয়স দশ। সে আজিমপুর গার্লস স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে।
তরুণীর বাবা অবশ্যি বার বার বলতে লাগলেন, আমার মত বিশিষ্ট ভদ্রলোক তিনি দেখেননি। তার বাচ্চা মেয়ের কথায় এত রাতে চলে এসেছি। এই যুগে এ জাতীয় ভদ্রতা খুবই বিরল ইত্যাদি।
আমার জন্যে চা বিস্কুট এল। ভদ্রলোক বললেন, যান ভাই আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসুন। আপনার সঙ্গে কথা বললে তিনি খুবই খুশী হবেন।
তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল। মনে হল না যে তিনি খুব আল্লাদ লাভ করলেন। বিরস মুখে বললেন, এত রাতে আমার কাছে কি ব্যাপার?
ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়ে হড় বড় করে বলল, চাচা উনি খুব মজার লোক। উনার সঙ্গে কথা বললে হাসতে হাসতে তোমার পেট ফেটে যাবে। উনি হাসির নাটক লেখেন।
হাসির নাটক লিখি শুনে ভদ্রলোক মনে হল আরো বিরক্ত হলেন। বিড় বিড় করে বললেন, যখন চাবুক মারা নাটক দরকার তখন লেখা হয় হাসির নাটক। এই দেশের হবে কি?
এই জাতীয় মানুষদের খুশী করার একমাত্র উপায় হল তাদের সবকথায় একমত হওয়া। আমি অতি দ্রুত তার সব কথায় একমত হতে লাগলাম। তিনি যখন বললেন, এইখানকার ডাক্তাররা হার্টের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। আমি বললাম, যথার্থ বলেছেন। কিছুই জানেনা।
তিনি বললেন, এই দেশের ইন্টেলেকচুয়েল শ্ৰেণীকে জেলখানায় আটক রাখা উচিত। আমি সেই প্রস্তাবেও খুব সহজে রাজি হয়ে গেলাম।
ভদ্রলোক বললেন, এই দেশে কোন ভদ্রলোক বাস করতে পারে না। আমি বললাম, অবশ্যই।
: লোকজন হাসে, গল্প করে, আনন্দ করে। দেখে আমার গা জ্বলে যায় গত তিন মাসে আমি একবারও হাসিনি। কেউ আমাকে হাসাতে পারে না।
সিক্সে পড়া মেয়েটি বলল, উনি পারবেন। উনি হাসির একটা গল্প বললেই তুমি হাসতে হাসতে কুটি কুটি হবে বড় চাচা। ভদ্রলোক কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমাকে হাসাতে পারবেন?
: বুঝতে পারছি না। তবে এক-আধটা গল্প বলে চেষ্টা করতে পারি।
: বেশ শুরু করুন। দেখি আপনার ক্ষমতা।
আমি বেশ অস্বস্তি নিয়েই শুরু করলাম। গল্প বলে হাসাব এ রকম চ্যালেঞ্জ নিয়ে গল্প করা যায় না।
গল্পটা এক হার্টের রুগীকে নিয়ে।
ডাক্তার হার্টের রুগীকে বললেন–সিড়ি দিয়ে উঠানামা আপনার জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ। দুমাস আপনি সিড়ি ভাঙ্গতে পারবেন না।