এই হচ্ছে ভিক্ষুকের ঘোড়ার গল্প। এইবার যে বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি সেটা বলি।
গতবারের ভয়াবহ বন্যায় এদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঠিক করলেন তারা কিছু করবেন। সমস্যা হতে পারে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলছি না। বুদ্ধিমান পাঠক, অনুমানে বুঝে নিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজকর্মের ধারা অন্যদের মত হবে এটা আশা করা যায় না। কি করা হবে তা ঠিক করার জন্যে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হল। কমিটিকে বলা হল ওয়ার্কিং পেপারস তৈরী করতে। সেই কমিটি আবার তিনটি সাব-কমিটি করল। সেই সাব-কমিটিগুলোর আহ্বায়ক কে হবেন তা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হল। জটিলতা কমাবার জন্যে আরো একটি উপকমিটি তৈরী হল। পাঁচ ছটি মিটিংয়ের পর কেন্দ্রীয় কমিটি পরিকল্পনা দাখিল–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেরাই একটি ত্রাণকেন্দ্র খুলবেন এবং পরিচালনা করবেন।
সেই ত্রাণকেন্দ্র অন্যসব ত্রাণকেন্দ্রের মত হবে না। নুতন ধরনের হবে। যারা এই ত্রাণ কেন্দ্রে আশ্রয় নেবে তাদের অক্ষরজ্ঞানের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। ব্ৰাণকেন্দ্র ছেড়ে এরা যখন বাড়ি ফিরবে তখন তারা লিখতে এবং পড়তে জানবে। ত্রাণশিবিরে তাদের রাখা হবে মোট ২৫ দিন। প্রতিদিন তাদের দুটি করে অক্ষর শেখালেই হবে।
জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাদ্যও দেয়া হবে। ত্রাণ ব্যবস্থায় প্রচলিত খিচুড়ি নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ফুড এণ্ড নিউট্রিশন বিভাগের তত্ত্বাবধানে একই খরচে তৈরী খিচুড়ি যাতে শরীরের নিউট্রিশনাল ব্যালান্স ঠিক থাকে। ফুড এণ্ড নিউট্রিশন বিভাগের সভাপতির ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে খিচুরির নমুনাও তৈরী হল। জিনিসটির রং হল গাঢ় সবুজ। কেন হল সেটা একটা রহস্য, কারণ কাঁচা মরিচ ছাড়া সেখানে সবুজ অন্য কিছু ছিল না। সভাপতিসহ সবাই সেই খিচুড়ি এক চামচ করে খেলেন–স্বাদ ভালই, তবে এক চামচেই প্রত্যেকের পেট নেমে গেল। কেউ তা স্বীকার করলেন না, কারণ নোংরা অসুখ নিয়ে কথা বলতে শিক্ষকরা পছন্দ করেন না।
খাওয়া-দাওয়ার থেকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বেশী জোর দেয়া হল। প্রতি পঞ্চাশজন পুরুষের জন্যে একটি করে এবং প্রতি চল্লিশজন মহিলার জন্যে একটি করে বাথরুমের ব্যবস্থা করা হল। মহিলারা সুযোগ বেশী পেলেন, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিওলজী বিভাগের একজন শিক্ষক সমীক্ষায় দেখিয়েছিলেন–মহিলারা বাথরুম বেশী ব্যবহার করেন।
পুরুষদের বাথরুমে দাড়িওয়ালা একজন পুরুষের ছবি, নীচে লেখা পুং, মেয়েদের বাথরুমে ঘোমটা পরা নব বধু, নীচে লেখা মহিলা। এই নিয়ে বাথরুম সাব কমিটিতে জটিলতা সৃষ্টি হল। বলা হল–দাড়িওয়ালা পুরুষের ছবি কেন? পুরুষমাত্রেই যে দাড়ি থাকবে তার তো কোন কথা নেই? সাইকোলজির একজন এসোসিয়েট প্রফেসর বললেন, দাড়িওয়ালা পুরুষের ছবি বন্যার্তদের কনফিউজ করতে পারে। তারা ভাবতে পারে যাদের দাড়ি আছে শুধু তারাই এইসব বাখরুমে যাবে। এরা এমনিতেই একটা মানসিক চাপের ভেতর আছে। নতুন কোন চাপ সৃষ্টি করা উচিত হবে না। দাড়ি সমস্যার সমাধান হল না। বিষয়টা চলে গেল কেন্দ্রীয় কমিটিতে। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ত্রাণশিবির উদ্বোধন বন্ধ রাখা হল। অবশ্যি বন্ধ রাখার আরো কারণ আছে। উদ্বোধন কে করবেন তা নিয়েও সমস্যা। অনেকে চান ভাইস চ্যান্সেলর করবেন, আবার অনেকে ভাইস চ্যান্সেলরের নামও শুনতে চান না। তাঁদের চয়েস প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর।
ইতিমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বন্যার্তরা অন্যসব ত্রাণশিবিরে ঢুকে পড়েছে। তবে যেহেতু বাংলাদেশের কোন ত্রাণশিবির কখনো খালি থাকে না, এটিও খালি রইল না। শহরের যত রিকশাওয়ালা তাদের ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর হাত ধরে ত্রাণ কেন্দ্রে ঢুকে পড়ল। দিনে রিকশা চালায়। রাতে এসে সাহায্য হিসেবে পাওয়া কম্বলের উপর ঘুমিয়ে থাকে। ব্যবস্থা অতি চমৎকার। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ডাক্তার আছে, নার্স আছে, সুন্দর বাথরুম। সবুজ রঙের খাদ্যটা একটু সমস্যা করছে, তবে সব তো আর পাওয়া যায় না।
তৃতীয় দিন থেকে ক্লাস শুরু হল। চল্লিশজন করে একটা ক্লাসে। সকাল নটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ক্লাস। বিকেল আড়াইটা থেকে টিউটোরিয়েল। প্রতি গ্রুপে সাতজন করে। পড়ানোর কায়দাও নতুন ধরনের। ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শুরু। স্বরবর্ণগুলো ব্যঞ্জনবর্ণের সাথেই আসছে। যেমন প্রথম দিনে শেখানো হল ক এবং কা। সকাল নটা থেকে দুপুর বারটা পর্যন্তু সবাই এক নাগাড়ে পড়ছে ক, ক, কা, কা। দ্বিতীয় দিনে কি, কি, কু, কু।
বন্যার্তরা ব্যাপারটায় মনে হল বেশ মজা পেল। যখন ক্লাস হচ্ছে না, রাতে ঘুমুবার আয়োজন হচ্ছে তখনো দেখা গেল এরা নিজেদের মধ্যে নতুন ভাষায় কথা বলছে।
যেমন—
কা কা কি কি কু?
গা গা গু গু।
গি গি গি?
খ খ খা!
দশম দিন শিক্ষকদের উৎসাহে ভাটা পড়ে গেল। কারণ এঁরা লক্ষ্য করলেন ছাত্ররা শুরুতে কি পড়েছে সব ভুলে বসে আছে। যখন তারা চ চ চা চা পড়ে তখন ক ক কা কা ভূলে যায়। আবার যখন ত ত ত তা পড়ে তখন চ চ চা চা ভুলে যায়।
এই স্মৃতিশক্তি বিষয়ক সমস্যার কি করা যায় তা বের করবার জন্যে মনোবিদ্যা বিভাগের সভাপতিকে আহ্বায়ক করে একটি জরুরী কমিটি গঠন করা হল এবং কমিটিকে অনতিবিলম্বে সুপারিশমালা পেশ করতে বলা হল।