পরে একদিন কেষ্টাকে জিঞ্জেস করা হয়েছিল, “হাঁ রে, নবুকে সেদিন তোরা অমন করলি কেন?” কেষ্টা বলল, “ঐ দাশুটাই তো শিখিয়েছিল ওরকম করতে। আর বলেছিল, ‘তা হলে এক সের জিলিপি পাবি’!” আমরা বললাম, “কই, আমাদের তো ভাগ দিলি নে?” কেষ্টা বলল, “সে কথা আর বলিস কেন? জিলিপি চাইতে গেলুম, হতভাগা বলে কিনা ‘আমার কাছে কেন? ময়রার দোকানে যা, পয়সা ফেলে দে, যত চাস জিলিপি পাবি’।”
আচ্ছা, দাশু কি সত্যি সত্যি পাগল, না, কেবল মিচ্কেমি করে?
(সন্দেশ- চৈত্র, ১৩২৪ বঃ)
দাশুর খ্যাপামি
ইস্কুলের ছুটির দিন । ইস্কুলের পরেই ছাত্র-সমিতির অধিবেশন হবে, তাতে ছেলেরা মিলে অভিনয় করবে । দাশুর ভারি ইচ্ছে ছিল, সে-ও একটা কিছু অভিনয় করে । একে-ওকে দিয়ে সে অনেক সুপারিশ করিয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই কোমর বেঁধে বললাম, সে কিছুতেই হবে না ।
সেইতো গতবার যখন আমাদের অভিনয় হয়েছিল, তাতে দাশু সেনাপতি সেজেছিল ; সেবার সে অভিনয়টা একেবারে মাটি করে দিয়েছিল । যখন ত্রিচূড়ের গুপ্তচর সেনাপতির সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান করে বলল, “সাহস থাকিলে খোল তলোয়ার !” দাশুর তখন “তবে আয় সম্মুখ সমরে”- ব’লে তখনি তলোয়ার খুলবার কথা । কিন্তু দাশুটা আনাড়ির মতো টানাটানি করতে গিয়ে তলোয়ার তো খুলতেই পারল না, মাঝ থেকে ঘাবরে গিয়ে কথাগুলোও বলতে ভুলে গেল । তাই দেখে গুপ্তচর আবার “খোল তলোয়ার” ব’লে হুঙ্কার দিয়ে উঠল । দাশুটা এমনি বোকা, সে অমনি “দাঁড়া, দেখছিস না বক্লস আটকিয়ে গেছে” ব’লে চেঁচিয়ে তাকে এক ধমক দিয়ে উঠল । ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি তলোয়ার খুলে দিলাম, তা না হলে ঐখানেই অভিনয় বন্ধ হয়ে যেত । তারপর শেষের দিকে রাজা যখন জিজ্ঞেস করলেন, “কিবা চাহ পুরস্কার কহ সেনাপতি,” তখন দাশুর বলবার কথা ছিল “নিত্যকাল থাকে যেন রাজপদে মতি,” কিন্তু দাশুটা তা না ব’লে, তার পরের আরেকটা লাইন আরম্ভ করেই, হঠাৎ জিভ কেটে “ঐ যাঃ ! ভুলে গেছিলাম” ব’লে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল । আমি কটমট করে তাকাতে, সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক লাইনটা আরম্ভ করল ।
তাই এবারে তার নাম হতেই আমরা জোর করে ব’লে উঠলাম, “না, সে কিছুতেই হবে না ।” বিশু বলল, “দাশু এক্টিং করবে ? তাহলেই চিত্তির !” ট্যাঁপা বলল, “তার চাইতে ভজু মালিকে ডেকে আনলেই হয় !” দাশু বেচারা প্রথমে খুব মিনতি করল, তারপর চটে উঠল, তারপর কেমন যেন মুষড়ে গিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল । যে কয়দিন আমাদের তালিম চলছিল, দাশু রোজ এসে চুপটি করে হলের এক কোনায় বসে বসে আমদের অভিনয় শুনত । ছুটির কয়েকদিন আগে থেকে দেখি, ফোর্থ ক্লাশের ছাত্র গণশার সঙ্গে দাশুর ভারি ভাব হয়ে গেছে। গনশা ছেলেমানুষ, কিন্তু সে চমচমৎকার আবৃত্তি করতে পারে-তাই তাকে দেবদূতের পার্ট দেওয়া হয়েছে। দাশু রোজ তাকে নানারকম খাওয়া এনে খাওয়ায়, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই এনে দেয়, আর বলে যে ছুটির দিন তাকে একটা ফুটবল কিনে দেবে। হঠাৎ গণশার উপর দাশুর এতখানি টান হবার কোন কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না । কেবল দেখতে পেলাম, গণশা খেলনা আর খাবার পেয়ে ভুলে ‘দাশুদা’র একজন পরম ভক্ত হয়ে উঠতে লাগল ।
ছুটির দিনে আমরা যখন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল । আড়াইটা বাজতে না বাজতেই দেখা গেল, দাশুভায়া সাজঘরে ঢুকে পোশাক পরতে আরম্ভ করেছে । আমরা জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে ? তুই এখানে কি করছিস ?” দাশু বলল “বাঃ, পোশাক পরব না ?” আমি বললাম, “পোশাক পরবি কিরে? তুই তো আর এক্টিং করবি না ।” দাশু বলল, “বাঃ, খুব তো খবর রাখ । আজকে দেবদূত সাজবে কে জানো ?” শুনে হঠাৎ আমাদের মনে কেমন একটা খটকা লাগল, আমি বললাম, “কেন গণশার কি হল ?” দাশু বলল, কি হয়েছে তা গণশাকে জিজ্ঞেস করলেই পারো ?” তখন চেয়ে দেখি সবাই এসেছে, কেবল গণশাই আসেনি । অমনি রামপদ, বিশু আর আমি ছুটে বেরোলাম গণশার খোঁজে ।
সারা ইস্কুল খুঁজে, শেষটায় টিফিনঘরের পিছনে হতভাগাকে ঝুঁজে পাওয়া গেল । সে আমাদের দেখেই পালাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমরা তাকে চটপট গ্রেপ্তার করে টেনে নিয়ে চললাম । গণশা কাঁদতে লাগল, “না আমি কক্ষনো এক্টিং করব না, তাহলে, দাশুদা আমায় ফুটবল দেবে না ।” আমরা তবু তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় অঙ্কের মাস্টার হরিবাবু সেখানে এসে উপস্থিত । তিনি আমাদের দেখেই ভয়ঙ্কর চোখ লাল করে ধমক দিয়ে উঠলেন, “তিন-তিনটে ধাড়ি ছেলে মিলে ঐ কচি ছেলেটার পিছনে লেগেছিস ? তোদের লজ্জাও করে না ?” ব’লেই আমাকে বিশুকে এক একটি চড় মেরে আর রামপদর কান ম’লে দিয়ে হন্হন্ করে চলে গেলেন । এই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে গণেশ্চন্দ্র আবার চম্পট দিল । আমরাও আপমানটা হজম করে ফিরে এলাম । এসে দেখি, দাশুর সঙ্গে রাখালের মহা ঝগড়া লেগে গেছে । রাখাল বলছে, “তোকে আজ কিছুতেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হবে না ।” দাশু বলছে, “বেশ তো, তাহলে আর কেউ সাজুক, আমি রাজা কিম্বা মন্ত্রী সাজি । পাঁচ-ছটা পার্ট আমার মুখস্থ হয়ে আছে ।” এমন সময় আমরা এসে খবর দিলাম, যে, গণশাকে কিছুতেই রাজী করানো গেল না । তখন অনেক তর্কবিতর্ক আর ঝগড়াঝাটির পর স্থির হল যে, দাশুকে আর ঘাঁটিয়ে দরকার নেই, তাকেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হোক । শুনে দাশু খুব খুশি হল আর আমাদের শাসিয়ে রাখল যে, “আবার যদি তোরা গোলমাল করিস, তাহলে কিন্তু গতবারের মতো সব ভুণ্ডুল করে দেব ।”
তারপর অভিনয় আরম্ভ হল । প্রথম দৃশ্যে দাশু কিছু গোলমাল করেনি, খালি স্টেজের সামনে একবার পানের পিক্ ফেলেছিল । কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে এসে সে একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল । এক জায়গায় তার খালি বলবার কথা “দেবতা বিমুখ হলে মানুষ কি পারে ?” কিন্তু সে এক কথাটুকুর আগে কোত্থেকে আরও চার-পাঁচ লাইন জুড়ে দিল ! আমি তাই নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, দাশু বলল, “তোমরা যে লম্বা বক্তৃতা কর সে বেলা দোষ হয় না, আমি দুটো কথা বেশি বললেই যত দোষ !” এও সহ্য করা যেত, কিন্তু শেষ দৃশ্যের সময় তার মোটেই আসবার কথা নয়, তা জেনেও সে স্টেজে আসবার জন্য জেদ ধরে বসল । আমরা অনেক কষ্টে অনেক তোয়াজ করে তাকে বুঝিয়ে দিলাম যে, শেষ দৃশ্যে দেবদূত আসতেই পারে না, কারণ তার আগের দৃশ্যেই আছে যে, দেবদূত বিদায় নিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন । শেষ দৃশ্যেও আছে যে মন্ত্রী রাজাকে সংবাদ দিচ্ছেন যে, দেবদূত মহারাজাকে আশীর্বাদ করে স্বর্গপুরীতে প্রস্থান করেছেন । দাশু অগত্যা তার জেদ ছাড়ল বটে, কিন্তু বোঝা গেল সে মনে মনে একটুও খুশি হয়নি ।
শেষ দৃশ্যের অভিনয় আরম্ভ হল । প্রথম খানিকটা অভিনয়ের পর মন্ত্রী এসে সভায় হাজির হবেন । এ কথা সে কথার পর তিনি রাজাকে সংবাদ দিলেন, “বারবার মহারাজে আশিস্ করিয়া, দেবদূত গেল চলি স্বর্গ অভিমুখে ।” বলতে বলতেই হঠাৎ কোত্থেকে “আবার সে এসেছে ফিরিয়া” ব’লে একগাল হাসতে হাসতে দাশু একেবারে সামনে এসে উপস্থিত । হঠাৎ এ রকম বাধা পেয়ে মন্ত্রী তার বক্তৃতার খেই হারিয়ে ফেলল, আমরাও সকলে কি রকম যেন ঘাবড়িয়ে গেলাম- অভিনয় হঠাৎ বন্ধ হবার যোগার হয়ে এল । তাই দেখে দাশু সর্দারি করে মন্ত্রীকে বলল, “বলে যাও কি বলিতেছিলে ।” তাতে মন্ত্রী আরও কেমন ঘাবড়িয়ে গেল । রাখাল প্রতিহারী সেজেছিল, দাশুকে কি যেন বলবার জন্যে যেই একটু এগিয়ে গেছে, অমনি দাশু “চেয়েছিল জোর করে ঠেকাতে আমারে এই হতভাগা”- বলে এক চাঁটি মেরে তার মাথার পাগড়ি ফেলে দিল । ফেলে দিয়েই সে রাজার শেষ বক্তৃতাটা- “এ রাজ্যতে নাহি রবে হিংসা অত্যাচার, নাহি রবে দারিদ্র যাতনা” ইত্যাদি- নিজেই গড়গড় করে ব’লে গিয়ে, “যাও সবে নিজ নিজ কাজে” ব’লে অভিনয় শেষ করে দিল । আমরা কি করব বুঝতে না পেরে সব বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । ওদিকে ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল আর ঝুপ্ করে পর্দাও নেমে গেল ।
আমরা সব রেগে-মেগে লাল হয়ে দাশুকে তেড়ে ধরে বললাম, “হতভাগা, দ্যাখ দেখি সব মাটি করলি, অর্ধেক কথাই বলা হল না ।” দাশু বলল, বা, তোমরা কেউ কিছু বলছ না দেখেই তো আমি তাড়াতাড়ি যা মনে ছিল সেইগুলো বলে দিলাম । তা না হলে তো আরো সব মাটি হয়ে যেত ।” আমি বললাম, তুই কেন মাঝখানে এসে গোল বাধিয়ে দিলি ? তাইতো সব ঘুলিয়ে গেল ।” দাশু বলল, রাখাল কেন বলেছিল যে আমায় জোর করে আটকিয়ে রাখবে ? তা ছাড়া তোমরা কেন আমায় গোরা থেকে নিতে চাচ্ছিলে না আর ঠাট্টা করছিলে ? আর রামপদ কেন বারবার আমার দিকে কটমট করে তাকাচ্ছিল ?” রামপদ বলল, ওকে ধরে ঘা দু চার লাগিয়ে দে ।”
দাশু বলল, “লাগাও না, দেখবে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে সকলকে হাজির করি কি না? “
দুই বন্ধু
এক ছিল মহাজন, আর এক ছিল সওদাগর। দুজনে ভারি ভাব। একদিন মহাজন এক থলি মোহর নিয়ে তার বন্ধুকে বলল, “ভাই, ক’দিনের জন্য শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি; আমার কিছু টাকা তোমার কাছে রাখতে পারবে?” সওদাগর বলল, “পারব না কেন? তবে কি জানো, পরের টাকা হাতে রাখা আমি পছন্দ করি না। তুমি বন্ধু মানুষ, তোমাকে আর বলবার কী আছে, আমার ঐ সিন্দুকটি খুলে তুমি নিজেই তার মধ্যে তোমার টাকাটা রেখে দাও— আমি ও টাকা ছোঁব না।” তখন মহাজন তার থলে ভরা মোহর সেই সওদাগরের সিন্দুকের মধ্যে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি গেল।
এদিকে হয়েছে কি, বন্ধু যাবার পরেই সওদাগরের মনটা কেমন উস্খুস্ করছে। সে কেবলই ঐ টাকার কথা ভাবছে আর তার মনে হচ্ছে যে বন্ধু না জানি কত কী রেখে গেছে! একবার খুলে দেখতে দোষ কি? এই ভেবে সে সিন্দুকের ভীতর উঁকি মেরে থলিটা খুলে দেখল— থলি ভরা চক্চকে মোহর! এতগুলো মোহর দেখে সওদাগরের ভয়ানক লোভ হল— সে তাড়াতাড়ি মোহরগুলো সরিয়ে তার জায়গায় কতগুলো পয়সা ভরে থলিটাকে বন্ধ ক’রে রাখল।
দশ দিন পরে তার বন্ধু যখন ফিরে এল, তখন সওদাগর খুব হাসিমুখে তার সঙ্গে গল্প-সল্প করল, কিন্তু তার মনটা কেবলই বলতে লাগল, “কাজটা ভালো হয়নি। বন্ধু এসে বিশ্বাস করে টাকাটা রাখল, তাকে ঠকানো উচিত হয়নি।” একথা সেকথার পর মহাজন বলল, “তাহলে বন্ধু, আজকে টাকাটা নিয়ে উঠি— সেটা কোথায় আছে?” সওদাগর বললে, “হ্যাঁ বন্ধু, সেটা নিয়ে যাও। তুমি যেখানে রেখেছিলে সেইখানেই পাবে— আমি থলিটা আর সরাইনি।” বন্ধু তখন সিন্দুক খুলে তার থলিটা বের ক’রে নিল। কিন্তু, কি সর্বনাশ! থলিভরা মোহর ছিল, সব গেল কোথায়? সব যে কেবল পয়সা! মহাজন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল!
সওদাগর বলল, “ওকি বন্ধু! মাটিতে বসলে কেন?” বন্ধু বলল, “ভাই, সর্বনাশ হয়েছে! আমার থলিভরা মোহর ছিল— এখন দেখছি একটাও মোহর নাই, কেবল কতগুলো পয়সা!” সওদাগর বলল, “তাও কি হয়? মোহর কখনও পয়সা হয়ে যায়?” সওদাগর চেষ্টা করছে এরকম ভাব দেখাতে যেন সে কতই আশ্চর্য হয়েছে; কিন্তু তার বন্ধু দেখল তার মুখখানা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে তার আর বাকি রইল না— তবু সে কোনো রকম রাগ না দেখিয়ে হেসে বলল, “আমি তো মোহর মনে করেই রেখেছিলাম— এখন দেখছি কোথাও কোনো গোল হয়ে থাকবে। যাক যা গেছে তা গেছেই— সে ভাবনায় আর কাজ নেই।” এই বলে সে সওদাগরের কাছে বিদায় নিয়ে পয়সার থলি বাড়িতে নিয়ে গেল। সওদাগর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
দু’মাস পরে হঠাৎ একদিন মহাজন তার বন্ধুর বাড়িতে এসে বলল, “বন্ধু, আজ আমার বাড়িতে পিঠে হচ্ছে— বিকেলে তোমার ছেলেটিকে পাঠিয়ে দিও!” বিকালবেলা সওদাগর তার ছেলেকে নিকে মহাজনের বাড়িতে রেখে এল, আর বলল, “সন্ধ্যার সময় এসে নিয়ে যাব।” মহাজন করল কি, ছেলেটার পোশাক বদলিয়ে তাকে কোথায় লুকিয়ে রাখল— আর একটা বাঁদরকে সেই ছেলের পোশাক পরিয়ে ঘরের মধ্যে বসিয়ে দিল।
সন্ধ্যার সময় সওদাগর আসতেই তার বন্ধু এসে মুখখানা হাঁড়ির মতো করে বলল, “ভাই! একটা বড় মুশকিলে পড়েছি। তোমার ছেলেটিকে তুমি যখন দিয়ে গেলে, তখন দেখলাম দিব্যি কেমন নাদুস-নুদুস ফুটফুটে চেহারা— কিন্তু এখন দেখছি কি রকম হয়ে গেছে— ঠিক যেন বাঁদরের মতো দেখাচ্ছে! কি করা যায় বলত বন্ধু!” ব্যাপার দেখে সওদাগরের তো চক্ষুস্থির! সে বলল, “কি পাগলের মতো বক্ছ? মানুষ কখনও বাঁদর হয়ে যায়?” মহাজন অত্যন্ত ভালো মানুষের মতো বলল, “কি জানি ভাই! আজকাল কি সব ভূতের কাণ্ড হচ্ছে, কিছু বুঝবার যো নেই। এই দেখ না সেদিন আমার সোনার মোহরগুলো খামখা বদলে সব তামার পয়সা হয়ে গেল। অদ্ভুত ব্যাপার!”
তখন সওদাগর রেগে বন্ধুকে গালাগালি দিয়ে কাজির কাছে দৌড়ে গেল নালিশ করতে। কাজির হুকুমে চার-চার প্যায়দা এসে মহাজনকে পাকড়াও ক’রে কাজির সামনে হাজির করল। কাজি বললেন, “তুমি এর ছেলেকে নিয়ে কী করেছ?” শুনে চোখ দুটো গোল ক’রে মস্ত বড় হাঁ ক’রে মহাজন বলল, “আমি? আমি মুখ্যু-সুখ্যু মানুষ, আমি কি অত সব বুঝতে পারি? হুজুর! ওর বাড়িতে মোহর রাখলাম, দশদিনে সব পয়সা হয়ে গেল। আবার দেখুন ওর ছেলেটা আমার বাড়িতে আসতে না আসতেই ল্যাজ্-ট্যাজ্ গজিয়ে দস্তুরমতো বাঁদর হয়ে উঠেছে। কি রকম যে হচ্ছে— আমার বোধ হয় সব ভূতুড়ে কাণ্ড।” এই ব’লে সে কাজিকে লম্বা সেলাম করতে লাগল।
কাজিও চালাক লোক, ব্যাপার বুঝতে তাঁর বাকি রইল না। তিনি বললেন, “আচ্ছা, তোমারা ঘরে যাও। আমি দৈবজ্ঞ ফকির ডাকিয়ে মন্ত্র পড়ে ভূত ঝাড়িয়ে সব সায়েস্তা করছি। তোমার পয়সার থলি ওর কাছে দাও— আর তোমার বাঁদর ছেলেকে এর কাছেই রাখ। কাল সকালের মধ্যে সব যদি ঠিক না হয় তবে বুঝব এতে তোমাদের কারুর শয়তানি আছে। সাবধান! তাহলে তোমার পয়সাও পাবে না, মোহরও পাবে না— আর তোমার ছেলে তো মরবেই, ছেলের বাপ মা খুড়ো জ্যাঠা সবসুদ্ধ মেরে সাবাড় করব।”
সওদাগর পয়সার থলি সঙ্গে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঘরে চলল। মহাজন বাঁদর নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল। ভোর না হতেই সওদাগর থলির মধ্যে আবার মোহর ভ’রে মহাজনের বাড়ি গিয়ে বলছে, “বন্ধু! বন্ধু! কি আশ্চর্য দেখে যাও! তোমার পয়সাগুলো আবার মোহর হয়েছে।” মহাজন বলল, “তাই নাকি? কি আশ্চর্য এদিকে সে বাঁদরটাও আবার তোমার খোকা হয়ে গেছে।” তারপর মোহরের থালি নিয়ে সওদাগরের ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে মহাজন বলল, “দেখ্ জোচ্চোর! ফের আমায় ‘বন্ধু’ ‘বন্ধু’ বলবি তো মেরে তোর থোঁতামুখ ভোঁতা ক’রে দেব।”
দেবতার দুর্বুদ্ধি
স্বর্গের দেবতারা যেখানে থাকেন, সেখান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসবার একটিমাত্র পথ; সে পথ রামধনুকের তৈরী। জলের রঙে আগুন আর বাতাসের রং মিশিয়ে দেবতারা সে পথ বানিয়েছেন। আশ্চর্য সুন্দর সেই পথ, স্বর্গের দরজা থেকে নামতে নামতে পৃথিবী ফুঁড়ে পাতাল ফুঁড়ে কোন অন্ধকার ঝরণার নিচে মিলিয়ে গেছে। কোথাও তার শেষ নেই।
পথটি পেয়ে দেবতাদের আনন্দও হল, ভয়ও হল। ভয় হল এই ভেবে যে, ঐ পথ বেয়ে দুর্দান্ত দানবগুলো যদি স্বর্গে এসে পড়ে! দেবতারা সব ভাবনায় বসেছেন, এমন সময় চারদিক ঝলমলিয়ে, আলোর মত পোশাক প’রে, হীমদল এসে হাজির হলেন। হীমদল কে? হীমদল হলেন আদি দেবতা অদীনের ছেলে। তাঁর মায়েরা নয়টি বোন, সাগরের মেয়ে। তাঁদের কাছে পৃথিবীর বল, সমুদ্রের মধু, আর সূর্যের তেজ খেয়ে তিনি মানুষ হয়েছেন। তাঁকে দেখেই দেবতারা সব ব’লে উঠলেন, “এস হীমদল, এস মহাবীর, আমাদের রামধনুকের প্রহরী হয়ে স্বর্গদ্বারের রক্ষক হও।”
সেই অবধিই হীমদলের আর অন্য কাজ নেই, তিনি যুগযুগান্তর রাত্রিদিন স্বর্গদ্বারে প্রহর জাগেন। ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই, একটিবার পলক ফেললেই বহুদিনের সমস্ত শ্রান্তি জুড়িয়ে যায়। রামধনুকের ছায়ার নিচে সারারাত শিশির ঝরে, তার একটি কণাও হীমদলের চোখ এড়ায় না। পাহাড়ের গায়ে গায়ে সবুজ কচি ঘাস গজায়, হীমদল কান পেতে তার আওয়াজ শোনেন। ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে ঢুকবে এমন কারও সাধ্যি নেই। হাতে তাঁর এক শিঙের বাঁশি, সেই বাঁশিতে ফুঁ দিলে স্বর্গ মর্ত পাতাল জুড়ে হুঙ্কার বাজবে, “সাবধান! সাবধান!”—সেই সঙ্গে ত্রিভুবনের সকল প্রাণী কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠবে। এমনি করে প্রস্তুত হয়ে হীমদল সেখানে পাহারা দিতে লাগলেন।
কিন্তু দেবতাদের মনের ভয় তবুও কিছু কমল না। তাঁরা বললেন, “বিপদ বুঝে সাবধান হয়েও যদি বাইরের শত্রুকে ঠেকাতে না পারি, তখন আমাদের উপায় হবে কি? যদি বাঁচতে হয় ত’ অক্ষয়দুর্গ গড়তে হবে। আকাশজোড়া স্বর্গটিকে দুর্গ দিয়ে ঘিরতে হবে।” কিন্তু, তেমন দুর্গ বানাবে কে? নানাজনে নানারকম মন্ত্রণা দিচ্ছেন, কিন্তু কোন কিছুই মীমাংসা হচ্ছে না। এমন সময় কোথাকার এক অজানা কারিগর এসে খবর দিল, হুকুম পেলে আর বকশিশ পেলে সে অক্ষয়দুর্গ বানাতে পারে। হিমের অসুর ঋমতুরষ্ যে ছদ্মবেশে কারিগর হয়ে এসেছেন, দেবতারা তা বুঝতে পারলেন না। তাঁরা বললেন, “কি রকম তুমি বকশিশ চাও?” কারিগর বলল, “চন্দ্র চাই, সূর্য চাই, আর স্বর্গের মেয়ে ফ্রেয়াকে চাই।”
আবদার শুনে দেবতারা সব রেগে উঠলেন। সবাই বললেন, “বেয়াদবকে দূর করে দাও।” কিন্তু দেবতাদের মধ্যে একজন ছিলেন, তাঁর নাম লোকী; তিনি সকম রকম দুর্বুদ্ধির দেবতা। লোকী বললেন, “আচ্ছা, কাজটা আগে করিয়ে নিই না—তারপর দেখা যাবে।” দুষ্ট দেবতার কূট মন্ত্রণা শুনে দেবতারা সব ঋম্তুরষ্কে বললেন, “তুমি চন্দ্র পাবে, সূর্য পাবে, দেবকন্যা ফ্রেয়াকে পাবে, যদি একলা তোমার ঘোড়ার সাহায্যে শীতকালের মধ্যে এ কাজটাকে শেষ করতে পার।” ছদ্মবেশী অসুর বলল, “অতি উত্তম! এই কথাই ঠিক রইল।”
সেদিন থেকে ঋম্তুরষের বিশ্রাম নেই। সারাদিন সে পাথর ব’য়ে ঘোড়াকে দিয়ে স্বর্গে তোলায়, সারারাত দুর্গ বানায়। দেবতারা ঠিক যেমন বলে দিয়েছেন, তেমনি করে পাথরের পর পাথর জুড়ে আকাশ ফুঁড়ে অক্ষয়দুর্গ গড়ে উঠেছে। শীত যখন ফুরোয় ফুরোয়, তখন দেবতারা দেখলেন, সর্বনাশ! দুর্গের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে, একটিমাত্র ফটক বাকি—সে ত শুধু একদিনের কাজ! এখন উপায়? এতদিনের চন্দ্র সূর্য স্বর্গ থেকে খসে পড়বে? সুন্দরী ফ্রেয়া শেষটায় অজানা এক কারিগরকে বিয়ে করবে? ভয়ে ভাবনায় ক্ষেপে গিয়ে সবাই বললে, “হতভাগা লোকীর কথায় আমাদের এই বিপদ হল, ও এখন এর উপায় করুক, তা না হলে ওকেই আমরা মেরে ফেলব।”
লোকী আর করবে কি? সন্ধ্যা হতেই সে স্বর্গ হতে বেরিয়ে দেখল, অনেক দূরে মেঘের নিচে কারিগরের ঘোড়া পাহাড়ের সমান পাথর টেনে ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। লোকী তখন মায়াবলে আকাশ-ঘোটকীর রূপ ধ’রে চিঁহি চিঁহি ক’রে অদ্ভুত সুরে ডাকতে ডাকতে একটা বনের ভিতর থেকে দৌড়ে বেরুল। সেই শব্দে ঋম্তুরষের ঘোড়া চম্কে উঠে, লাগাম ছিঁড়ে, সাজ খসিয়ে, উর্ধ্বমুখে মন্ত্রে-চালান পাগলের মত ছুটে চলল। দিক-বিদিকের বিচার নেই, পথ-বিপথের খেয়াল নেই, আকাশের কিনারা দিয়ে, আধাঁরের ভিতর দিয়ে, বনের পর বন, পাহাড়ের পর পাহাড়, কেবল ছুট্ ছুট্ ছুট্। লোকীও ছুটেছে, ঘোড়াও ছুটেছে, আর ‘হায় হায়’ চিৎকার ক’রে পিছন পিছন ঋম্তুরষ ছুটে চলেছে। এমনি করে শীতকালের শেষ রাত্রি প্রভাত হল, দুষ্ট দেবতা শূন্যে কোথায় মিলিয়ে গেল, অসুর এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘোড়া ধরল। তখন বসন্তের প্রথম কিরণে পুবের মেঘে রং ধরেছে, দক্ষিণ বাতাহ জেগে উঠেছে।
অসুর বুঝল এ সমস্তই দেবতার ফাঁকি। কোথায় বা চন্দ্র সূর্য, কোথায় বা দেবকন্যা ফ্রেয়া! এতদিনের পরিশ্রম সব একেবারেই পণ্ড। ভাবতে ভাবতে অসুরের মাথা গরম হল, ভীষণ রাগে কাঁপতে কাঁপতে দেবতাদের সে মারতে চলল। দূর থেকে তার মূর্তি দেখেই দেবরাজ থর্ বুঝলেন, অসুর আসছে স্বর্গপুরী ধ্বংস করতে। তিনি তখন ব্যস্ত হয়ে তাঁর বিরাট হাতুড়ি ছুঁড়ে মারলেন। অসুরের বিশাল দেহ চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ল।
কিন্তু, দেবতাদের মনে আর শান্তি রইল না। এই অন্যায় কাজের জন্য তাঁরা লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে দিন কাটাতে লাগলেন। দেবতাদের মুখ মলিন দেখে সাগরের দেবতা ঈগিন বললেন, “আমার প্রবালপুরীতে রাজভোজ হবে, তোমরা এস—ভাবনাচিন্তা দূর কর।” দেবতাদের সবাই এলেন, কেবল লোকীকে কেউ খবর দিল না। সবাই যখন ভোজে বসেছেন, লোকী তখন জানতে পেরে ভোজের সভায় হাজির হয়ে সকলকে গাল দিতে দিতে বিনা দোষে ঈগিনের প্রিয় দাস ফন্ফনকে মেরে ফেলল। দেবতারা অনেক দিন অনেক সয়েছেন, আজকে তাঁরা সহ্য করতে পারলেন না। লোকীর সমস্ত অন্যায় অত্যাচারের কথা তাঁদের মনে পড়ল। তাঁরা বললেন, “এই লোকীর জন্য স্বর্গের সর্বনাশ হচ্ছে। এই হিংসুকে লোকী থরের স্ত্রীর সোনার চুল চুরি করেছিল; এই কাপুরুষ লোকীই বাজি রেখে নিজের মুণ্ড পণ ক’রে বাজি হেরে পালিয়েছিল; এই বিশ্বাসঘাতক লোকীই স্বর্গের অমৃতফল আসুরের হাতে দিয়েছিল; এই হতভাগা লোকীই ফ্রেয়াকে রাক্ষসের কাছে পাঠাতে চেয়েছিল; এই চোর লোকীই ফ্রেয়ার গলার সোনার হার সরাতে গিয়ে হীমদলের হাতে সাজা পেয়েছিল; এই পাষণ্ড লোকীই নিষ্পাপ বলোদরের মৃত্যুর কারণ! এই লোকী পৃথিবীতে গিয়ে অত্যাচার করে, পাতালে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে মন্ত্রণা করে! মারো এই অপদার্থকে।” লোকী প্রাণভয়ে পালাতে গেল কিন্তু স্বয়ং দেবরাজ থর আর আদি দেবতা অদীন যখন তাঁর পিছনে ছুটলেন, তখন সে আর পালাবে কোথায়? বিষের ঝরণার নিচে হাত-পা বেঁধে লোকীকে ফেলে রাখা হল। লোকীর স্ত্রী সিগীন যতক্ষণ ঝরণাতলায় পাত্রে ক’রে বিষ ধরেন আর ফেলে দেন, ততক্ষণ লোকী একটু আরাম পায়; আর সিগীন যদি মুহূর্তের জন্য খেতে যান কি ঘুমিয়ে পড়েন, তবে বিষের যন্ত্রণায় লোকীর আর সোয়াস্তি থাকে না।
দেবতারা ভাবলেন, স্বর্গের পাপ দূর হল, স্বর্গে এবার শান্তি এল। কিন্তু হায়! তার অনেক আগেই পাপের মাত্রা পূর্ণ হয়েছে। লোকীর জন্য স্বর্গের পাপ মর্তে নেমেছে, পাতালে ঢুকে অসুর পিশাচ দৈত্য দানব সবগুলোকে জাগিয়ে তুলেছে। যে বনের লোহার গাছে লোহার পাতা, সেই বনের ছায়ায় বসে লোকীর রাক্ষসী স্ত্রী অঙ্গুর্বদা নেকড়ে-মুখো পিশাচ-রাহুদের যত্ন ক’রে পাপীর হাড় আর পাপীর মজ্জা খাইয়ে খাইয়ে বাড়িয়ে তুলছে। তারা চন্দ্র সূর্যের পিছন পিছন যুগের পর যুগ ছুটে বেড়ায়। এতদিনে খেয়ে খেয়ে তাদের মূর্তি এমন ভীষণ হল যে চন্দ্র সূর্য ম্লান হয়ে কাঁপতে লাগল, পৃথিবী চৌচির হয়ে ফেটে উঠল, আকাশের নক্ষত্রেরা খসে খসে পড়তে লাগল। পাতালের রক্তকুকুর আর রাহুর বাপ ফেন্রিস বিকট শব্দে ছুটে বেরুল। লোকী তার বাঁধন ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। সৃষ্টির মেরুদণ্ড য়গদ্রাসিল বা জগৎতরুর শিকড় কেটে মহানাগ নিধুগ বিকট মূর্তিতে বেরিয়ে এল। আর তারই সঙ্গে ভীষণ শব্দে হীমদলের শিঙার আওয়াজ বেজে উঠল—সাবধান! সাবধান! সাবধান!
দেবতারা সব ঘুমের থেকে লাফিয়ে উঠে রামধনুকের রঙিন পথে নেমে আসলেন। যে বিরাট সাপ সমুদ্রের গভীর গুহায় দেবতার ভয়ে লুকিয়ে ছিল, সে আজ সমুদ্রের জল তোলপাড় করে বেরিয়ে এল। হিমের দেশের আসুররা সব ঝাপসা ধোঁয়ার বর্ম প’রে কুয়াশায় চ’ড়ে এগিয়ে এল। অগ্নিপুরীর দৈত্যদানব মশাল জ্বেলে চারিদিক রাঙিয়ে এল। তারপর আকাশ চিরে দৈত্যরাজ সূর্ত্র এলেন; আগুনের শিখার মত, প্রলয়ের উল্কার মত, এসেই তিনি স্বর্গদ্বারের সেতুর উপরে দলেবলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আর রামধনুকের রঙিন সেতু কাচের মত গুঁড়িয়ে গেল।
তারপরেই প্রলয় যুদ্ধ। আদি দেবতা অদীনের একটি মাত্র চোখ, আর নেকড়ে অসুর ফেন্রিসের সঙ্গে লড়তে গিয়েই বিপদে পড়লেন। রাহুর বাপ ফেন্রিস, তার মা হল রাক্ষসী অঙ্গুর্বদা আর বাপ স্বয়ং লোকী। অসুরের প্রকাণ্ড দেহ যুদ্ধের উৎসাহে বাড়তে বাড়তে পাহাড় পর্বত ছাড়িয়ে উঠল; তার রক্তমাখা হাঁ-করা মুখে অদীন একবার ঢুকে গেলেন; আর তাঁকে পাওয়াই গেল না। ফ্রেয়ার ভাই মহাবীর ফ্র গোলমালে তাঁর অজেয় খড়্গ খুঁজেই পেলেন না; তিনি সূর্ত্রের হাতে প্রাণ হারালেন। দেবরাজ থর ভীষণ হাতুড়ির ঘায়ে সমুদ্রের বিরাট সাপকে খণ্ড খণ্ড করে আপনি তার বিষাক্ত রক্তে ডুবে গেলেন। এদিকে অদীনের পুত্র বিদার এসে পিতৃঘাতী ফেন্রিস্কে দুই টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন। বড় বড় দেবতা অসুর একে একে সবাই যখন প্রায় শেষ হয়েছে, তখন সূর্ত্রের হাত থেকে আগুনের খড়্গ ছুটে গিয়ে স্বর্গে মর্তে পাতালে প্রলয়ের আগুন জ্বেলে দিল। গাছপালা পুড়ে গেল, নদীর জল শুকিয়ে গেল, স্বর্গের সোনার পুরী ভস্ম হয়ে মিলিয়ে গেল। তারপর সব যখন ফুরিয়ে গেল তখন বিদার দেখলেন, বড় বড় দেবতা অসুর কেউ আর বাকি নেই। কেবল থরের দুই ছেলে যুদ্ধের শ্মশানে থরের হাতুড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছে!
আর লোকী? বিশ্বাসঘাতক লোকী অসুরের দলের মধ্যে ম’রে রয়েছে—হীমদলের খড়্গ তার বুকে বসান। হীমদলও মহাযুদ্ধে অবসন্ন হয়ে বীরের মত রক্তাক্ত বেশে মরে আছেন।
দেবতার সাজা
থর্ নরওয়ে দেশের যুদ্ধ দেবতা।
যুদ্ধের দেবতা কিনা, তাই তাঁর গায়ে অসাধারণ জোর। তাঁর অস্ত্র একটা প্রকাণ্ড হাতুড়ি। সেই সর্বনেশে হাতুড়ির এক ঘা খেলে পাহাড় পর্যন্ত গুঁড়ো হ’য়ে যায়, কাজেই স হাতুড়ির সামনে কেউ এগুতে সাহস পায় না। তার উপর থরের একটা কোমর-বন্ধ ছিল, সেটাকে কোমরে বেঁধে নিলে তাঁর গায়ের জোর দ্বিগুণ বেড়ে যেত।
থরের মনে ভারি অহঙ্কার, তাঁর সমান বীর আর তাঁর সমান পালোয়ান পৃথিবীতে বা স্বর্গে আর কেউ নেই।
একদিন থর্ দেখলেন, একটা পাহাড়ের পাশে একটা প্রকাণ্ড দৈত্য ঘুমিয়ে আছে আর এমন নাক ডাকাচ্ছে যে গাছপালা পর্যন্ত ঠক্ঠক্ করে কাঁপছে। থর্ বললেন, “এই বেয়াদব, নাক ডাকাচ্ছিস্ যে?” বলেই হাতুড়ি দিয়ে ধাঁই ধাঁই ক’রে, তার মাথায় তিন ঘা লাগিয়ে দিলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ওই হাতুড়ির অমন ঘা খেয়েও দৈত্যের কিছুই হল না, সে খালি মাথা চুলকিয়ে বলল, “পাখিতে কি ফেলল?”
থর্ আশ্চর্য হ’য়ে বললেন, “তুমি ত খুব বাহাদুর হে, আমার এ হাতুড়ির ঘা সহ্য করতে পারে, এমন লোক যে কেউ আছে, তা আমি জানতাম না।”
দৈত্য বলল, “তা জান্বেন কোত্থেকে, আমাদের দেশে ত যান নি কখন। সেখানে আমার চেয়েও বড়, আমার চেয়েও ষণ্ডা ঢের ঢের দৈত্য আছে।” থর্ বললেন, “বটে? তবে ত আমার একবার সেখানে যেতে হচ্ছে।”
দৈত্য তাঁকে দৈত্যপুরীর পথ দেখিয়ে দিল আর বলল, “দেখবেন, সেখানে গিয়ে বেশি বড়াই টড়াই করবেন না কারণ আপনি যত বড়ই দেবতা হন না কেন, সে দেশে বাহাদুরি করতে গেলে শেষে লজ্জা পেতে হবে।”
দৈত্যপুরীর চারদিকে প্রকাণ্ড বরফের দেয়াল— সে এত বড় যে তার নীচে দাঁড়ালে চুড়ো দেখা যায় না। সেই দেয়ালের এক জায়গায় বড় বড় গরাদ দেওয়া আকাশের মত উঁচু ফটক। থর্ দেখলেন সে ফটক খোলা তার সাধ্য নয়, তাই তিনি দুটো গরাদের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। দেওয়াল-ঘেরা দৈত্যপুরীর রাজসভায় বসে বসে পাহাড়ের মত বড় বড় দৈত্যরা সব গল্প করছে; তাদের মধ্যে সব চেয়ে বড় যে, সেই হ’চ্ছে দৈত্যের রাজা।
দৈত্যরা থর্কে দেখেও যেন দেখেনি এমনিভাবে গল্প করতে লাগল। খানিক পরে দৈত্যরাজ থরের দিকে তাকিয়ে, বড় বড় চোখ ক’রে, যেন কতই আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কেও? আরে, আরে, থর্ নাকি? আপনিই কি সেই দেবতা, যাঁর গায়ে ভয়ানক জোর। তা হবেও বা, শুধু শরীর বড় হ’লেই ত আর গায়ে জোর হয় না? আচ্ছা, আপনার সম্বন্ধে যে সকল ভয়ানক গল্প শুনি সে সব কি সত্যি?”
থর্ বললেন, “সত্যি কিনা, এখনি বুঝবে। ওরে কে আছিস, আমায় একটু জল দে ত, এক চুমুকে কতখানি খাওয়া যায় তোদের একবার দেখিয়ে দি।”
তখন রাজার হুকুমে একটা শিঙায় ক’রে ঠাণ্ডা জল এনে থর্কে দেওয়া হল। রাজা বললেন, “আমাদের মধ্যে বড় বড় পালোয়ান ছাড়া কেউ ওটাকে এক চুমুকে খালি করতে পারে না। সাধারণ দৈত্যরা দুই চুমুকে শেষ করে। তবে যারা নেহাৎ আনাড়ি, তাদের তিন চুমুক লাগে।”
থর্ তাড়াতাড়ি শিঙাটা নিয়ে চোঁ চোঁ ক’রে এমন টান দিলেন যে, মনে হল শিঙা নিশ্চয়ই খালি হ’য়ে গেছে। কিন্তু কি আশ্চর্য! শিঙা যেমন ভর্তি প্রায় তেমনই রইল। থর্ ভারি লজ্জিত হ’য়ে আবার জল খেতে লাগলেন— ঢক্ ঢক্ ঢক্ ঢক্ ঢক্ ঢক্ ঢক্, তবু জল ফুরাল না।
রাজা হো হো ক’রে হেসে বললেন, “তাইত, অনেকটা যে বাকী রাখলেন।”
থর্ তখন রেগে খুব একটা দম নিয়ে আবার চুমুক দিলেন; খাওয়া আর থামে না— পেট ঢাক হ’য়ে নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হ’য়ে এল, কিন্তু জল তবু ফুরাতে চায় না। তখন থর্ আর কি করে? তিনি বললেন, “না, জল খাওয়াতে আর বেশি বাহাদুরী কি? পেটুকের মত খানিকটা জল গিল্লেই ত আর গায়ের জোর প্রমাণ হয় না। দেখি ত আমার মত ভারী জিনিস কে তুলতে পারে।” দৈত্যরাজ বললেন, “তা বেশ ত। একটা সহজ পরীক্ষা দিয়েই আরম্ভ করা যাক্— ওরে, আমার বেড়ালটাকে নিয়ে আয় ত।” বলতেই ছেয়ে রঙের বেড়াল ঘরের মধ্যে ঢুকল। থর্ তাড়াতাড়ি বেড়ালটাকে ঘাড়ে ধ’রে ছুড়ে ফেলতে গেলেন। কিন্তু বেড়ালটা এমনি শক্ত ক’রে মাটি আঁকড়ে রইল যে অনেক টানাটানির পর তার একটি পা মাটি থেকে মাত্র এক আঙুল উঠান গেল!
দৈত্যরাজ বললেন, “না, আমারই অন্যায় হয়েছে। এতটুকু লোক, সে কি ওই ধাড়ি বেড়ালটাকে তুলতে পারে?”
থর্ তখন ভয়ানক চটে গিয়ে বললেন, “বটে! এতটুকু হই আর যাই হই— দেখি ত, কে আমার সঙ্গে কুস্তিতে পারে?”
দৈত্য বলল, তবেই ত মুস্কিলে ফেললেন! আপনার সঙ্গে লড়াই করবার লোক এখন আমি কোথায় পাই? আচ্ছা দেখি— ওরে বুড়ী ঝিটাকে ডেকে আনত।”
মান্ধাতার আমলের এক বুড়ী, তার চুল সব শাদা, তার মুখে দাঁত নেই, গাল-টাল সব তুবড়ে গিয়েছে— সে এল কুস্তি করতে। থর্ ত চটেই লাল! বললেন, “একি, তামাসা পেয়েছ?” দৈত্যরা তাতে আরো হাসতে লাগল। বলল, “ও বুড়ি, থাক্ থাক্, ওকে মারিসনে— ও ভয় পেয়েছে।” থর্ তখন তেড়ে গিয়ে বুড়িকে এক ধাক্কা দিলেন। তাতে বুড়ী তাঁকে ঘাড় ধ’রে মাটিতে বসিয়ে দিল!
থর্ তখন আর কি করেন? লজ্জায় তাঁর মাথা হেঁট হয়ে গেল। সারারাত্রি সে অপমানের কথা ভেবে তাঁর ঘুম হল না। পরদিন সকালবেলাই তিনি বাড়ি চললেন। দৈত্যরাজ খুব খাতির কর তাঁর সঙ্গে সঙ্গে পুরীর ফটক পর্যন্ত এলেন। ফটকের কাছে এসে দৈত্যরাজ হেসে বললেন, “আপনাকে একটা কথা বলছি, কারণ সেটা না বললে অন্যায় হয়। কাল কিন্তু সত্যিই আপনার হার হয় নি। আপনার অহঙ্কার ভাঙবার জন্যই আমরা আপনাকে একটু ফাঁকি দিয়েছি। ঐ যে শিঙাটা দেখলেন, ওটা সমুদ্রের শিঙা। সমস্ত সমুদ্রের জল না ফুরালে ওর জল ফুরায় না। আপনি যে তিন চুমুক দিয়েছিলেন, তাতে কতক জায়গায় সমুদ্রের ধারে চড়া পড়ে গিয়েছে।”
“আর ঐ যে বেড়ালটা কি জানেন? ও হ’চ্ছে ‘স্ক্রাইমিড্’— যে সাপের মত সমস্ত পাহাড় নদী সমুদ্র শুদ্ধ পৃথিবীটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখে! আপনার টানে পৃথিবীটা প্রায় দশখানা হয়ে ফাটবার জোগাড় করে ছিল।”
“আর ঐ বুড়ী ঝি হ’চ্ছে জরা, অর্থাৎ বৃদ্ধ বয়স। বুড়ো বয়সে কা’কে না কাবু করে? আর, কাল সকালে আপনি যে দৈত্যের মাথায় হাতুড়ি মেরেছিলেন আমিই সেই দৈত্য। সে হাতুড়ি আমার মাথায় একটুও লাগে নি। আমি আগে থেকে মাথা বাঁচাবার জন্য এক মায়া পাহাড়ের আড়াল দিয়েছিলাম— ঐ দেখুন আপনার হাতুড়িতে তার কি দুর্দশা হয়েছে।”
থর্ যখন এসব ফাঁকির কথা শুনলেন— তখন তিনি রেগে কাঁপতে লাগলেন। হাতুড়িটাকে মাথার উপরে তুলে বোঁ বোঁ ক’রে ঘুরিয়ে তিনি যেই সেটা ছুঁড়তে যাবেন, অমনি দেখেন— কোথায় দৈত্য, কোথায় পুরী, —চারিদিকে কোথাও কিছু নাই!
মনের রাগ মনে মনেই হজম ক’রে থর্ সেদিন বাড়ি ফিরলেন।
দ্রিঘাংচু
এক ছিল রাজা।