ঈদ উপলক্ষে একবার একটি নাটক লিখেছিলাম। চার্লস ডিকেন্সের একটি অসাধারণ গল্প–ক্রিসমাস ক্যারলের ভাবানুবাদ। বড়দিনের আগের রাতে এক কিপটে বদমাস বুড়ো তিনটি স্বপ্ন দেখল। এই তিনটি স্বপ্ন তার জীবনটা কীভাবে বদলে দিল তাই নিয়ে গল্প। আমার আগে বলাই চাঁদ মুখোঁপাধ্যায়ও (বনফুল) ক্রিসমাস ক্যারলের অনুসরণে লিখেছিলেন-পীতাম্বরের পুনর্জন্ম।
নাটক প্রচারিত হলো না। প্রযোজক বললেন, মরবিড় গল্প ঈদ উপলক্ষে প্রচার করা যাবে না। অথচ আমার ধারণা, যে কটি নাটক টিভির জন্যে লিখেছি ক্রিসমাস ক্যারল তাদের সবকটিকে অনেক দূরে ফেলে এগিয়ে আছে।
আমি টিভির লোক নই। তবু পাকেচক্রে টিভির সঙ্গে অনেক সময় কাটাতে হচ্ছে। যেসব প্রযোজক সূক্ষ্মভাবে একটি জাতির মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। কাউকে কাউকে বুঝতে পেরেছি। আবার অনেককে পারিনি। একদিনের কথা বলি–নাটক জমা দিয়ে ফিরছি। জনৈক প্রযোজক অত্যন্ত যত্ন করে তার ঘরে নিয়ে গেলেন। মুখ করুণ করে বললেন, হুমায়ুন সাহেব, আপনি কি আমাকে একটা সত্যি কথা বলবেন?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই বলব। কেন বলব না?
লোকে বলে আমার নাকি… পেকে গেছে এটা কি সত্যি? সত্যি কি আমার পেকেছে।
আমি স্তম্ভিত। বলে কী এই লোক!
টিভিতে প্রচার করা যাবে কি যাবে না সেই সম্পর্কে অদ্ভুত একটি নীতিমালা আছে। এই নীতিমালায় একজন প্রফেসরকে খারাপ চরিত্র হিসেবে দেখানো যাবে, ডাক্তারকে দেখানো যাবে, ইঞ্জিনিয়ারকে যাবে, কিন্তু পুলিশকে যাবে না। তাদের দেখাতে হবে মহাপুরুষ হিসেবে। মিলিটারিদের কথা ছেড়েই দিলাম। এই নীতিমালার বাইরেও সব প্রযোজকের আলাদা আলাদা নীতিমালা আছে। কোন জিনিস তারা দেখাবেন, কোনটা দেখাবেন না তা তারা নিজস্ব পদ্ধতিতে ঠিক করেন।
আমি একবার পেনশনভোগী বুড়োদের নিয়ে একটা নাটক লিখেছিলাম—দ্বিতীয় জন্ম। নাটকের এক জায়গায় দুই বুড়ো নৌকায় ভ্রমণ করছে। একজনের বাথরুম পেয়েছে। অন্যকে আড়াল করে সে বসেছে প্রস্রাব করতে। বুড়োদের রাডার দুর্বল থাকে, এই কাজটি তাদের প্রায়ই করতে হয়। আমার ধারণা এটা সুন্দর একটি বাস্তব ছবি। প্রযোজকের মতে এটি অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ। প্রদর্শনের অযোগ্য। আমার মনটাই খারাপ। হয়ে গেল।
প্রযোজকদের উপরে যারা থাকেন তারা হচ্ছেন টিভি তারকা। ক্যামেরা চালু করামাত্র নাট্যকারের ডায়ালগের বাইরে তারা নিজস্ব ডায়লগ দিতে থাকেন। প্রযোজক রেকর্ডিং-এ ব্যস্ত, খেয়াল করতে পারেন না। অদ্ভুত অদ্ভুত ডায়লগ নাটকে ঢুকে পড়ে। আমার এক হাসির নাটকে জনৈক অভিনেতা হাস্যরস আরও বাড়ানোর জন্যে বিধবাদের নিয়ে একটি রসিকতা করলেন। অথচ বৈধব্যের মতো করুণ একটি ব্যাপার নিয়ে হাস্যরস তৈরি করা আমি কল্পনাও করি না।
কত সব কঠিন সমস্যা যে অভিনেত্রীরা তৈরি করেন এবং বিশেষ বিশেষ মুহর্তে কী ধরনের চাপ সৃষ্টি করেন তা জানেন প্রযোজক এবং অসহায় নাট্যকাররা। একটা ঘটনা, বলি।
চব্বিশ ঘণ্টা পর রেকর্ডিং। আমার নাটকের এক প্রধান অভিনেতা আমাকে টেলিফোন করে জানালেন–চরিত্রটি যেভাবে আছে সেভাবে থাকলে আমি অভিনয় করব না। এটা এই জায়গায় বদলে দিতে হবে। আর যদি বদলে দিতে রাজি না হন তাহলে নতুন কাউকে দিয়ে অভিনয় করান। আমি এর মধ্যে নেই।
অভিনেতা চাপ সৃষ্টির চমৎকার সময় বের করে নিলেন। তিনি জানেন চব্বিশ ঘন্টা পর রেকর্ডিং। এই অল্প সময়ে নতুন একজন অভিনেতা পাওয়া যাবে না। তাকেই রাখতে হবে।
অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যেসব ঝামেলা করেন তার আরেকটা উদাহারণ দেই। এইসব দিনরাত্রির কবীর মামা। নাটকের খাতিরে তাকে মরতে হবে, কিন্তু তিনি মরতে রাজি নন। বেঁচে থাকতে চান। মুস্তাফিজুর রহমান সাহেব বহু কষ্টে তাঁকে মরতে রাজি করালেন। কবীর মামা তখন এক কাণ্ড করলেন। নিজের মৃত্যুদৃশ্য নিজেই লিখে নিয়ে এলেন। কুড়ি স্লিপের একতাড়া কাগজ। যেখানে কবীর মামা মৃত্যুশয্যায়। একটু পরপর উঠে বসছেন এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে আবার ঝিম মেরে যাচ্ছেন, খানিকক্ষণ পর আবার উঠে বসছেন এবং আরেকটি কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করছেন–
উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই…
ইত্যাদি।
এইসব দিনরাত্রির শাহানা। তার একটি ছেলে হবে। কিন্তু গর্ভবতী অবস্থায় সে টিভিতে আসবে না। এটা নাকি তার ইমেজ নষ্ট করবে। উঁচু পেট নিয়ে সে নাটক করবে না। শেষ পর্যন্ত করলই না। পত্রিকায় ইন্টারভিউতে বলল, হুমায়ুন আহমেদের ঔচিত্যবোধ নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, একদিন মঞ্চনাটক দেখতে গেছি। হঠাৎ দেখি এইসব দিনরাত্রির শাহানা। মা হচ্ছে সেই আনন্দে ঝলমল করছে। আমি হেসে বললাম, এত বড় পেট নিয়ে এত লোকজনের সামনে ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে–কি, এখন লজ্জা লাগছে না? মেয়েটি মাথা নিচু করল, সম্ভবত বুঝল মাতৃত্বের জন্যে যে শারীরিক অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। কিংবা কে জানে হয়তো বুঝল না।
এর বিপরীত ছবিও আছে। সেই ছবির কথা না বললে খুব বড় অন্যায় করা হবে। একজন অভিনেতার বোন মারা গেছেন। অতি আদরের বোন। পরদিন আমার একটি নাটরে রেকর্ডিং। তিনি চোখ মুছে নাটক করতে এলেন। তার ভয়াবহ ট্রাজেডির কথা কেউ জানল না। এইসব দিনরাত্রির সঙ্গীত পরিচালকের ছোট্ট মেয়েটি পানিতে ডুবে মারা গেছে। তিনি হৃদয়ে পাথর বেঁধে এইসব দিনরাত্রিতে মিউজিক বসাতে এলেন।