সকলে সুস্থ হইলে পর মাস্টারমহাশয় বলিলেন, “এত চেঁচাইলে কেন?” সকলে চুপ করিয়া রহিল। আবার জিজ্ঞাসা হইল। “কে কে চেঁচাইয়াছিলে?” পাঁচ-সাতটি ছেলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, “শ্যামলাল।” শ্যামলাল যে একা অত মারাত্মক রকম চেঁচাইতে পারে এ কথা কেহই বিশ্বাস করিল না- সুতরাং স্কুলসুদ্ধ ছেলেকে সেদিন স্কুলের পর আটকাইয়া রাখা হইল!
অনেক তম্বিতাম্বার পর একে একে সমস্ত কথা বাহির হইয়া পড়িল। হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কবিতা লেখার রোগ হয়েছে? ও রোগের ওষুধ কি?” বৃদ্ধ পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “বিষস্য বিষমৌষধম্- বিষের ওষুধ বিষ। বসন্তের ওষুধ যেমন বসন্তের টিকা, কবিতার ওষুধ তস্য টিকা। তোমরা যে যা কবিতা লিখেছ তার টিকা করে দিচ্ছি। তোমরা একমাস প্রতিদিন পঞ্চাশবার করে এটা লিখে এনে রোজ আমায় দেখাবে।” এই বলে তিনি টিকা দিলেন-
পদে পদে মিল খুঁজি, গুনে দেখি চোদ্দো
মনে করি লিখিতেছি ভয়ানক পদ্য!
হয় হব ভবভূতি নয় কালিদাস
কবিতার ঘাস খেয়ে চরি বারোমাস।
একমাস তিনি আমাদের কাছে এই লেখা প্রতিদিন পঞ্চাশবার আদায় না করিয়া ছাড়িলেন না। এ কবিতার কি আশ্চর্য গুণ তার পর হইতে কবিতা লেখার ফ্যাশান স্কুল হইতে একেবারেই উঠিয়া গেল।
আশ্চর্য ছবি
জাপান দেশে সেকালের এক চাষা ছিল, তার নাম কিকিৎসুম। ভারি গরীব চাষা, আর যেমন গরীব তেমনি মূর্খ। দুনিয়ার সে কোনও খবরই জানত না; জানত কেবল চাষবাসের কথা, গ্রামের লোকেদের কথা, আর গ্রামের যে বুড়ো ‘বঞ্জে’ (পুরোহিত), তার ভাল ভাল উপদেশের কথা। চাষার যে স্ত্রী, তার নাম লিলিৎসী। লিলিৎসী চমৎকার ঘরকন্না করে, বাড়ির ভিতর সব তক্তকে ঝর্ঝরে করে গুছিয়ে রাখে, আর রান্না করে এমন সুন্দর যে চাষার মুখে তার প্রশংসা আর ধরে না। কিকিৎসুম কেবলই বলে, “এত আমার বয়স হল, এত আমি দেখলাম শুনলাম, কিন্তু রূপে গুণে এর মত আর একটিও কোথাও দেখতে পাইনি।” লিলিৎসী সে কথা যত শোনে ততই খুশী হয়।
একদিন হয়েছে কি, কোথাকার এক শহুরে বড়মানুষ এসেছেন সেই গ্রাম দেখতে; তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর ছোট্ট মেয়েটি, আর মেয়েটির ছিল একটি ছোট্ট আয়না। রাস্তায় চলতে চলতে সেই আয়নাটা সেই মেয়ের হাত থেকে কখন পড়ে গেছে, কেউ তা দেখতে পায়নি। কিকিৎসুম যখন চাষ করে বাড়ি ফিরছে তখন সে দেখতে পেল, রাস্তার ধারে ঘাসের মধ্যে কি একটা চক্চক্ করছে। সে তুলে দেখল, একটা অদ্ভুত চ্যাপ্টা চৌকোনো জিনিস! সে কিনা কখনও আয়না দেখেনি, তাই সে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, এটা আবার কি রে! নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ সেই আরসির ভিতরে নিজের ছায়ার দিকে তার নজর পড়ল। সে দেখল কে একজন অচেনা লোক তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে। দেখে সে এমন চম্কিয়ে উঠল, যে আর একটু হলেই আয়নাটা তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল। তারপর অনেক ভেবে চিন্তে সে ঠিক করল, এটা নিশ্চয়ই আমার বাবার ছবি—দেবতারা আমার উপর খুশী হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার বাবা মারা গিয়েছেন সে অনেক দিনকার কথা, কিন্ত্য তবু তার মনে হল, হ্যাঁ এই রকমই ত তাঁর চেহারা ছিল। তারপর—কি আশ্চর্য! সে চেয়ে দেখল তার নিজের গলায় যেমন একটা রূপার মাদুলি, ছবির গলায়ও ঠিক তেমনি! এ মাদুলি ত তার বাবারই ছিল, তিনি ত সর্বদাই এটা গলায় দিতেন—তবে ত এটা তার বাবারই ছবি।
তখন কিকিৎসুম করল কি, আয়নাটাকে যত্ন করে কাগজ দিয়ে মুড়ে বাড়ি নিয়ে এল। বাড়ি এসে তার ভাবনা হল, ছবিটাকে রাখে কোথায়? তার স্ত্রীর কাছে যদি রেখে দেয়, তবে সে হয়ত পাড়ার মেয়েদের কাছে গল্প করবে, আর গ্রামসুদ্ধ সবাই এসে ছবি দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়বে। গ্রামের মূর্খগুলো ত সে ছবির মর্যাদা বুঝবে না, তারা আসবে কেবল ‘তামাসা’ দেখবার জন্য! তা হবে না—তার বাবার ছবি নিয়ে ছেলেবুড়ো সবাই এসে নোংরা হাতে নাড়বে-চাড়বে তা কিছুতেই হতে পারবে না। এ ছবি কাউকে দেখান হবে না, লিলিৎসীকেও তার কথা বলা হবে না।
কিকিৎসুম বাড়িতে এসে একটা বহুকালের পুরানো ফুলদানির মধ্যে আরসিটাকে লুকিয়ে রাখল। কিন্তু তার মনটা আর কিছুতেই শান্ত হতে চায় না। খানিকক্ষণ পরে পরেই সে একবার করে দেখে যায় ছবিটা আছে কি না। তার পরের দিন সে মাঠে কাজ করছে এমন সময় হঠাৎ তার মনে হল, ‘ছবিটা আছে ত?’ অমনি সে কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে দেখতে এল। দেখে সে নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে যাবে, এমন সময় লিলিৎসী সেই ঘরের এসে পড়েছে। লিলিৎসী বলল, “এ কী! তুমি দুপুরবেলায় ফিরে এলে যে? অসুখ করেনি ত?” কিকিৎসুম থতমত খেয়ে বলল, “না না, হঠাৎ তোমায় দেখতে ইচ্ছে করল তাই বাড়ি এলাম।” শুনে লিলিৎসী ভারী খুশী হয়ে গেল। তারপর আর একদিন এইরকম লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি দেখতে এসে কিকিৎসুম আবার তার স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ল। সেদিনও সে বলল, “তোমার ঐ সুন্দর মুখখানা বার বার মনে হচ্ছিল, তাই একবার ছুটে দেখতে এলাম।” সেদিন কিন্তু লিলিৎসীর মনে একটু কেমন খট্কা লাগল। সে ভাবল, ‘কই, এতদিন ত কাজ করতে করতে একবারও আমায় দেখতে আসেনি, আজকাল এরকম হচ্ছে কেন?’
তারপর আর একদিন কিকিৎসুম এসেছে ছবি দেখতে। সেদিন লিলিৎসী টের পেয়েও দেখা দিল না—চুপি চুপি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল—কিকিৎসুম সেই ফুলদানির ভিতর থেকে কি একটা জিনিস বার করে দেখল, তারপর খুব খুশী হয়ে যত্ন করে আবার রেখে দিল। কিকিৎসুম চলে যেতেই লিলিৎসী দৌড়ে এসে ফুলদানির ভিতর থেকে কাগজে মোড়া আরসিটাকে টেনে বার করল। তারপর তার মধ্যে তাকিয়ে দেখে অতি সুন্দর এক মেয়ের ছবি!
তখন যে তার রাগটা হল—সে রাগে গজ্গজ্ করে বলতে লাগল, “এইজন্যে রোজ বাড়িতে আসা হয়—আবার আমায় বলেন ‘তোমার মুখখানা দেখতে এলাম’, ‘তোমার মত সুন্দর আর হয়ই না।’ মাগো! কি বিশ্রী মেয়েটা! হোঁৎকা মুখ, থ্যাবরা নাক, ট্যার্চা চোখ,—আবার আমার মত করে চুল বাঁধা হয়েছে! দেখ না কি রকম হিংসুটে চেহারা! এই ছবি আবার আদর করে তুলে রেখেছেন—আর রোজ রোজ আহ্লাদ করে দেখতে আসেন।” লিলিৎসীর চোখ ফেটে জল আসল, সে মাটিতে উপুড় হয়ে কাঁদতে লাগল। তারপর চোখ মুছে আর একবার আরসির দিকে তাকিয়ে বলল, “মেয়েটার কি ছিঁচকাঁদুনে চেহারা— এমন চেহারাও কেউ পছন্দ করে!” সে তখন আয়নাটাকে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখল।
সন্ধ্যার সময় কিকিৎসুম বাড়ি এসে দেখল, লিলিৎসী মুখ ভার করে মেঝের উপর বসে রয়েছে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, “কি হয়েছে?” লিলিৎসী বলল, “থাক থাক, আদর দেখাতে হবে না—নাও তোমার সাধের ছবিখানা নাও। ওকে নিয়েই আদর ক’র, যত্ন ক’র, মাথায় ক’রে তুলে রাখো।” তখন কিকিৎসুম গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি যে আমার ছবিকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করছ—জান ওটা আমার বাবার ছবি?” লিলিৎসী আরও রেগে বলল, “হ্যাঁ, তোমার বাবার ছবি! আমি কচি খুকি কিনা, একটা বলে দিলেই হল! তোমার বাবার কি অমনি আহ্লাদী মেয়ের মত চেহারা ছিল? তিনি কি আমাদের মতো ক’রে খোঁপা বাঁধতেন—” কথাটা শেষ না হতেই কিকিৎসুম বলল, “তুমি না দেখেই রাগ করছ কেন? একবার ভাল ক’রে দেখই না।” এই ব’লে কিকিৎসুম নিজে আবার দেখল, আরসির মধ্যে সেই মুখ।
তখন দুজনের মধ্যে ভয়ানক ঝগড়া বেধে গেল। কিকিৎসুম বলে ওটা তার বাবার ছবি, লিলিৎসী বলে ওটা একটা হিংসুটি মেয়ের ছবি। এইরকম তর্ক চলছে, এমন সময়ে গ্রামের যে বুড়ো ‘বঞ্জে’, সে তাদের গলার আওয়াজ শুনে দেখতে এল ব্যাপারখানা কি! পুরুতঠাকুরকে দেখে দুজনেই নমস্কার করে তার কাছে নালিশ লাগিয়ে দিল। কিকিৎসুম বলল, “দেখুন, আমার বাবার ছবি, সেদিন আমি রাস্তা থেকে কুড়িতে পেলাম, আর ও কিনা বলে যে ওটা কোন্ এক মেয়ের ছবি।” লিলিৎসী বলল, “দেখলেন কি অন্যায়! এনেছেন একটা গোমড়ামুখী মেয়ের ছবি, আর আমায় বোঝাচ্ছেন, ঐ নাকি তাঁর বাবা!” তখন ‘বঞ্জে’ ঠাকুর বললেন, “দাও ত দেখি ছবিখানা।” তিনি আরসি নিয়ে মিনিট পাঁচেক খুব গম্ভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। তারপর আয়নাটাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে বললেন, “তোমরা ভুল বুঝেছ। এ হচ্ছে অতি প্রাচীন এক মহাপুরুষের ছবি। আমি দেখতে পাচ্ছি, ইনি একজন যে-সে লোক নন। দেখছ না, মুখে কি গম্ভীর তেজ, কি রকম বুদ্ধি আর পাণ্ডিত্য, আর কি সুন্দর প্রশান্ত অমায়িক ভাব। এ ছবিটা ত এমন করে রাখলে চলবে না; বড় মন্দির গ’ড়ে, তার মধ্যে পাথরের বেদী বানিয়ে, তার মধ্যে ছবিখানাকে রাখতে হবে—আর ফুলচন্দন ধূপধূনা দিয়ে তার সম্মান করতে হবে।”
এই ব’লে ‘বঞ্জে’ ঠাকুর আরসি নিয়ে চলে গেলেন। আর কিকিৎসুম আর লিলিৎসী ঝগড়া-টগড়া ভুলে খুশী হয়ে খেতে বসল
উকিলের বুদ্ধি
গরিব চাষা, তার নামে মহাজন নালিশ করেছে। বেচারা কবে তার কাছে পঁচিশ টাকা নিয়েছিল, সুদে-আসলে তাই এখন পাঁচশো টাকায় দাঁড়িয়েছে। চাষা অনেক কষ্টে একশো টাকা যোগাড় করেছে; কিন্তু মহাজন বলছে, “পাঁচশো টাকার এক পয়সাও কম নয়; দিতে না পার তো জেলে যাও।” সুতরাং চাষার আর রক্ষা নাই।
এমন সময় শামলা মাথায় চশমা চোখে তোখোড়-বুদ্ধি উকিল এসে বলল, “ঐ একশো টাকা আমায় দিলে, তোমার বাঁচবার উপায় করতে পারি।” চাষা তার হাতে ধরল, পায়ে ধরল, বলল, “আমায় বাঁচিয়ে দিন।” উকিল বলল, “তবে শোন, আমার ফন্দি বলি। যখন আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াবে, তখন বাপু হে কথা-টথা কয়ো না। যে যা খুসি বলুক, গাল দিক আর প্রশ্ন করুক, তুমি তার জাবাবটি দেবে না— খালি পাঁঠার মতো ‘ব্যা—’ করবে। তা যদি করতে পার, তা হ’লে আমি তোমায় খালাস করিয়ে দেব।” চাষা বলল, “আপনি কর্তা যা বলেন, তাতেই আমই রাজী।”
আদালতে মহাজনের মস্ত উকিল, চাষাকে এক ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি সাত বছর আগে পঁচিশ টাকা কর্জ নিয়েছিলে?” চাষা তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “ব্যা—”। উকিল বলল, “খবরদার!— বল, নিয়েছিলি কি না।” চাষা বলল, “ব্যা—”। উকিল বলল, “হুজুর! আসামীর বেয়াদবি দেখুন।” হাকিম রেগে বললেন, “ফের যদি অমনি করিস, তোকে আমই ফাটক দেব।” চাষা অত্যন্ত ভয়ে পেয়ে কাঁদ কাঁদ হ’য়ে বলল, “ব্যা— ব্যা—”। হাকিম বললেন, “লোকটা কি পাগল নাকি?”
তখন চাষার উকিল উঠে বলল, “হুজুর, ও কি আজকের পাগল— ও বহুকালের পাগল, জন্মে অবধি পাগল। ওর কি কোনো বুদ্ধি আছে, না কাণ্ডজ্ঞান আছে? ও আবার কর্জ নেবে কি! ও কি কখনও খত লিখতে পারে নাকই? আর পাগলের খত লিখলেই বা কি? দেখুন দেখই, এই হতভাগা মহাজনটার কাণ্ড দেখুন তো! ইচ্ছে ক’রে জেনে শুনে পাগলটাকে ঠকিয়ে নেবার মতলব করেছে। আরে, ওর কি মাথার ঠিক আছে? এরা বলেছে, ‘এইখানে একটা আঙ্গুলের টিপ দে’— পাগল কি জানে, সে অমনি টিপ দিয়েছে। এই তো ব্যাপার!”
দুই উকিলে ঝগড়া বেধে গেল। হাকিম খানিক শুনে-টুনে বললেন, “মোকদ্দমা ডিস্মিস্।” মহাজনের তো চক্ষুস্থির। সে আদালতের বাইরে এসে চাষাকে বলল, “আচ্ছা, না হয় তোর চারশো টাকা ছেড়েই দিলাম — ঐ একশো টাকাই দে।” চাষা বলল, “ব্যা—!” মহাজন যতই বলে, যতই বোঝায়, চাষা তার পাঁঠার বুলি কিছুতেই ছাড়ে না। মহাজন রেগে-মেগে ব’লে গেল, “দেখে নেব, আমার টাকা তুই কেমন ক’রে হজম করিস।”
চাষা তার পোঁটলা নিয়ে গ্রামে ফিরতে চলেছে, এমন সময় তার উকিল এসে ধরল, “যাচ্ছ কোথায় বাপু? আমার পাওনাটা আগে চুকিয়ে যাও। একশো টাকায় রফা হয়েছিল, এখন মোকদ্দমা তো জিতিয়ে দিলাম।” চাষা অবাক হ’য়ে তার মুখের দিলে তাকিয়ে বলল, “ব্যা—।” উকিল বলল, “বাপু হে, ও-সব চালাকি খাটবে না— টাকাটি এখন বের কর।” চাষা বোকার মতো মুখ ক’রে আবার বলল, “ব্যা—।” উকিল তাকে নরম গরম অনেক কথাই শোনাল, কিন্তু চাষার মুখে কেবলই ঐ এক জবাব! তখন উকিল বলল, “হতভাগা গোমুখ্যু পাড়াগেঁয়ে ভূত—তোর পেটে অ্যাতো শয়তানি কে জানে! আগে যদি জানতাম তা হ’লে পোঁটলাসুদ্ধ টাকাগুলো আটকে রাখতাম।”
বুদ্ধিমান উকিলের আর দক্ষিণা পাওয়া হল না।
এক বছরের রাজা
এক ছিলেন সওদাগর— তাঁর একটি সামান্য ক্রীতদাস তাঁর একমাত্র ছেলেকে জল থেকে বাঁচায়। সওদাগর খুশি হয়ে তাকে মুক্তি তো দিলেনই, তা ছাড়া জাহাজ বোঝাই ক’রে নানা রকম বাণিজ্যের জিনিস তাকে বকশিশ দিয়ে বললেন, “সমুদ্র পার হয়ে বিদেশে যাও— এই সব জিনিস বেচে যা টাকা পাবে, সবই তোমার।” ক্রীতদাস মনিবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে চড়ে রওনা হল বাণিজ্য করতে।
কিন্তু বাণিজ্য করা আর হল না। সমুদ্রের মাঝখানে তুফান উঠে জাহাজটিকে ভেঙ্গে-চুরে জিনিসপত্র লোকজন কোথায় যে ভাসিয়ে নিল, তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না।
ক্রীতদাসটি অনেক কষ্টে হাবুডুবু খেয়ে, একটা দ্বীপের চড়ায় এসে ঠেকল। সেখানে ডাঙ্গায় উঠে সে চারিদিকে চেয়ে দেখল, তার জাহাজের চিহ্নমাত্র নাই, তার সঙ্গের লোকজন কেউ নাই। তখন সে হতাশ হয়ে সমুদ্রের ধারে বালির উপর বসে পড়ল। তারপর যখন সন্ধ্যা হয়ে এল, তখন সে উঠে দ্বীপের ভিতর দিকে যেতে লাগল। সেখানে বড় বড় গাছের বন— তারপর প্রকাণ্ড মাঠ, আর তারই ঠিক মাঝখানে চমৎকার শহর। শহরের ফটক দিয়ে মশাল হাতে মেলাই লোক বার হচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই সেই লোকেরা চীৎকার ক’রে বলল, “মহারাজের শুভাগমন হোক। মহারাজ দীর্ঘজীবী হউন।” তারপর সবাই তাকে খাতির ক’রে জমকালো গাড়িতে চড়িয়ে প্রকাণ্ড এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেখানের চাকরগুলো তাড়াতাড়ি রাজপোশাক এনে তাকে সাজিয়ে দিল।
সবাই বলছে, ‘মহারাজ’,’মহারাজ’, হুকুম মাত্র সবাই চট্পট্ কাজ করছে, এসব দেখেশুনে সে বেচারা একেবারে অবাক। সে ভাবল সবই বুঝি স্বপ্ন— বুঝি তার নিজেরই মাথা খারাপ হয়েছে তাই এরকম মনে হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে সে বুঝতে পারল সে জেগেই আছে আর দিব্যি জ্ঞানও রয়েছে, আর যা যা ঘটছে সব সত্যিই। তখন সে লোকদের বলল, “এ কি রকম হচ্ছে বল তো? আমি তো এর কিছুই বুঝছি না। তোমরা কেনই বা আমায় ‘মহারাজ’ বলছ আর কেনই বা এমন সম্মান দেখাচ্ছ?”
তখন তাদের মধ্যে থেকে এক বুড়ো উঠে বলল, “মহারাজ, আমরা কেউ মানুষ নই— আমরা সকলেই প্রেতগন্ধর্ব— যদিও আমাদের চেহারা ঠিক মানুষের মতো। অনেক দিন আগে আমরা, ‘মানুষ রাজা’ পাবার জন্য সবাই মিলে প্রার্থনা করেছিলাম; কারণ মানুষের মতো বুদ্ধিমান আর কে আছে? সেই থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের মানুষ রাজার অভাব হয়নি। প্রতি বৎসরে একটি ক’রে মানুষ এইখানে আসে আর আমরা তাকে এক বৎসরের জন্য রাজা করি। তার রাজত্ব শুধু ঐ এক বৎসরের জন্যই। বৎসর শেষ হলেই তাকে সব ছাড়তে হয়। তাকে জাহাজে ক’রে সেই মরুভূমির দেশে রেখে আসা হয়, সেখানে সামান্য ফল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না— আর সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বালি না খুঁড়লে এক ঘটি জলও মেলে না। তারপর আবার নূতন রাজা আসে— এই রকমে বৎসরের পর বৎসর আমাদের চলে আসছে।”
তখন দাসরাজা বললেন, “আচ্ছা বল তো— এর আগে তোমাদের রাজারা কি রকম স্বভাবের লোক ছিলেন?” বুড়ো বলল, “তাঁরা সবাই ছিলেন অসাবধান আর খামখেয়ালি। সারাটি বছর সবাই শুধু জাঁকজমক আমোদে আহ্লাদে দিন কাটাতেন— বছর শেষে কি হবে সে কথা ভাবতেন না।”
নতুন রাজা মন দিয়ে সব শুনলেন, বছরের শেষে তাঁর কি হবে এই কথা ভেবে ক’দিন তাঁর ঘুম হল না।
তারপর সে দেশের সকলের চেয়ে জ্ঞানী আর পণ্ডিত যারা, তাদের ডেকে আনা হল, আর রাজা তাদের কাছে মিনতি ক’রে বললেন, “আপনারা আমাকে উপদেশ দিন— যাতে বছর শেষে এই সর্বনেশে দিনের জন্য প্রস্তুত হতে পারি।”
তখন সবচেয়ে প্রবীণ বৃদ্ধ যে, সে বলল, “মহারাজ, শূন্য হাতে আপনি এসেছিলেন, শূন্য হাতেই আবার সে দেশে যেতে হবে— কিন্তু এই এক বছর আপনি আমাদের যা ইচ্ছা তাই করাতে পারেন। আমি বলি— এই বেলা রাজ্যের ওস্তাদ লোকদের সে দেশে পাঠিয়ে, সেখানে বাড়ি ক’রে, বাগান ক’রে, চাষবাসের ব্যবস্থা ক’রে চারিদিক সুন্দর করে রাখুন। ততদিনে ফলে ফুলে দেশ ভরে উঠবে, সেখানে লোকের যাতায়াত হবে। আপনার এখানকার রাজত্ব শেষ হতেই সেখানে আপনি সুখে রাজত্ব করবেন। বৎসর তো দেখতে দেখতে চলে যাবে, অথচ কাজ আপনার ঢের; কাজেই বলি, এই বেলা খেটে-খুটে সব ঠিক ক’রে নিন।” রাজা তখনই হুকুম দিয়ে লোকলস্কর, জিনিসপত্র, গাছে চারা, ফলের বীজ, আর বড় বড় কলকব্জা পাঠিয়ে, আগে থেকে সেই মরুভূমিকে সুন্দর ক’রে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলেন।
তারপর বছর যখন ফুরিয়ে এল, তখন প্রজারা তাঁর ছত্র মুকুট রাজদণ্ড সব ফিরিয়ে নিল, তাঁর রাজার পোশাক ছাড়িয়ে এক বছর আগেকার সেই সামান্য কাপড় পরিয়ে, তাঁকে জাহাজে তুলে সেই মরুভূমির দেশে রেখে এল। কিন্তু সে দেশ আর এখন মরুভূমি নেই— চারিদিকে ঘর বাড়ি, পথ ঘাট, পুকুর বাগান। সে দেশ এখন লোকে লোকারণ্য। তারা সবাই এসে ফুর্তি ক’রে শঙ্খ ঘণ্টা বাজিয়ে তাঁকে নিয়ে সিংহাসনে বসিয়ে দিল। এক বছরের রাজা সেখানে জন্ম ভরে রাজত্ব করতে লাগলেন।
ওয়াসিলিসা
ওয়াসিলিসা এক সওদাগরের মেয়ে। তার মা ছিল না, কেউ ছিল না— ছিল খালি এক দুষ্টু সৎমা আর ছিল সে সৎমার দুটো ডাইনীর মত মেয়ে।
ওয়াসিলিসার মা যখন মারা যান, তখন তিনি তাকে একটা কাঠের পুতুল দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, “একে কখন ছেড়ো না, সর্বদা কাছে কাছে রেখো, আর যখন তোমার বিপদ-আপদ ঘটবে, একে চারটি কিছু খেতে দিও। তবেই দেখবে, এ মানুষের মত তোমার সঙ্গে কথা বলবে; তখন এর পরামর্শমতো চ’লো।” তারপরে এতদিনে ওয়াসিলিসা বড় হয়ে উঠেছে।
সৎমা তার মেয়েদের সঙ্গে মিলে কেবল ওয়াসিলিসার অনিষ্ট চেষ্টা করত। ওয়াসিলিসা দেখতে যেমন সুন্দর, তার কথাবার্তা তেমনি মিষ্টি। গ্রামের যত লোক সবাই তাকে ভালবাসে। আর সেই সৎমার যে দুটো মেয়ে— তাদের দাঁত যেমন উঁচু, চোখ তেমনি টেরা, নাক তার চেয়েও বাঁকা,— আর তার উপরে এমনি দুষ্টু আর হিংসুকে আর ঝগড়াটে, তাদের কে ভালবাসবে? তাই তারা হিংসায় ওয়াসিলিসাকে ধরে মারত। গ্রামের এক কিনারায় ওয়াসিলিসাদের বাড়ি আর বাড়ির পাশেই প্রকাণ্ড বন। সে বনের মধ্যে সবুজ মাঠের উপরে ডাইনীবুড়ি বাবায়াগার বাড়ি। সে বুড়ি মানুষ খায়,— সুন্দর মেয়েদের ধরতে পেলে ত খুব উৎসাহ করেই খায়।
একদিন রাত্রে দুষ্টু সৎমা তার মেয়েদের বলল, “এক কাজ কর্। ঘরের আগুনটা নিবিয়ে দে ত। তা হলেই ওয়াসিলিসাকে আবার আগুন আনবার জন্য সেই সবুজ মাঠে বাবায়াগার বাড়িতে পাঠানো যাবে; আর বাবায়াগা তাকে ধরে গিলে ফেলবে। কেমন মজা!” যেই এ কথা বলা, অমনি বড় মেয়েটা উঠে ইচ্ছে করে ছাইমাটি চাপা দিয়ে আগুন নিবিয়ে দিল। আর সকলে চেঁচাতে লাগল, “ঐ যা! আগুন তো নিবে গেল! ওয়াসিলিসা, ওয়াসিলিসা, শিগ্গির ওঠ। বনের মধ্যে সবুজ মাঠ আছে, তার মধ্যে বাবায়াগার বাড়ি, তার বাড়ির আগুন নাকি কখনও নিবে যায় না। শিগ্গির যাও, দৌড়ে যাও, সেই আগুন খানিকটা নিয়ে এস।”
এই না ব’লে তারা ওয়াসিলিসার চুল ধরে হিড়্হিড়্ ক’রে টেনে তাকে বাড়ির বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে, ঘরের খিল এঁটে দিল। ওয়াসিলিসা বাইরে বসে কাঁদছে, এমন সময় তার সেই ছোট কাঠের পুতুলের কথা মনে হল। তখন সে তাড়াতাড়ি তার কাপড়ের মধ্যে থেকে পুতুলটাকে বের করে তার মুখে একটু খাবার দিয়ে বলতে লাগল, “কাঠের পুতুল, খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।” অমনি কাঠের পুতুলের চোখদুটো জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল— তারপর সে বলতে লাগল—
“কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়? তুমি ভয় পেও না, বাবায়াগার বাড়ি সোজা চলে যাও।”
ওয়াসিলিসা চলতে লাগল। রাত গেল, সকাল গেল, দুপুর গেল, তখন দেখা গেল সবুজ মাঠ, তার ঠিক মধ্যখানে ভাঙ্গাচোরা সাদা বাড়ি, তার গায়ে সারি সারি মড়ার খুলি, তার দরজা জানালা ফটক কবাট আস্ত আস্ত হাড়ের তৈরী। হুড়্কো কব্জা কাঁটা পেরেক কোথাও কিছু নেই— কিছু দিয়ে বাঁধা নেই, জোড়া নেই, অথচ বাড়িখানা চারটে পাখির ঠাঙের উপর ঠিক দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওয়াসিলিসা অবাক হয়ে দেখছে, এমন সময় হঠাৎ একটা সাদা লোক ঝক্ঝকে সাদা পোশাক পরে, সাদা ঘোড়ায় চড়ে সাঁই সাঁই করে কোথা থেকে ছুটে এল। এসেই, সোজা বাড়ির ফটকের উপরে ছুটে পড়ল আর ধাঁ করে বাড়ির সঙ্গে মিশে গেল। ওয়াসিলিসা চেয়ে দেখল, তখন বিকেল হয়ে এসেছে, রোদ পড়ে আসছে।
তারপর একজন লোক এল, রাঙা সূর্যের মত লাল তার রং— তার পোশাক, তার ঘোড়া, সবই লাল। সেও তেমনি ছুটে গিয়ে বাড়ির মধ্যে মিশে গেল। ওয়াসিলিসা দেখল, সন্ধ্যে হয়েছে, চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।
তারপর একজন এল অন্ধকারের মতো কালো-কালো পোশাক, কালো ঘোড়া। সে যেই বাড়ির মধ্যে মিশে গেল আর চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। কেবল সেই বাড়ির গায়ে মড়ার খুলিগুলো আপনা থেকে ঝক্ঝক্ করে জ্বলে উঠল— আর দাঁত বের করে চারদিকে আলো ছড়াতে লাগল।
তারপরে একটা প্রকাণ্ড হামানদিস্তা হাঁকিয়ে বাবায়াগা নিজে এসে হাজির। সে এসেই ত’ ওয়াসিলিসার গন্ধ পেয়ে তাকে ধরে নিয়ে গেল। ওয়াসিলিসা আগুন নিতে এসেছে শুনেই সে বলল, “বটে! আগুনের বুঝি দাম লাগে না? তিন দিন আমার বাড়িতে কাজ কর— যদি ভাল কাজ করতে পারিস আগুন পাবি; আর, তা যদি না পারিস তোকে আমি ঝোল রেঁধে খাব। আচ্ছা, এখন আমার খাবারগুলো উনুন থেকে নামিয়ে আমায় দে ত’।”
ওয়াসিলিসা খাবার এনে দিল। বুড়ি চেটেপুটে খেয়ে বলল, “কাল সকালে আমি বেরিয়ে যাব। সন্ধ্যার সময় এসে যেন দেখতে পাই— আমার ঘর ঝাঁট দেওয়া হয়েছে, আমার রান্না ঠিকমত করা হয়েছে, আর ঐ কোণে এক ঝুড়ি সোনার ধান দেখবি তার মধ্যে অনেক কাঁকর, অনেক খুদ, আর তার চাইতেও বেশি কালো ধান মেশানো আছে— সমস্ত ঝেড়ে বেছে রাখিস। খবরদার, কিছু ভুল হয় না যেন।”
ওয়াসিলিসা বসে বসে কাঁদতে লাগল। তখন তার কাঠের পুতুলের কথা মনে হ’ল। সে পুতুলের মুখে একটু খাবার দিয়ে বলতে লাগল, “কাঠের পুতুল! খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।” কাঠের পুতুলের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল, সে বলতে লাগল,—”কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়, ওয়াসিলিসার কিসের ভয়! তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও গিয়ে।”
ওয়াসিলিসা ঘুমাতে গেল। সকালবেলায় বাবায়াগা তার হামানদিস্তায় চড়ে বেরিয়ে গেল। আর কি আশ্চর্য! ঘরদোর সব আপনা থেকে ঝাঁট হয়ে গেল। খাবারগুলো উনুনে চড়ে আপনা থেকে সিদ্ধ হতে লাগল। ওয়াসিলিসা অবাক হয়ে সেই ধানগুলো দেখতে গিয়ে দেখে তার কাঠের পুতুল সমস্ত ধান বেছে সোনার ধান, কালো ধান, কাঁকর আর খুদ সব আলগা করে ফেলেছে!
বিকেলবেলা সাদা লোকটা ফিরে এল, সন্ধ্যার সময় লাল লোকটা ফিরে এল আর ঘুট্ঘুটে অন্ধকার রাত্রে কালো লোকটা ফিরে এল, —তারপর ঝম্ঝম্ খট্খটাং করে হামানদিস্তা হাঁকিয়ে বাবায়াগা ঘরে এল। এসেই সে হামানদিস্তার বাঁটটা দিয়ে ঘরের সব জায়গায় ধাঁই ধাঁই ক’রে মেরে দেখতে লাগল, কোনখান থেকে ধুলো পড়ে কিনা! তারপর যখন সে দেখল ঝাঁট দেওয়াও ঠিক হয়েছে, খাবারও রান্না হয়েছে, ধানও বাছা হয়েছে, তখন সে রেগে চিৎকার করে বলতে লাগল, হতভাগী মেয়ে, কে তোকে বাঁচিয়েছে— শিগ্গির আমায় বল্।” ওয়াসিলিসা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমার মা মারা যাবার সময় আমায় আশীর্বাদ করেছিলেন, তাতেই আমি বেঁচেছি।” এই না শুনে ডাইনী বুড়ি ভয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “ওরে বাবারে! কার আশীর্বাদ নিয়ে আমার এসেছ রে! আমার সর্বনাশ করবে যে! এই নে তোর আগুন নে— আমার বাড়ি থেকে শিগ্গির বেরো।” এই ব’লে সে ওয়াসিলিসাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, আর একটি মড়ার খুলি তাকে ছুঁড়ে দিল।
ওয়াসিলিসা একটা লাঠির আগায় খুলিটাকে চড়িয়ে বাড়ি নিয়ে গেল। কিন্তু বাড়িতে নিলে কি হবে? তার যে সেই সৎমা আর তার দুটো দুষ্টু মেয়ে, তাদের ত’ কেউ কোনদিন আশীর্বাদ করেনি— তারা মহা খুশী হয়ে যেই আগুনটা নিতে গিয়েছে অমনি তাদের গায়ে আগুন ধরে গিয়ে তারা ত’ মরলই, বাড়িঘর সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল।
ওয়াসিলিসা আবার বসে কাঁদতে লাগল। তখন কাঠের পুতুলের কথা মনে হল। পুতুলের মুখে খাবার দিয়ে বলল, “কাঠের পুতুল, খাবার খাও, আবার তুমি জ্যান্ত হও, আমার সঙ্গে কথা কও।” কাঠের পুতুল জেগে উঠে বলল— “কাঠের পুতুল সঙ্গে রয়— ওয়াসিলিসার কিসের ভয়! তুমি রাজার কাছে যাও তিনি তোমায় সুখী করবেন।”
রাজা এমন চমৎকার মেয়ে কখনো কোথাও দেখেননি— তিনি তার কথা শুনবেন কি— তাড়াতাড়ি সিংহাসন থেকে উঠে পড়লেন, বললেন, “আহা কি সুন্দর মেয়েটি গো! তুমি কার মেয়ে? কি তোমার দুঃখ? তুমি আমায় বিয়ে কর— আমার রাজ্যের রানী হয়ে থাক— আমি তোমার সব দুঃখ দূর করব।”
এমনি করে ওয়াসিলিসা রানী হলেন— আর সেই কাঠের পুতুল সোনার খাটে মখমলের গদিতে, রেশমের চাদরের উপর ঝক্ঝকে পোশাক পরে শুয়ে থাকত।
কালাচাঁদের ছবি
কালাচাঁদ নিধিরামকে মারিয়াছে– তাই নিধিরাম হেডমাস্টার মশায়ের কাছে নালিশ করিয়াছে। হেডমাস্টার আসিয়া বলিলেন, “কি হে কালাচাঁদ, তুমি নিধিরামকে মেরেছ?” কালাচাঁদ বলিল, “আজ্ঞে না, মারব কেন? কান মলে দিয়েছিলাম, গালে খামচিয়ে দিয়েছিলাম, আর একটুখানি চুল ধরে ঝাঁকিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলাম।” হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কেন ওরকম করেছিলে?” কালাচাঁদ খানিকটা আমতা আমতা করিয়া মাথা চুলকাইয়া বলিল, “আজ্ঞে, ও খালি খালি আমায় চটাচ্ছিল।” হেডমাস্টার মশাই জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমায় মেরেছিল?” “না।” “ধমকিয়েছিল?” “না।” “তবে” “বারবার ঘ্যান্ ঘ্যান্ করে বোকার মত কথা বলছিল, তাই, আমার রাগ হয়ে গেল।” হেডমাস্টার মশাই তাহার কান ধরিয়া বেশ ভালোরকম নাড়াচাড়া দিয়া বলিলেন, “মেজাজটা এখন থেকে একটু সংশোধন করতে চেষ্টা কর।”
ছুটির পর আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, “হ্যাঁরে কালাচাঁদ, তুই খামকা ঐ নিধেটাকে মারতে গেলি কেন?” কালাচাঁদ বলিল, “খামকা মারব কেন? কেন মেরেছিলাম ওকেই জিজ্ঞাসা কর না!” নিধেকে জিজ্ঞাসা করিতে সে বলিল, “খামকা নয় তো কি? তুই বাপু ছবি এঁকেছিস তার কথা আমায় জিগ্গেস করতে গেলি কেন? আর যদি জিগ্গেস করলি, তাহলে তাই নিয়ে আবার মারামারি করতে এলি কেন?” আমরা বলিলাম, “আরে কি হয়েছে খুলেই বল না কেন।”
নিধিরাম বলিল, “কালাচাঁদ একটা ছবি এঁকেছে, ছবির নাম– খাণ্ডব দাহন। সেই ছবিটা আমায় দেখিয়ে ও জিগ্গেস করল, ‘কেমন হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘এটা কি এঁকেছ? মন্দিরের সামনে শেয়াল ছুটছে?’ কালাচাঁদ বলল, ‘না, না, মন্দির কোথায়? ওটা হল রথ। আর এগুলো তো শেয়াল নয়– রথের ঘোড়া।’ আমি বললাম, ‘সূর্যটাকে কালো করে এঁকেছ কেন? আর ঐ চামচিকেটা লাঠি নিয়ে ডিগবাজি খাচ্ছে কেন?’ কালাচাঁদ বলল, ‘আহা তা কেন? ওটা সূর্য নয়, সুদর্শন চক্র। দেখছ না কৃষ্ণের হাতে রয়েছে? আর তালগাছ কোথায় দেখলে? ওটা তো অর্জুনের পতাকা! আর ঐগুলোকে বুঝি পদ্মফুল বলছ? ওগুলো দেবতা– খুব দূরে আছেন কিনা তাই ছোট ছোট দেখাচ্ছে। আর এই বুঝি চামচিকে হল, ওটা তো গরুড়পাখি!’ ‘আচ্ছা, ঐ কালো কাপড় পড়া মেয়েমানুষটি যে ওদের মারতে আসছে ওটি কে?’ কালাচাঁদ বলল, ‘তুমি তো আচ্ছা মুখ্যু হে! ওটা গাছে আগুন লেগে ধোঁয়া বেরুচ্ছে বুঝতে পারছ না? অবাক করলে যে!’”
“তখন আমি বললাম, ‘আচ্ছা এক কাজ কর না কেন ভাই, ওটাকে খাণ্ডব দাহন না করে সীতার অগ্নিপরীক্ষা কর না কেন? ঐ গাছটাকে শাড়ি পরিয়ে সীতা করে দাও। ঐ রথটার মাথায় জটা-টটা দিয়ে ওকে অগ্নিদেব বানাও, কৃষ্ণ অর্জুন আছেন তাঁরা হবেন রাম লক্ষ্মণ। আর ঐ সুদর্শন চক্রে নাক হাত পা জুড়ে দিলেই ঠিক বিভীষণ হয়ে যাবে। তারপর চামচিকের পিছনে একটা লম্বা ল্যাজ দিয়ে তার ডানা দুটো মুছে দাও– ওটা হনুমান হবে এখন।’ কালাচাঁদ বলল, ‘হনুমানও হতে পারে, নিধিরামও হতে পারে।’”
“আমি বললাম, ‘তাহলে ভাই, আর এক কাজ কর। ওটাকে শিশুপাল-বধ করে দাও। তাহলে কৃষ্ণকে বদলাতে হবে না। চক্র তুলে শিশুপালকে মারতে যাচ্ছেন। অর্জুনের মুখে পাকা গোঁফ দাড়ি দিয়ে খুব সহজেই ভীষ্ম করে দেওয়া যাবে। আর রথটা হবে সিংহাসন, তার উপর যুধিষ্ঠিরকে বসিয়ে দিও। আর ঐ যে গরুড় আর সাপ, ঐটে একটু বদলিয়ে দিলেই গদা হাতে ভীষ্ম হয়ে যাবে। আর শিশুপাল তো আছেই– ঐ গাছটাকে একটু নাক-মুখ ফুটিয়ে দিলেই হবে। তারপর রাজসূয় যজ্ঞের কয়েকটা রাজাকে দেখালেই বাস্!’”
“কথাটা কালাচাঁদের পছন্দ হল না, তাই আমি অনেক ভেবেচিন্তে আবার বললাম, ‘তাহলে জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞ কর না কেন? ঐ রথটা হবে জন্মেজয় আর কৃষ্ণকে জটা-দাড়ি দিয়ে পুরুতঠাকুর বানিয়ে দাও। সুদর্শন চক্রটা হবে ঘিয়ের ভাঁড়। যজ্ঞের আগুনের মধ্যে তিনি ঘি ঢালছেন। ঐ ধোঁয়াগুলো মনে কর যজ্ঞের ধোঁয়া ! একটা সাপ আছে, আরো কয়েকটা এঁকে দিও। আর অর্জুনকে কর আস্তীক, সে হাত তুলে তক্ষককে বলছে– তিষ্ঠ, তিষ্ঠ। আর ঐ চামচিকেটা, মানে গরুড়টা, ওটাকে মুনি-টুনি কিছু একটা বানিয়ে দিও।’ পতাকাটাকে কি রকম করতে হবে সেইটা বলতে যাচ্ছি, এমন সময় কালাচাঁদ আমায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘থাক, থাক, আর তোমার বিদ্যে করে কাজ নেই। সর দেখি।’”
“আমি বললাম, ‘অত রাগ কর কেন ভাই? আমি তো আর বলছি না যে আমার পরমর্শ মতো তোমাকে চলতে হবে। পছন্দ হয় কর, না হয়তো কোরো না, বাস্। এর মধ্যে আবার রাগারাগি কর কেন? আমার কথামতো না করে অন্য একটা কিছু কর না। মনে কর, ওটাকে সমুদ্র-মন্থন করে দিলেও তো হয়। ঐ ধোঁয়াওয়ালা বড় গাছটা মন্দার পর্বত, রথটা ধন্বন্তরী কিম্বা লক্ষ্মী– মন্থন থেকে উঠে এসেছেন। ওদিকে সুদর্শন চক্রটা চাঁদ হতে পারবে, অর্জুনের পিছনে কতগুলো দেবতা এঁকে দাও আর এদিকে কৃষ্ণ আর চামচিকের দিকে কতগুলো অসুর’– কথাটা ভালো করে বলতে না বলতেই কালাচাঁদ আমার কান ধরে মারতে লাগল। আচ্ছা, দেখ দেখি কি অন্যায়! আমি বন্ধুভাবে দুটো পরমর্শ দিতে গেলাম– তা তোমার পছন্দ হয়নি বলেই আমায় মারবে? যা বলেছি সব শুনলে তো, এর মধ্যে এত রাগ করবার কি হল বাপু?”
বাস্তবিক, কালাচাঁদের এ বড় অন্যায় ! সে রাগ করিল কিসের জন্য? নিধিরাম তাহাকে মারে নাই, ধরে নাই, বকে নাই, গাল দেয় নাই, চোখ রাঙায় নাই, মুখ ভ্যাংচায় নাই- তবে রাগ করিবার কারণটা কি?
ব্যাপার কি বোঝা গেল না, তাই সন্ধ্যায় সবাই মিলিয়া কালাচাঁদের বাড়িতে গেলাম। আমি বলিলাম, “ভাই কালাচাঁদ, আমরা তোমার সেই ছবিটা দেখতে চাই। সেই যে সমুদ্র লঙ্ঘন না কি যেন?” রমাপ্রসাদ বলিল, “দ্যুৎ, সমুদ্র লঙ্ঘন কিসের? অগ্নিপরীক্ষা।” আর একজন কে যেন বলিল, “না, না, কি একটা বধ।” কেন জানিনা , কালাচাঁদ হাঁ হাঁ করিয়া একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিল। “যাও যাও ইয়ার্কি করতে হবে না,” বলিয়া সে তাহার ছবির খাতাখানি ফড়ফড় করিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল- আর রাগে গজরাইতে লাগিল। আমরা হতভম্ব হইয়া রহিলাম। সকলেই বলিলাম, “কালাচাঁদের মাথায় বোধহয় একটু পাগলামির ছিট আছে। নইলে সে খামকা এত রাগ করবে কেন?”
কুকুরের মালিক
ভজহরি আর রামচরণের মধ্যে ভারি ভাব। অন্তত, দুই সপ্তাহ আগেও তাহাদের মধ্যে খুবই বন্ধুতা দেখা যাইত।
সেদিন বাঁশপুকুরের মেলায় গিয়া তাহারা দুইজন মিলিয়া একটা কুকুরছানা কিনিয়াছে। চমৎকার বিলাতি কুকুর— তার আড়াই টাকা দাম। ভজুর পাঁচসিকা আর রামার পাঁচসিকা— দুইজনের পয়সা মিলাইয়া কুকুর কেনা হইল। সুতরাং দুইজনেই কুকুরের মালিক।
কুকুরটাকে বাড়িতে আনিয়াই ভজু বলিল, “অর্ধেকটা কুকুর আমার, অর্ধেকটা তোর।” রামা বলিল, “বেশ কথা! মাথার দিকটা আমার, ল্যাজের দিকটা তোর।” ভজু একটু ভাবিয়া দেখিল, মন্দ কি! মাথার দিকটা যার সেই তো কুকুরকে খাওয়াইবে, যত হাঙ্গামা সব তার। তাছাড়া কুকুর যদি কাউকে কামড়ায়, তবে মাথার দিকের মালিকই দায়ী, ল্যাজের মালিকের কোন দোষ দেওয়া চলিবে না। সুতরাং সে বলিল, “আচ্ছা, ল্যাজের দিকটাই নিলাম।”
দুইজনে দুপুর বেলায় বসিয়া কুকুরটার পিঠে হাত বুলাইয়া তোয়াজ করিত। রামা বলিত, “দেখিস, আমার দিকে হাত বোলাসনে।” ভজু বলিত, “খবরদার, এদিকে হাত আনিসনে।” দুইজনে খুব সাবধানে নিজের নিজের ভাগ বাঁচাইয়া চলিত। যখন ভজুর দিকের পা তুলিয়া কুকুরটা রামার দিকে কান চুলকাইত, তখন ভজু খুব উৎসাহ করিয়া বলিত, “খুব দে— আচ্ছা করে খামচিয়ে দে।” আবার ভজুর দিকে মাছি বসিলে রামার দিকের মুখটা যখন সেখানে কামড়াইতে যাইত, তখন রামা আহ্লাদে আটখানা হইয়া বলিত, “দে কামড়িয়ে! একেবারে দাঁত বসিয়ে দে।”
একদিন একটা মস্ত লাল পিঁপড়ে কুকুরের পিঠে কামড়াইয়া ধরিল। কুকুরটা গা ঝাড়া দিল, পিঠে জিভ লাগাইবার চেষ্টা করিল, নানারকম অঙ্গভঙ্গী করিয়া পিঠটাকে দেখিবার চেষ্টা করিল। তারপর কিছুতেই কৃতকার্য না হইয়া কেঁউ কেঁউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তখন দুইজনে বিষম তর্ক উঠিল, কার ভাগে কামড় পড়িয়াছে। এ বলে, “তোর দিকে পিঁপড়ে লেগেছে— তুই ফেলবি,” ও বলে, “আমার বয়ে গেছে পিঁপড়ে ফেলতে— তোর দিকে কাঁদছে, সে তুই বুঝবি। সেদিন দুইজনে প্রায় কথা-বার্তা বন্ধ হইবার জোগাড়।
তারপর একদিন কুকুরের কী খেয়াল চাপিল, সে তাহার নিজের ল্যাজটা লইয়া খেলা আরম্ভ করিল। নেহাৎ ‘কুকুরে’ খেলা— তার না আছে অর্থ, না আছে কিছু। সে ধনুকের মত একপাশে বাঁকা হইয়া ল্যাজটার দিকে তাকাইয়া দেখে আর একটু একটু ল্যাজ নাড়ে। সেটা যে তার নিজের ল্যাজ, সে খেয়াল বোধহয় তার থাকে না— তাই হঠাৎ অতর্কিতে ল্যাজ ধরিবার জন্য সে বোঁ করিইয়া ঘুরিয়া যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরটাও নড়িয়া যায়, কাজেই ল্যাজটা আর ধরা হয় না। ভজু আর রামা এই ব্যাপার দেখিয়া উৎসাহে চিৎকার করিতে লাগিল। রামার মহা স্ফুর্তি যে ভজুর ল্যাজকে তাড়া করা হইতেছে, আর ভজুর ভারই উৎসাহ যে তার ল্যাজ রামার মুখকে ফাঁকি দিয়া নাকাল করিতেছে।
দুইজনের চিৎকারের জন্যই হোক কী নিজের ঢ্যাঁটামির জন্যই হোক কুকুরটার জেদ চড়িয়া গেল। সমস্তদিন সে থাকিয়া থাকিয়া চর্কীবাজির মত নিজের ল্যাজকে তাড়া করিয়া ফিরিতে লাগিল। এইরকমে খামখা পাক দিতে দিতে কুকুরটা হয়রান হইয়া হাঁপাইতে লাগিল, তখন রামা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। ভজু বলিল, “আমার দিকটাই জিতিয়াছে।”
কিন্তু কুকুরটা এমন বেহায়া, পাঁচমিনিট যাইতে না যাইতেই সে আবার ল্যাজ তাড়ান শুরু করিল। তখন রামা রাগিয়া বলিল, “এইয়ো! তোমার ল্যাজ সামলাও। দেখছ না কুকুরটা হাঁপিয়ে পড়ছে?” ভজু বলিল, “সামলাতে হয় তোমার দিক সামলাও— ল্যাজের দিকে তো আর হাঁপাচ্ছে না!” রামা ততক্ষণে রীতিমত চটিয়াছে। সে কুকুরের পিছন পিছন গিয়া ধাঁই করিয়া এক লাথি লাগাইয়া দিল। ভজু বলিল, “তবে রে! আমার দিকে লাথি মারলি কেন রে?” এই বলিয়াই সে কুকুরের মাথায় ঘাড়ে কানে চটাপট কয়েকটা চাঁটি লাগাইয়া দিল। দুই দিক হইতেই রেষারেষির চোটে কুকুরটা ছুটিয়া পালাইল। তখন দুইজনে বেশ একচোট হাতাহাতি হইয়া গেল।
পরের দিন সকালে উঠিয়াই রাআম দেখে, কুকুরটা আবার ল্যাজ তাড়া করিতেছে। তখন সে কোথা হইতে একখানা দা’ আনিয়া এক কোপে ক্যাঁচ্ করিয়া ল্যাজের খানিকটা এমন পরিপাটি উড়াইয়া দিল যে কুকুরটার আর্তনাদে ভজু ঘুমের মধ্যে লাফ দিয়া একেবারে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত। সে আসিয়াই দেখিল কুকুরের ল্যাজ কাটা, রামার হাতে দা’। ব্যাপারটা বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না। তখন সে রামাকে মারিতে মারিতে মাটিতে ফেলিয়া তাহার উপর কুকুর লেলাইয়া দিল। কুকুরটা ল্যাজ কাটার দরুণ রামার উপর একটুও খুশী হয় নাই— সে নিমকহারাম হইয়া ‘রামার দিক’ দিয়াই রামার ঠ্যাঙে কামড়াইয়া দিল।
এখন দুইজনেই চায় থানায় নালিশ করিতে। রামা বলে ল্যাজটা ভারি বেয়াড়া, বারবার মুখের সঙ্গে ঝগড়া লাগাইতে চায়— তাই সে ল্যাজ কাটিয়াছে। ল্যাজ না কাটিলে কুক্র পাগল হইয়া যাইত, না হয় সর্দিগর্মি হইয়া মরিত। মারা গেলে ত’ সমস্ত কুকুরই মারা যাইত, সুতরাং ল্যাজ কাটার দরুণ গোটা কুকুরটারই উপকার হইয়াছে। মুখও বাঁচিয়াছে, ল্যাজও বাঁচিয়াছে; তাতে রামারও ভাল, ভজুরও ভাল। কিন্তু ভজুর এতবড় আস্পর্ধা যে সে রামার দিকের কুকুরকে রামার উপরে লেলাইয়া দিল। মুখের দিকে ভজুর কোন দাবিদাওয়া নাই, সে দিকটা সম্পূর্ণভাবেই রামার— সুতরাং রামার অনুমতি ছাড়া ভজু কোন্ সাহসে এবং কোন্ শাস্ত্র বা আইন মতে তাজা লইয়া পরের ধনে পোদ্দারি করিতে যায়? ইহাতে অনধিকারচর্চা চুরি তছরূপ— সব রকম নালিশ চলে।
ভজু কিন্তু বলে অন্যরকম। সে বলে রামার দিকের কুকুর রামাকে কামড়াইয়াছে, তাতে ভজুর কি দোষ? ভজু কেবল ‘লে লে লে’ বলিয়াছিল; তাহাতে কুকুর যদি রামাকে কামড়ায়, তবে সেটা তার শিক্ষার দোষ— রামা তাহাকে ভাল করিয়া শিক্ষা দেয় নাই কেন? তাছাড়া ভজুর ল্যাজ খেলা করিতে চায়, রামার হিংসুটে মুখটা তাহাতে আপত্তি করে কেন? ভজুর ল্যাজকে কামড়াইতে যাইবার কি অধিকার আছে? আর, রামা তার কুকুরের চোখ বাঁধিয়া কিংবা মুখোস আঁটিয়া দিলেই পারিত— সে ল্যাজ কাটিতে গেল কাহার হুকুমে? একবার নালিশটি করিলে রামচরণ “বাপ বাপ” বলিয়া ছয়টি মাস জেল খাটিয়া আসিবেন— তা নইলে ভজুর নাম ভজহরিই নয়।
এখন এ তর্কের আর মীমাংসাই হয় না। আমাদের হরিশখুড়ো বলিয়াছিলেন, “এক কাজ কর্, কুকুরটার নাকের ডগা থেকে ল্যাজের আগা পর্যন্ত দাঁড়ি টেনে তার ডান দিকটা তুই নে, বাঁ দিকটা ওকে দে— তা হ’লেই ঠিকমতো ভাগ হবে।” কিন্তু তাহারা ওরকম “ছিল্কা কুকুরের” মালিক হইতে রাজী নয়। কেউ কেউ বলিল, “তা কেন? ভাগাভাগির দরকার কি? গোটা কুকুরটাই রামার, আবার গোটা কুকুরটাই ভজুর।” কিন্তু এ কথায়ও তাহাদের খুব আপত্তি। একটা বই কুকুর নাই, তার গোটা কুকুরটাই যদি রামার হয় তবে ভজুর আবার কুকুর আসে কোথা হইতে? আর রামার গোটা কুকুরটাই যদি ভজুর হয়, তবে রামার আর থাকিল কি? কুকুর থেকে কুকুর বাদ, বাকি রইল শূন্যি!
এখন তোমরা যদি ইহার মীমাংসা করিয়া দাও।
খৃস্টবাহন
তার নাম অফেরো। অমন পাহাড়ের মত শরীর, অমন সিংহের মত বল, অমন আগুনের মত তেজ, সে ছাড়া আর কারও ছিল না। বুকে তার যেমন সাহস, মুখে তার তেমনি মিষ্টি কথা। কিন্তু যখন তার বয়স অল্প, তখনই সে তার সঙ্গীদের ছেড়ে গেল; যাবার সময় বলে গেল, “যদি রাজার মত রাজা পাই, তবে তার গোলাম হয়ে থাকব। আমার মনের মধ্যে কে যেন বলে দিচ্ছে, তুমি আর কারও চাকরি করো না; যে রাজা সবার বড়, সংসারে যার ভয় নেই, তারই তুমি খোঁজ কর।” এই বলে অফেরো কোথায় জানি বেরিয়ে গেল।
পৃথিবীতে কত রাজা, তাদের কত জনের কত ভয়। প্রজার ভয়, শত্রুর ভয়, যুদ্ধের ভয়, বিদ্রোহের ভয়— ভয়ে কেউ আর নিশ্চিন্ত নেই। এরকম হাজার দেশ ছেড়ে ছেড়ে অফেরো এক রাজ্যে এল, সেখানে রাজার ভয়ে সবাই খাড়া! চোরে চুরি করতে সাহস পায় না, কেউ অন্যায় করলে ভয়ে কাঁপে। অস্ত্রেশস্ত্রে সৈন্যসামন্তে রাজার প্রতাপ দশদিক দাপিয়ে আছে। সবাই বলে, “রাজার মত রাজা।” তাই শুনে অফেরো তাঁর চাকর হয়ে রইল।
তারপর কতদিন গেল— এখন অফেরো না হ’লে রাজার আর চলে না— উঠতে বসতে তার ডাক পড়ে। রাজা যখন সভায় বসেন অফেরো তাঁর পাশে খাড়া। রাজার মুখের প্রত্যেকটি কথা সে আগ্রহ করে শোনে! রাজার চালচলন ধরনধারণ ভাবভঙ্গি— সব তার আশ্চর্য লাগে। আর রাজা যখন শাসন করেন, চড়া গলায় হুকুম দেন, অফেরো তখন আবাক হয়ে ভাবে, “যদি রাজার মত রাজা কেউ থাকে, তবে সে এই!”
তারপর একদিন রাজার সভায় কথায় কথায় কে যেন শয়তানের নাম করেছে। শুনে রাজা গম্ভীর হয়ে গেলেন। অফেরো চেয়ে দেখলে রাজার চোখে হাসি নেই, মুখখানি তাঁর ভাবনা ভরা। অফেরো তখন জোড়হাতে দাঁড়িয়ে বলল, “মহারাজের ভাবনা কিসের? কি আছে তাঁর ভয়ের কথা?” রাজা হেসে বললেন, “এক আছে শয়তান আর আছে মৃত্যু— এ ছাড়া আর কাকে ডরাই?” অফেরো বলল, “হায় হায়, আমি এক কার চাকরি করতে এলাম? এ যে শয়তানের কাছে খাটো হয়ে গেল। তবে যাই শয়তানের রাজ্যে; দেখি সে কেমন রাজা!” এই বলে সে শয়তানের খোঁজে বেরুল।
পথে কত লোক আসে যায়— শয়তানের খবর জিজ্ঞাসা করলে তারা বুকে হাত দেয় আর দেবতার নাম করে, আর সবাই বলে, “তার কথা ভাই বলো না, সে যে কোথায় আছে, কোথায় নেই কেউ কি তা বলতে পারে?” এমনি করে খুঁজে খুঁজে কতগুলো নিষ্কর্মা কুঁড়ের দলে শয়তানকে পাওয়া গেল। অফেরোকে পেয়ে শয়তানের ফূর্তি দেখে কে! এমন চেলা সে আর কখনও পায়নি। শয়তান বলল, “এস এস, আমি তোমায় তামাসা দেখাই। দেখবে আমার শক্তি কত?” শয়তান তাকে ধনীর প্রাসাদে নিয়ে গেল, সেখানে টাকার নেশায় মত্ত হয়ে, লোকে শয়তানের কথায় ওঠে বসে; গরীবের ভাঙা কুঁড়ের ভিতরে গেল, সেখানে এক মুঠো খাবার লোভে পেটের দায়ে বেচারীরা পশুর মত শয়তানের দাসত্ব করে। লোকেরা সব চলছে ফিরছে, কে যে কখন ধরা পড়ছে, কেউ হয়ত জানতে পারে না; সবাই মিলে মারছে, কাটছে, কোলাহল করছে “শয়তানের জয়।”
সব দেখে শুনে অফেরোর মনটা যেন দমে গেল। সে ভাবল, “রাজার সেরা রাজা বটে, কিন্তু আমার ত কৈ এর কাজেতে মন লাগছে না।” শয়তান তখন মুচকি মুচকি হেসে বললে, “চল ত ভাই, একবারটি এই শহর ছেড়ে পাহাড়ে যাই। সেখানে এক ফকির আছেন, তিনি নাকি বেজায় সাধু। আমার তেজের সামনে তাঁর সাধুতার দৌড় কতখানি, তা’ একবার দেখতে চাই।”
পাহাড়ের নীচে রাস্তার চৌমাথায় যখন তারা এসেছে, শয়তান তখন হঠাৎ কেমন ব্যস্ত হয়ে থমকিয়ে গেল— তারপর বাঁকা রাস্তা ঘুরে তড়্বড়্ করে চলতে লাগল। অফেরো বললে, “আরে মশাই, ব্যস্ত হল কেন?” শয়তান বললে, “দেখছ না ওটা কি?!” অফেরো দেখল, একটা ক্রুশের মত কাঠের গায়ে মানুষের মূর্তি আঁকা! মাথায় তার কাঁটার মুকুট— শরীরে তার রক্তধারা! সে কিছু বুঝতে পারল না। শয়তান আবার বললে, “দেখছ না ঐ মানুষকে— ও যে আমায় মানে না, মরতে ডরায় না,— বাবারে! ওর কাছে কি ঘেঁষতে আছে? ওকে দেখলেই তফাৎ হটি।” বলতে বলতে শয়তানের মুখখানা চামড়ার মত শুকিয়ে এল।
তখন অফেরো হাঁপ ছেড়ে বললে, “বাঁচালে ভাই! তোমার চাকরি আর আমায় করতে হল না। তোমায় মানে না, মরতেই ডরায় না, সেইজনকে যদি পাই তবে তারই গোলাম হয়ে থাকি।” এই বলে আবার সে খোঁজে বেরুল।
তারপর যার সঙ্গে দেখা হয়, তাকেই সে জিজ্ঞাসা করে, “সেই ক্রুশের মানুষকে কোথায় পাব?”— সবাই বলে, খুঁজতে থাক, একদিন তবে পাবেই পাবে। তারপর একদিন চলতে চলতে সে এক যাত্রীদলের দেখা পেল। গায়ে তাদের পথের ধূলা, হাঁটতে হাঁটতে সবাই শ্রান্ত, কিন্তু তবু তাদের দুঃখ নাই— হাসতে হাসতে গান গেয়ে সবাই মিলে পথ চলছে। তাদের দেখে অফেরোর বড় ভাল লাগল— সে বললে, “তোমরা কে ভাই? কোথায় যাচ্ছ?” তারা বললে, “ক্রুশের মানুষ যীশু খৃষ্ট— আমরা সবাই তাঁরই দাস। যে পথে তিনি গেছেন, সেই পথের খোঁজ নিয়ছি।” শুনে অফেরো তাদের সঙ্গ নিল।
সে পথ গেছে অনেক দূর। কত রাত গেল দিন গেল, পথ তবু ফুরায় না— চলতে চলতে সবাই ভাবছে, বুঝি পথের শেষ নাই। এমন সময় সন্ধ্যার ঝাপসা আলোয় পথের শেষ দেখা দিল। ওপারে স্বর্গ, এপারে পথ, মাঝে অন্ধকার নদী। নৌকা নাই, কূল নাই, মাঝে মাঝে ডাক আসে, “পার হয়ে এস।” অফেরো ভাবল, ‘কি করে এরা সব পার হবে? কত অন্ধ, খঞ্জ, কত অক্ষম বৃদ্ধ, কত অসহায় শিশু— এরা সব পার হবে কি ক’রে?’ যাঁরা বৃদ্ধ, তাঁরা বললেন, “দূত আসবে। ডাক পড়বার সময় হলে, তখন তাঁর দূত আসবে।”
বলতে বলতে দূত এসে ডাক দিল। একটি ছোট মেয়ে ভুগে ভুগে রোগা হয়ে গেছে, সে নড়তে পারে না, বাইতে পারে না, দূত তাকে বলে গেল,— “তুমি এস, তোমার ডাক পড়েছে।” শুনে তার মুখ ফুটে হাসি বেরুল, সে উৎসাহে চোখ মেলে উঠে বসল। কিন্তু হায়! অন্ধকার নদী, অকূল তার কালো জল, স্রোতের টানে ফেনিয়ে উঠছে— সে নদী পার হবে কেমন করে? জলের দিকে তাকিয়ে তার বুকের ভিতরে দুর্ দুর্ করে উঠল। ভয়ে দু চোখ ঢেকে নদীর তীরে একলা দাঁড়িয়ে মেয়েটি তখন কাঁদতে লাগল। তাই দেখে সকলের চোখে জল এল, কিন্তু যেতেই যখন হবে তখন আর উপায় কি? মেয়েটির দুঃখে অফেরোর মন একেবারে গলে গেল। সে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল। “ভয় নাই— আমি আছি।” কোথা হতে তার মনে ভরসা এল, শরীরে তার দশগুণ শক্তি এল— সে মেয়েটিকে মাথায় করে, স্রোত ঠেলে, আঁধার ঠেলে, বরফের মত ঠাণ্ডা নদী মনের আনন্দে পার হয়ে গেল। মেয়েটিকে ওপারে নামিয়ে সে বলল, “যদি সেই ক্রুশের মানুষের দেখা পাও, তাঁকে বলো, এ কাজ আমার বড় ভাল লেগেছে— যতদিন আমার ডাক না পড়ে, আমি তাঁর গোলাম হয়ে এই কাজেই লেগে থাকব।”
সেই থেকে তার কাজ হল নদী পারাপার করা। সে বড় কঠিন কাজ! কত ঝড়ের দিনে কত আঁধার রাতে যাত্রীরা সব পার হয়— সে অবিশ্রাম কেবলই তাদের পৌঁছে দেয় আর ফিরে আসে। তার নিজের ডাক যে কবে আসবে, তা ভাববার আর সময় নেই।
একদিন গভীর রাত্রে তুফান উঠল। আকাশ ভেঙে পৃথিবী ধুয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে এল। ঝড়ের মুখে স্রোতের বেগে পথ ঘাট সব ভাসিয়ে দিল— হাওয়ার পাকে পাগল হয়ে নদীর জল ক্ষেপে উঠল। অফেরো সেদিন শ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে— সে ভেবেছে, এমন রাতে কেউ কি আর পার হতে চায়! এমন সময় ডাক শোনা গেল। অতি মিষ্টি কচি গলায় কে যেন বলছে, “আমি এখন পার হব।” অফেরো তাড়াতাড়ি উঠে দেখল, ছোট্ট একটি শিশু ঝড়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, আর বলছে, “আমার ডাক এসেছে, আমি এখন পার হব।” অফেরো বললে, “আচ্ছা! এমন দিনে তোমায় পার হতে হবে! ভাগ্যিস আমি শুনতে পেয়েছিলাম।” তারপর ছেলেটিকে কাঁধে নিয়ে “ভয় নাই”, “ভয় নাই” বলতে বলতে সে দুরন্ত নদী পার হয়ে গেল।
কিন্তু এবারেই শেষ পার। ওপারে যেমনি যাওয়া অমনি তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে পড়ল, চোখ যেন ঝাপসা হয়ে গেল, গলার স্বর জড়িয়ে গেল। তারপর যখন সে তাকাল তখন দেখল, ঝড় নেই আঁধার নেই, সেই ছোট্ট শিশুটিও নেই— আছেন শুধু এক মহাপুরুষ, মাথায় তাঁর আলোর মুকুট। তিনি বললেন, “আমিই ক্রুশের মানুষ— আমিই আজ তোমায় ডাক দিয়েছি। এতদিন এত লোক পার করেছ, আজ আমায় পার করতে গিয়ে নিজেও পার হলে, আর তারি সঙ্গে শয়তানের পাপের বোঝা কত যে পার করেছ তা তুমিও জান না। আজ হতে তোমার অফেরো নাম ঘুচল; এখন তুমি Saint Christopher— সাধু খৃষ্টবাহন! যাও, স্বর্গের যাঁরা শ্রেষ্ঠ সাধু, তাঁদের মধ্যে তুমি আনন্দে বাস কর।”
গরুর বুদ্ধি
পণ্ডিতমশাই ভট্চার্যি বামুন, সাদাসিধে শান্তশিষ্ট নিরীহ মানুষ। বাড়িতে তাঁর সরষের তেলের দরকার পড়েছে, তাই তিনি কলুর বাড়ি গেছেন তেল কিনতে।
কলুর ঘরে মস্ত ঘানি, একটা গরু গম্ভীর হয়ে সেই ঘানি ঠেলছে, তার গলায় ঘণ্টা বাঁধা। গরুটা চলছে চলছে আর ঘানিটা ঘুরছে, আর সরষে পিষে তা থেকে তেল বেরুচ্ছে। আর গলার ঘণ্টাটা টুংটাং টুংটাং ক’রে বাজছে।
পণ্ডিতমশাই রোজই আসেন রোজই দেখেন, কিন্তু আজ তাঁর হঠাৎ ভারি আশ্চর্য বোধ হল। তিনি চোখমুখ গোল ক’রে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাই তো! এটা তো ভারি চমৎকার ব্যাপার!
কলুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ওহে কলুর পো, ও জিনিসটা কি হে?” কলু বলল, “আজ্ঞে ওটা ঘানিগাছ, ওতে তেল হয়।” পণ্ডিতমশাই ভাবলেন— এটা কি রকম হল? আম গাছে আম হয়, জাম গাছে জাম হয়, আর ঘানি গাছের বেলায় তেল হয় মানে কি? কলুকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “ঘানি ফল হয় না?” কলু বললে, “সে আবার কি?”
পণ্ডিতমশাই টিকিতে হাত বুলিয়ে ভাবতে লাগলেন তাঁর প্রশ্নটা বোধহয় ঠিক হয়নি। কিন্তু কোথায় যে ভুল হয়েছে, সেটা তিনি ভেবে উঠতে পারলেন না। তাই খানিকক্ষণ চুপ ক’রে তারপর বললেন, “তেল কী ক’রে হয়?” কলু বলল, “ঐখেনে সর্ষে দেয় আর গরুতে ঘানি ঠেলে— আর ঘানির চাপে তেল বেরোয়।” এইবারে পণ্ডিতমশাই খুব খুশি হ’য়ে ঘাড় নেড়ে টিকি দুলিয়ে বললেন, “ও বুঝেছি! তৈল নিষ্পেষণ যন্ত্র!”
তারপর কলুর কাছ থেকে তেল নিয়ে পণ্ডিতমশাই বাড়ি ফিরতে যাবেন, এমন সময় হঠাৎ তাঁর মনে আর একটা খট্কা লাগল- ‘গরুর গলায় ঘণ্টা কেন?’ তিনি বললেন, “ও কলুর পো, সবি তো বুঝলুম, কিন্তু গরুর গলায় ঘণ্টা দেবার অর্থ কী? ওতে কি তেল ঝাড়াবার সুবিধা হয়?” কলু বলল, “সব সময় তো আর গরুটার উপরে চোখ রাখতে পারি নে, তাই ঘণ্টাটা বেঁধে রেখেছি। ওটা যতক্ষণ বাজে, ততক্ষণ বুঝতে পারি যে গরুটা চলছে। থামলেই ঘণ্টার আওয়াজ বন্ধ হয়, আমিও টের পেয়ে তাড়া লাগাই।”
পণ্ডিতমশাই এমন অদ্ভুত ব্যাপার আর দেখেননি; তিনি বাড়ি যাচ্ছেন আর কেবলই ভাবছেন— ‘কলুটার কি আশ্চর্য বুদ্ধি! কি কৌশলটাই খেলিয়েছে! গরুটার আর ফাঁকি দেবার যো নেই। একটু থেমেছে কি ঘণ্টা বন্ধ হয়েছে, আর কলুর পো তেড়ে উঠেছে!’ এই রকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তাঁর মনে হল— ‘আচ্ছা, গরুটা যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে তাহলেও ত ঘণ্টা বাজবে, তখন কলুর পো টের পাবে কী ক’রে?’
ভট্চার্যিমশায়ের ভারি ভাবনা হল। গরুটা যদি শয়তানি ক’রে ফাঁকি দেয়, তা হলে কলুর ত লোকসান হয়। এই ভেবে তিনি আবার কলুর কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হে, ঐ যে ঘণ্টার কথাটা বললে, ওটার মধ্যে একটা মস্ত গলদ থেকে গেছে। গরুটা যদি ফাঁকি দিয়ে ঘণ্টা বাজায় তাহলে কী করবে?” কলু বিরক্ত হয়ে বললে, “ফাঁকি দিয়ে আবার ঘণ্টা বাজাবে কি রকম?” পণ্ডিতমশাই বললেন, “মনে কর যদি এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে, তা হলেও ত ঘণ্টা বাজবে, কিন্তু ঘানি ত চলবে না। তখন কী করবে?” কলু তখন তেল মাপছিল, সে তেলের পলাটা নামিয়ে পণ্ডিতমশায়ের দিলে ফিরে গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার গরু কি ন্যায়শাস্ত্র পড়ে পণ্ডিত হয়েছে, যে তার অত বুদ্ধি হবে? সে আপনার টোলে যায়নি, শাস্ত্রও পড়েনি, আর গরুর মাথায় অত মতলব খেলে না।”
পণ্ডিতমশাই ভাবলেন, ‘তাও তো বটে। মূর্খ গরুটা ন্যায়শাস্ত্র পড়েনি, তাই কলুর কাছে জব্দ আছে।’
গল্প
“বড়মামা, একটা গল্প বলো না।”
“গল্প? এক ছিল গ, এক ছিল ল আর এক ছিল প—”
“না— ও গল্পটা না। ওটা বিচ্ছিরি গল্প— একটা বাঘের গল্প বল।”
“আচ্ছা । যেখানে মস্ত নদী থাকে আর তার ধারে প্রকাণ্ড জঙ্গল থাকে— সেইখানে একটা মস্ত বাঘ ছিল আর ছিল একটা শেয়াল।”
“না, শেয়াল তো বলতে বলিনি— বাঘের গল্প।”
“আচ্ছা, বাঘ ছিল, শেয়াল-টেয়াল কিছু ছিল না। একদিন সেই বাঘ করেছে কি একটা ছোট্ট সুন্দর হরিণের ছানার ঘাড়ে হালুম ক’রে কামড়ে ধরেছে—”
“না— সেরকম গল্প আমার শুনতে ভালো লাগে না। একটা ভালো গল্প বল।”
“ভালো গল্প কোথায় পাব? আচ্ছা শোন— এক ছিল মোটা বাবু আর এক ছিল রোগা বাবু। মোটা বাবু কিনা মোটা, তাই তার নাম বিশ্বম্ভর, আর রোগা বাবু কিনা রোগা, তাই তার নাম কানাই।”
“বিস-কম্বল মানে কি মোটা, আর কানাই মানে রোগা?”
“না; মোটা কিনা, তাই তার মস্ত মোটা নাম— বিশ্-শম -ভর, আর রোগা লোকের নাম কানাই।”
“রোগা কানাই বলল, ‘মোটা বিশ্বম্ভর, তোমার এমন বিচ্ছিরি ঢাকাই জালার মতন চেহারা কেন?’ মোটা বিশ্বম্ভর বলল, ‘রোগা কানাই, তোর হাত পা কেন কাঠির মতন, হাড়গিলের ঠ্যাঙের মতন, রোদে-শুকনো দড়ির মতন।’ তখন তারা ভয়ানক চটে গেল। রোগা বলল, ‘মোট্কা লোকের বুদ্ধি মোটা।’ মোটা বলল, ‘রোগা লোকের কিপটে মন।’
“মোটা বুদ্ধি মানে কি বোকা বুদ্ধি?”
“হ্যাঁ। তারপর শোন— মোটা আর রোগা তখন খুব ঝগড়া করতে লাগল। এ বলল, ‘রোগা মানুষ ভালো নয়’— ও বলল, ‘মোটা হলেই দুষ্টু হয়।’ তখন তারা বলল, ‘আচ্ছা চল তো পণ্ডিতের কাছে— বইয়েতে কি লেখা আছে— জিজ্ঞাসা কর তো।’
“বইয়েতে কি সব কথা লেখা থাকে?”
“হ্যাঁ, থাকে। তারা তখন দুজনেই পণ্ডিতের কাছে গিয়ে নালিশ করল। পণ্ডিতমশাই নাকের আগায় চশমা এঁটে, কানের ফাঁকে কলম গুঁজে, মুণ্ডু নেড়ে, টিকি ঝেড়ে তেড়ে বললেন, ‘রোসো! দাঁড়াও, একটু বসো— রোগা এবং মোটা এদের কে কি রকম পাজী, বিচার করব আজই।’ এই বলে পণ্ডিতমশাই তাকিয়ার উপর পাশ ফিরে নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে লাগলেন। রোগা কানাই আর মোটা বিশ্বম্ভর বসেই আছে বসেই আছে— এক ঘণ্টা যায়, দু ঘণ্টা যায়! তখন পণ্ডিতমশাই চোখ রগড়িয়ে বললেন, ‘ব্যাপারখানা কি?’ বাবুরা বলল, ‘আজ্ঞে, সেই রোগা আর মোটার কথা।’ পণ্ডিত বললেন,’ঠিক ঠিক’— এই বলে প্রকাণ্ড একখানা বই নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে হেলেদুলে, ষাঁড়ের মতন সুরটি ক’রে তিনি বলতে লাগলেন— ‘বইয়ে আছে—
মোটকা মানুষ হোঁৎকা মুখ,
বুদ্ধি মোটা আহাম্মুক—’
অমনি রোগা কানাই হো হো ক’রে হেসে উঠল। তখন পণ্ডিত বললেন—
‘শুকনো লোকের শয়তানি
দেমাক দেখে হার মানি।’