চোখের জলে মিউজিকের নোটেশন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে তাতে কী–নাটক হবে। যথাসময়ে দর্শক দেখবে। এর পেছনের আনন্দ-বেদনার ইতিহাস দর্শকদের জানার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রযোজকের গায়ে একশ চার জ্বর। অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি রেকর্ডিং-এ এসেছে, চোখ রক্তবর্ণ। আজ তার নাটক আছে। তিনি নাটক ফেলে ঘরে শুয়ে থাকতে পারছে না। ডাক্তারের নিষেধ, স্ত্রীর অনুরোধ সব অগ্রাহ্য করে ছুটে এসেছেন। Show must go on.
এক সন্ধ্যায় স্টুডিওতে গিয়ে দেখি একদিন হঠাৎ নাটকের রহিমার মা ছটফট করছেন। যন্ত্রণায় এই বৃদ্ধা মহিলার ফর্সা মুখ নীল হয়ে গেছে। আমি বললাম, কী হয়েছে আপনার?
তিনি কাত গলায় বললেন, আলসার আছে। ব্যথা উঠেছে। সহ্য করতে পারছি না।
একসময় রেকর্ডিং-এর জন্যে ডাক পড়ল। তিনি ঝাড়ু হাতে গেলেন, অভিনয় করলেন। দৰ্শকরা সেই অভিনয় দেখে খুব হাসলেন।
কত অজস্র উদাহরণ। এইসব উদাহরণের কথা আমরা মনে রাখি না। খারাপ দিকগুলিই শুধু মনে থাকে। আমাদের কষ্ট দেয়, ব্যথিত করে।
একজন নাট্যকারকে অনেক বাধা অতিক্রম করে লিখতে হয়। সরকারি বাধা, প্রযোজকদের বাধা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চাপ। এতসব ঝামেলা কাঁধে নিয়ে অন্য নাট্যকাররা কেন লেখেন আমি জানি না। আমি কেন লিখি তা বলছি। তার আগে একটা গল্প বলে নেই।
গ্রামের এক কুমারী মেয়ে হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে গেল। সবাই ভাবল-বাচ্চা মেয়ে বুঝতে পারেনি, একটা ভুল হয়ে গেছে। ঘটনাটা কোনোরকমে ধামাচাপা দেওয়া হলো। কিছুদিন পর দেখা গেল মেয়ে আবার গর্ভবতী। গ্রামের লোকজন সেবারও ঘটনাটা সামলে নিল। কী সর্বনাশ, তৃতীয় বৎসরে আবার এই কাণ্ড। সালিশ বসল। মেয়েকে ডেকে মোড়ল বললেন, ও রহিমা, ব্যাপারটা কী?
রহিমা ক্ষীণকণ্ঠে বলল, আমি কাউকে না বলতে পারি না। না বলতে আমার লজ্জা লাগে।
আমিও ওই রহিমার মতো। কাউকে না বলতে পারি না। কেউ যখন আমার কাছে নাটক চান, আগ্রহ নিয়ে বলে–আমাকে একটা নাটক দেবেন?
আমি বলি, দেব।
ছিলাম গল্প-উপন্যাস নিয়ে, সেখানেই থাকতাম। নওয়াজীশ আলি খান একদিন বললেন, একটা নাটক লিখে দিন।
যেহেতু না বলতে পারি না–দিলাম।
মুস্তাফিজুর রহমান সাহেব বললেন, ধারাবাহিক নাটক দিন।
তাও দিলাম।
ঈদের নাটক যখন চাওয়া হলো তখনও না করতে পারলাম না।
বললাম, লিখে দেব একটা হাসির নাটক।
কী কষ্ট সেই নাটক নিয়ে। দুএক পাতা লিখি, অন্যদের পড়ে শোনাই, কেউ হাসে না। আরও গম্ভীর হয়ে যায়। হাসির নাটক লেখা এত কষ্ট কে জানত! মাঝে মাঝে মনে হয় এই তো হচ্ছে বেশ সুন্দর হাসির সিকোয়েন্স। কিছুক্ষণ পরে সেই লেখা পড়লে মনে হয় পাগলাগারদের পাগল ছাড়া এই নাটক দেখে কেউ হাসবে না।
লিখি, ছিঁড়ে ফেলি আবার লিখি, আবার ছিঁড়ে ফেলি। রাতে ঘুম হয় না, দুঃস্বপ্ন দেখি। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন! একদল লোক দাঁত বের করে আমাকে কামড়াতে আসছে। একদিন শুনি আমার বড় মেয়ে টেলিফোনে তার বান্ধবীকে বলছে–জানিস, আমার বাবার না খুব মেজাজ খারাপ। সারা দিন সবাইকে ধমকাধমকি করছে। হাসির নাটক লিখছে তো, এইজন্যে।
যথাসময়ে নাটক শেষ করি। প্রচারিত হয়। লেখা এবং প্রচারের মাঝখানের বিচিত্র সব স্মৃতি আমি মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াই। তার খবর দর্শকরা রাখেন না। রাখার কথাও নয়।
এখন কেন জানি মনে হচ্ছে যথেষ্ট তো হয়েছে। সিন্দাবাদের ভূতের মতো অনেকদিন টিভির ঘাড়ে চেপে রইলাম। এইবার না বলাটা রপ্ত করে নেব। নিজেও বাচব দর্শকদেরও বাঁচাব। একই কুমিরের বাচ্চা কতবার আর দেখানো যায়?
ডাক্তার নিয়ে গল্প
কোনো একটা পত্রিকায় যেন এই রসিকতাটা পড়েছিলাম। খুব সম্ভব সাপ্তাহিক দেশ। একজন ডাক্তার নিয়ে গল্প।
রোগী এসেছে ডাক্তারের কাছে। তার বললেন, আপনার সমস্যাটা কী? রোগী বল, সমস্যার তো কোনো কুলকিনারা নাই। শরীরে বাত; সকাল সন্ধ্যা জ্বর, কাশি আছে, হাঁপানি আছে। পেটের ট্রাবল দীর্ঘদিন ধরে। ইদানীং আমাশা হয়েছে। যুবক বয়সে যমা হয়েছিল। ছোটবেলায় হয়েছিল হুপিং কফ। এখন চোখেও কম দেখি। আর এই দেখুন-গায়ে কী যেন চাকা চাকা বের হয়েছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, এক কাজ করুন, ঝড়বৃষ্টির সময় সাত ফুট লম্বা একটা লোহার ডাণ্ড নিয়ে মাঠে হাঁটাহাঁটি করুন।
কেন?
আপনার তো সবই হয়েছে, শুধু বজ্রপাতটা বাকি। এইটাই বা বাদ থাকবে কেন? বজ্রপাতও হয়ে যাক।
রসিকতাটা আপনাদের কেমন লাগল জানি না, আমার নিজের বিশেষ ভালো লাগেনি। নির্মম রসিকতা। হাসি আসার বদলে ডাক্তারের উপর খানিকটা রাগই হয়। এইরকম একজন ডাক্তারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নাম খবিরুদ্দিন। এলএমএফ ডাক্তার। বিশেষজ্ঞ নন বলেই ডাক্তারি কিছু জানেন। ওষুধ খেলে রোগ সারে। তবে নৈবেদ্যের উপর সন্দেশের মতো প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে কিছু কঠিন কথাবার্তা বলেন। রোগীরা তা সহ্য করে নেয়। গ্রাম্য প্রবচন আছে না–যে গরু দুধ দেয়…।
ডাক্তার খবিরুদ্দিনের কাছেই আমি প্রথম শুনলাম যে, বদহজমে যে সমস্ত লক্ষণ দেখা যায় অবিকল একই লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রেমে পড়লে। বুক জ্বালা, অস্বস্তি, মাথা ঘোরা, রক্তচাপ বৃদ্ধি, পিপাসাবোধ এবং অনিদ্রা। তার মতে প্রেম এবং বদহজম এ দুটি আসলে একই জিনিস। এক বৃন্তে দুটি ফুল। এবং তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। বদহজমের ওষুধ দিয়ে প্রেমরোগ সারানো যায়।