আমি মোটেই সেরকম কিছু ভাবছি না। কারও স্বাধীন ইচ্ছায় আমি বাধা দিই না। তাহলে তুমি বাধা দিচ্ছ না।
শেষ চিঠিটা লিখে ফেলব।
অবশ্যই লিখে ফেলবি।
পৃথিবী ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে মামা।
একটু কষ্ট তো হবেই। এই কষ্ট স্বীকার করে নিতেই হবে। তুই দেরি না করে শেষ চিঠি লিখে ফেল।
সুমি বলল, লাল কালি দিয়ে লিখব মামা।
কালো কালি দিয়ে লেখার চেয়ে রক্ত দিয়ে লিখতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো।
রক্ত? রক্ত পাব কোথায়?
ব্রেড দিয়ে হাত চিরে বের কর।
পাগল হয়েছ? আমি ব্লেড দিয়ে হাত চিরে রক্ত বের করব?
তাহলে এক কাজ কর–ঘরে প্রচুর মশা আছে না?
আছে।
ওদের কাছে হাত বাড়িয়ে দে। রক্ত খেয়ে ওরা ফুলে যখন ঢোল হবে তখন ওদের ধরে ধরে একটা পিরিচে জমা কর। গোটা ত্রিশেক রক্ত-খাওয়া মশা জোগাড় হওয়ার পর মশা টিপে টিপে রক্ত বের কর।
মামা, তুমি ব্রিলিয়ান্ট।
থ্যাংকস।
তাহলে রাখি মামা? মশাদের রক্ত খাওয়ানো শুরু করি।
Bদায়। লেখা হওয়ার পর টেলিফোন করিস, কেমন?
আচ্ছা।
আমি নিশ্চিত মনে ঘুমাতে গেলাম। Bদায় লেখার মতো যথেষ্ট রক্ত যোগাড় করা। সহজ কর্ম না। তাছাড়া কথাবার্তা বলে সুমিকে যথেষ্ট পরিমাণে কনফিউজও করা হয়েছে। আত্মহত্যার ইচ্ছার তিলমাত্র এখন তার মধ্যে নেই। থাকা উচিত নয়।
পরদিন ঘুম ভাঙল হৈচৈ-এর শব্দে। দরজা প্রায় ভেঙে ফেলার জোগাড়। দরজা খুলে দেখি, সুমির মা–আমার কনিষ্ঠ ভগ্নি রণরঙ্গিনী মূর্তিতে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। অবস্থা নিশ্চয় সঙ্গিন। যে-কোনো সঙ্গিন অবস্থা ডিফিউজ করতে হলে আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসতে হয়। আমি আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলাম।
আমার বোন দীর্ঘদিনের উপবাসী সুন্দরবনের মহিলা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো গর্জন করে উঠে বলল, দাদা ভাই, তুমি তুমি তুমি …
আমি বললাম, হ্যাঁ আমি আমি আমি। ব্যাপার কী?
তুমি সুমিকে সুইসাইড করার বুদ্ধি দিয়েছ?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, পাগল হয়ে গেলি নাকি? আমি জীবনবাদী মানুষ। আমি…
এসো তুমি আমার সঙ্গে, এসো।
কোথায়?
পিজি হাসপাতালে।
আরে মুশকিল! লুঙ্গি পরে যাব নাকি?
হ্যাঁ, তুমি লুঙ্গি পরেই যাবে। আমার মেয়ে মরতে বসেছিল তোমার জন্যে।
র্যাটম খেয়েছে শেষ পর্যন্ত?
হ্যাঁ। খেয়েছে। র্যাটম দিয়ে চিনি দিয়ে লেবু চিরে তার রস দিয়ে শরবত বানিয়ে তার থেকে এক চুমুক খেয়েছে।
কিছু হয়নি তো?
কিছু হলে তোমাকে আমি আস্ত রাখতাম?
কী যন্ত্রণা! আমি কী করলাম?
চলো আমার সঙ্গে হাসপাতালে, তারপর শুনবে তুমি কী করেছ। ছিঃ দাদা ভাই, ছিঃ!
গেলাম হাসপাতালে। আমাদের যেখানে যত আত্মীয়স্বজন আছে সব চলে এসেছে। বেশিরভাগই রোগীর কিছু হয়নি দেখে খানিকটা মনমরা। আমাকে দেখে সুমি হাসিমুখে বলল, মামা!
আমি বললাম, কিরে?
তোমার কথামতো সবকিছু করেছি মামা। আগে শরবত বানিয়ে নিয়েছি। শুধু রক্ত দিয়ে Bদায় লিখতে পারিনি। রেড মার্কার দিয়ে লিখেছি।
সিদ্দিকুর রহমান খন্দকার
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
এলেবেলে দ্বিতীয় পর্বের লেখাগুলি এর আগে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় পৃথক পৃথক ভাবে লেখাগুলি ছাপা হয়েছে। লেখাগুলি খবরের কাগজ, উন্মাদ, কিছু মিছু, বিচিত্রা ইত্যাদি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। এছাড়া সর্বশেষে লেখকের একটি ব্যাঙ্গাত্মক রচনা সংকলিত করা হয়েছে।
প্রকাশক
.
দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা
কবি নির্মলেন্দু গুণের ইলেকশন ক্যাম্পেন করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার গল্প এই সংস্করণে ঢুকিয়ে দিলাম। সদ্য সমাপ্ত ধারাবাহিক নাটক অয়োময় প্রসঙ্গে একটি লেখা আছে। প্রথম সংস্করণে প্রচুর ছাপায় ভুল ছিল সেগুলি ঠিক করা হয়েছে তবে অন্য জায়গায় আবারো ভুল করা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক কারণ গ্রন্থের নামই হল এলেবেলে!
হুমায়ূন আহমেদ ১.০১.৯২
শহীদুল্লাহ হল, ঢাকা।
সিদ্দিকুর রহমান খন্দকার বিরস মুখে বসে আছেন।
মন খারাপ হলেই তাঁর টক ঢেঁকুর ওঠে। সন্ধ্যা থেকে তাই উঠছে। এক ঘণ্টার মধ্যে কুড়িটা ঢেকুর ওঠে গেছে। ঘণ্টায় কুড়িটা হিসেবে ঢেকুর ওঠার মত কারণ ঘটেছে। ইলেকশনে তাঁর মার্কা পড়েছে কুমীর। এত কিছু থাকতে তাঁর ভাগ্যে পড়ল কুমীর? এই কুৎসিত প্রাণী মানুষের কোন উপকারে আসে বলে তো তিনি জানেন না। ভোটাররা কুমীরের নাম শুনলেই পিছিয়ে যাবে। তিনি কল্পনায় পরিষ্কার দেখছেন, লোকে বলাবলি করছে খাল কেটে কুমীর আনবেন না। সিদ্দিককে ভোট দেবেন না।
এতদূর এসে পিছিয়ে পড়াটা ঠিক হবে কিনা তাও বুঝতে পারছেন না। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। সব সংগঠনকে টাকা দিতে হচ্ছে। কেউ যেন বেজার না হয়। টাকা দিতে হচ্ছে হাসিমুখে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে। টাকাও যে আদর করে দিতে হয় আগে জানতেন না। কত অদ্ভুত সংগঠন যে বের হচ্ছে। আজ সকালে। চাঁদা চাইতে একদল আসল। তিনি হাসিমুখে বললেন,
বাবারা, তোমাদের সমিতির নাম কি?
বিবিসি শ্রবণ সমিতি।
সেটা আবার কি?
আমরা দল বেঁধে বিবিসির খবর শুনি। তারপর সেই খবর বিশ্লেষণ করি।
ভাল। ভাল। অতি উত্তম। বিবিসি শুনবেনা তো কি শুনবে?
আমাদের রেডিও কি আর শোনার উপায় আছে? এই নাও বাবার পঁচিশ টাকা।
দলের প্রধান এমন ভাব করল যে সে খুবই অপমানিত হয়েছে। মুখ বেঁকিয়ে বলল, স্যার বুঝি ভিক্ষা দিচ্ছেন?