যাই হোক, নামটি বলেই তিনি কিন্তু ফাঁদে পা দিলেন।
প্রশ্ন : তাঁর কী কী বই পড়েছেন?
উত্তর : অনেকগুলি পড়েছি। নাম মনে করতে পারছি না।
প্রশ্ন : কোনো একটি উপন্যাসের ঘটনা যদি বলেন তাহলে নামটি মনে করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি। কোনো ঘটনা মনে আছে?
উত্তর : জি-না।
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক অথচ আপনি আর কোনো বইয়ের নাম জানেন না। ঘটনা বলতে পারছেন না, ব্যাপারটা কী?
রাজনীতিবিদ নিরুত্তর।
ইন্টারভিউটি ছাপা হয়েছিল বিচিত্রা কিংবা আনন্দ বিচিত্রা-য়, আমার ঠিক মনে পড়ছে না। আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে আমরা কোনো জিনিস সম্পর্কে অজ্ঞ এইটি স্বীকার করতে চাই না। প্রশ্নকর্তা আমাদের এই দুর্বলতাকে চমৎকার ব্যবহার করেন। সুন্দর ফাঁদ পাতেন। অজান্তে সেই ফাঁদে পা দেই, তারপর আর বেরুবার পথ থাকে না।
অবশ্যি ঠিকঠাক উত্তর দিয়েও অনেক সময় পার পাওয়া যায় না। প্রশ্নকর্তা উত্তরগুলি নিজের মতো করে সাজান, উত্তর যেমন আছে তেমনি রাখেন, কিছুই বদলান না। কিন্তু সাজানোর কারণ সম্পূর্ণ উল্টে যায়। উদাহরণ দেই। মনে করা যাক, একজন সাংবাদিক নামি এক চিত্রতারকার ইন্টারভিউ নিতে গেছেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ছটায়, নায়িকা এলেন রাত নটায়। এসেই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নানান জায়গায় টেলিফোন করতে লাগলেন। এক ফাঁকে শুধু বললেন, কিছু মনে করবেন না, খুব ব্যস্ত। আপনাকে কিছু খেতে দিয়েছে? দেয়নি? ওমা কী কাণ্ড! কী খাবেন?
সাংবাদিক মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, এক গ্লাস পানি খাব।
নায়িকা এক গ্লাস পানি টেবিলে রেখে উধাও হয়ে গেলেন। এখন সাংবাদিক জ্বলোক রিপোর্ট কী কী ভাবে লিখবেন। দুভাবে লিখতে পারেন।
নমুনা-১
(ভালো রিপোর্ট।)
মিস অর সঙ্গে আমার দেখা করার কথা সন্ধ্যা ছটায়। আমি জানতাম আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্তেও তিনি তা রক্ষা করতে বা সন্ধ্যা ঘনিয়ে আমি পারবেন না। কারণ তার ব্যস্ততার সীমা নেই। আমাকে তিনি সময় দিয়েছেন শুধুমাত্র এই কারণে যে কাউকে তিনি না করতে পারেন না। যা ভেবেছি তা-ই, তিনি আসতে পারলেন না। আমি বসে বসে তার বসার ঘর লক্ষ করলাম। মিথ রুচির ছোঁয়া চারপাশে। দেখতে ভালো লাগে। পবিত্র কাবা শরীফের একটি বাঁধানো ছবি ঘরে আছে। আধুনিকতার নামে তিনি ধর্মবিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে রাখেননি। উনি এলেন রাত নটায়। আমাকে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে দেখে লজ্জায় তার অপরূপ মুখশ্রী রক্তবর্ণ হয়ে গেল। কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন সেই সময় কোথায়? একের পর এক টেলিফোন আসছে। তবু এর ফাঁকেও যখন শুনলেন আমি তৃষ্ণার্ত তিনি ছুটে গিয়ে নিজের হাতে এক গ্লাস বরফশীতল পানি নিয়ে এলেন। আমি তার সৌজন্য ও ভদ্রতায় মোহিত হলাম।
নমুনা-২
(মন্দ রিপোর্ট)
এদেশে কিছু কিছু তারকা (!) আছেন যারা মনে করেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে উপস্থিত না হওয়াটা তাদের তারকামূল্যের মাপকাঠি। যিনি যত বড় তারকা তিনি তত দেরি করবেন। মিস অ হচ্ছেন এমন একজন। সন্ধ্যা ছটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আমি রাত নটা পর্যন্ত বসে রইলাম। মশার কামড় খেতে খেতে মিস অর রুচিহীন গৃহসজ্জা দেখে সময় কাটানো ছাড়া আমার কিছু করার নেই। দেয়ালে কামরুল হাসানের তরুণীর পেইন্টিং-এর পাশাপাশি কাবা শরীফের বাঁধাই ছবি। শো-কেসে দামি বিদেশি ডলের পাশে বঙ্গসংস্কৃতির পরাকাষ্ঠা হিসেবে একটি তালের হাতপাখা। উঠতি ধনীদের মতো যেখানে যত দামি জিনিস পেয়েছেন মিস অ তার সবই বসার ঘরে জড়ো করেছেন।
যাই হোক, মিস অর একসময় মর্জি হলো তিনি এলেন এবং তিনি যে অসম্ভব ব্যস্ত তা প্রমাণ করার জন্যে একটির পর একটি টেলিফোন করতে লাগলেন। আমি দীর্ঘ সময় তার জন্যে বসে আছি জেনে তিনি অবশ্যি করুণাবশত আধা গ্লাস ঠান্ডা পানি আমার সামনে রেখে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম, হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন….
তবে এই সমস্ত রিপোর্টারকে বেকায়দায় ফেলবারও উপায় আছে। আমি কয়েকবার ফেলেছি। একটি উদাহরণ দিচ্ছি। বছরখানেক আগে আমার ইন্টারভিউ নিতে এক রিপোর্টার এলেন। তার ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝলাম অবস্থা ভালো না। এই লোক এসেছে আমাকে কাদায় ঠেলে ফেলবার জন্যে। কাজেই আমি উত্তরের ধরন পাল্টে দিলাম। নমুনা দিচ্ছি
প্রশ্ন : আচ্ছা আপনি কি স্বীকার করেন এ পর্যন্ত যা লিখেছেন সবই বাজে মাল?
উত্তর : কেন স্বীকার করব না। এটা তো লুকিয়ে রাখার কোনো ব্যাপার না। সবই রদ্দি জিনিস। পচা মাল।
প্রশ্ন : আপনার লেখাগুলি কিন্তু বেশির ভাগই হালকা।
উত্তর : কারেক্ট। তবে আপনি বোধহয় ভদ্রতা করে বলছেন বেশির ভাগই হালকা। আসলে সবই হালকা। আপনি যেমন জানেন আমিও জানি, অন্যরাও জানে। পুরনো কথা তুলে কী লাভ?
প্রশ্ন : জীবন সম্পর্কে আপনার কোনো বোধ নেই।
উত্তর : খুবই সত্যি কথা।
প্রশ্ন : নাট্যকার হিসেবেও আপনি ব্যর্থ। কারণ এখন পর্যন্ত কোনো নাটকে সমাজের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট আপনি দেখাতে পারেননি।
উত্তর : একশ ভাগ খাঁটি কথা। আমার নাটক মানেই ফালতু বিনোদন।
ভদ্রলোক যা বলেন আমি তাতেই রাজি হয়ে যাই। ইন্টারভিউ আর কিছুতেই জমে। একসময় তাকে মুখ কালো করে উঠে পড়তে হয়। উঠতে উঠতে তিনি বলেন, আপনার এই সাক্ষাৎকার ছাপার কোনো মানে হয় না। কেউ ইন্টারেস্ট পাবে না। এটা ছাপা হবে না।