ইন্টারভিউর এটাই হচ্ছে মূলকথা। পাবলিক ইন্টারেস্ট পাবে কি না। যারা সাক্ষাৎকার দেন তাদের বেশিরভাগ এটা বুঝতে পারেন না। তারা মনে করেন প্রশ্নকর্তা বুঝি সত্যি সত্যি তার সম্পর্কে জানতে চান। এই বিশ্বাস থেকে দীর্ঘ সময় ভ্যাজর ভ্যাজর করেন। পাবলিক মজা পায়। পত্রিকা বিক্রি হয়। ইন্টারভিউর এটাই হচ্ছে সার কথা।
জীবনের প্রথম টিভি দেখা
আমি জীবনের প্রথম টিভি দেখি উনিশশ পয়ষট্টি সনে। তখন ঢাকায় প্রথম টিভি এসেছে। সৌভাগ্যবান কেউ কেউ টিভি সেট কিনেছেন। সেসব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ নেই। একদিন খবর পেলাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে একটা টিভি কেনা হয়েছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলাম। চৌকোনা বাক্সের কাণ্ডকারখানা দেখে আমি মুগ্ধ ও বিস্মিত। একজন লোক খবর পড়ছে, তার মাথা দুলছে, কোমর দুলছে, পা দুলছে। মাঝে মাঝে তার গায়ের উপর দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। বড় চমত্তার লাগল। নাচ এবং খবর একসঙ্গে। একের ভেতর দুই। আমি পাকিস্তানি পতাকা না দেখানো পর্যন্ত বসে রইলাম। সারাক্ষণই এরকম ঢেউ খেলা ছবি। পরে শুনেছি রিসেপশন খারাপ থাকার কারণে নাকি ওই কাণ্ড ঘটেছে। রিসেপশন ঠিক থাকলে নাকি অন্য ব্যাপার। তখন নাকি খুব চমৎকার দেখা যায়।
পরদিন আবার গেলাম। ওই একই ব্যাপার। রিসেপশন ঠিক হচ্ছে না। শুনলাম টিভি সেটেই নাকি গণ্ডগোল। ইতোমধ্যে আমি ঢেউ খেলানো ছবিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমার নেশা লেগে গেছে। রোজ যাই। আমার সঙ্গে আরও অনেকে দেখে। তারাও আমার মতো মুগ্ধ। টিভির সামনে থেকে নড়তে পারে না।
ঠিক রিসেপশনের টিভি একদিন দেখলাম। মোটেও ভালো লাগল না। বড় সাদামাটা মনে হলো। টিভির প্রতি আমার আগ্রহই গেল কমে। আমার মনে আছে যখন ঢাকা কলেজ হোস্টেলে প্রথম টিভি এল আমি দেখার মতো কোনো উৎসাহ খুঁজে পেলাম না। অনেকদিন টিভি রুমে যাইনি। তারপর আবার যাওয়া শুরু করলাম এবং আমার নেশা ধরে গেল। টিভি সেটের সামনে থেকে উঠতে পারি না।
এই ঘটনা দুটি বিশ্লেষণ করলে একটা জিনিস বেরিয়ে আসে। তা হচ্ছে, এই চৌকোনো বাক্স যা ইচ্ছা তা দেখিয়েও মানুষকে মুগ্ধ এবং নেশাগ্রস্ত করে ফেলতে পারে। শুধু মানুষ নয় পশু পাখিকেও।
নেচার পত্রিকায় কুকুরের টিভিপ্রীতি সম্পর্কে একবার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, সন্ধ্যাবেলা টিভি না ছাড়লে পোষা কুকুররা অস্থির হয়ে পড়ে, তাদের ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। ক্ষুধা কমে যায়। কুকুররা মানুষের মতো আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখে। তারা প্রেমের দৃশ্যগুলি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। সবচেয়ে অপছন্দ করে মারামারির দৃশ্য।
সেদিন পত্রিকায় পড়লাম চীন দেশের এক কুকুর টিভিতে মারামারির দৃশ্য দেখে ভয়ে হার্টফেল করে ফেলেছে। কুকুরেরই যখন এই অবস্থা মানুষের কথা বাদই দিলাম। নিতান্ত আঁতেল যে ব্যক্তি (যার প্রিয় লেখক জেমস জয়েস ও বিষ্ণু দে) তাকেও দেখা যায় হা করে পর্দার সামনে বসে থাকতে। সেই হাও এমন বিকট হা যে আলজীব পর্যন্ত বের হয়ে থাকে। আমার পরিচিত একজন মহা আঁতেল অধ্যাপক আছেন। জা লুক গদার এবং ফেলেনি এই দুজন চিত্রপরিচালক ছাড়া আর কোনো পরিচালকের ছবি তিনি দেখেন না। নজরুলকে তিনি মনে করেন ছড়া লেখক। সেই তার বাসায় একদিন সন্ধ্যায় গিয়েছি। অতি উচ্চমার্গের কথাবার্তা শুনছি। এক সময় তার মেয়ে এসে বলল, টিভিতে বাংলা ছবি দেখাচ্ছে–প্রেম পরিণয়, দেখবে না? অধ্যাপক বন্ধু কাষ্ঠ হাসি হেসে বললেন, আমি প্রেম পরিণয় দেখব কেন? মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, তুমি তো সবগুলিই দেখ। এটা কেন দেখবে না? অত্যন্ত ব্রিতকর অবস্থা।
অধ্যাপক বন্ধু শুকনো গলায় বললেন, আসল ব্যাপারটা কী জানেন? খুবই আনএকসেপটেবল জিনিসও টিভির মাধ্যমে যখন আসে তখন একসেপটেবল মনে হয়। অধ্যাপক বন্ধুরা কথা কতটুকু সত্যি আমি জানি না। কিছুটা হয়তো সত্যি যদিও আমার মনে হয় আমরা এই যন্ত্রটিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। ভালো লাগুক না লাগুক আমরা তাকিয়ে থাকি। পঁচিশজন (নাকি তিরিশ?) টিভি প্রযোজক মিলে আমাদের যা দেখান আমরা তাই দেখি। ব্যাপারটা কি ভয়াবহ নয়? এই পঁচিশজন টিভি প্রযোজক কি সূক্ষ্মভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন না। এরা যদি মনে করেন বাংলাদেশের দর্শকদের আমরা প্রতি সপ্তাহে একটি ভাঁড়ামো ধরনের অনুষ্ঠান দেখাব তাহলে আমাদের শুধু তাই দেখতে হবে। অন্য কিছু আমরা দেখব না। এবং একসময় ভাড়ামো ধরনের অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হয়ে যাব। নির্দিষ্ট সময়ে কিছু ভাঁড়ামো না দেখলে ভালো লাগবে না। বদহজম হবে। ঘুম ভালো হবে না।
উদাহরণ দেই। নওয়াজীশ আলি খান নামের একজন প্রযোজক টিভিতে আছেন। চমকার মানুষ। হাসিখুশি। মজার জিনিস খুব পছন্দ করেন। যেহেতু তিনি মজার ব্যাপারগুলি খুব পছন্দ করেন, কাজেই তিনি প্রায় জোর করে আমাকে দিয়ে কয়েকটি হাসির নাটক লেখালেন। হাসির নাটক প্রচারিত হলো। দর্শকরা হাসির নাটক দেখলেন। নওয়াজীশ আলি খান যা দেখাতে চাচ্ছিলেন দর্শকদের তিনি তা-ই দেখালেন।
আমি একবার একটা ভৌতিক নাটকও লিখেছিলাম। যে দুজন প্রযোজক আমার নাটক করেন তাদের কেউই ভূতপ্রেত পছন্দ করেন না বলে সেই ভৌতিক নাটক প্রচারিত হলো না।