এইটুকু বলতেই একটা শেয়াল শাম্লা মাথায় তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বলল, “হুজুর, কচু অতি অসার জিনিস। কচু খেলে গলা কুট্কুট্ করে, কচুপোড়া খাও বললে মানুষ চটে যায়। কচু খায় কারা? কচু খায় শুওর আর সজারু। ওয়াক্ থুঃ।” সজারুটা আবার ফ্যাঁত্ফ্যাঁত্ করে কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমির সেই প্রকাণ্ড বই দিয়ে তার মাথায় এক থাবড়া মেরে জিজ্ঞাসা করল, “দলিলপত্র সাক্ষী-সাবুদ কিছু আছে?” সজারু নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঐ তো ওর হাতে সব দলিল রয়েছে।” বলতেই কুমিরটা নেড়ার কাছ থেকে একতাড়া গানের কাগজ কেড়ে নিয়ে হঠাত্ এক জায়গা থেকে পড়তে লাগল-
একের পিঠে দুই গোলাপ চাঁপা জুঁই সান্ বাঁধানো ভুঁই
চৌকি চেপে শুই ইলিশ মাগুর রুই গোবর জলে ধুই
পোঁটলা বেঁধে থুই হিন্চে পালং পুঁই কাঁদিস কেন তুই।
সজারু বলল, “আহা ওটা কেন? ওটা তো নয়।” কুমির বলল, “তাই নাকি? আচ্ছা দাঁড়াও।” এই বলে সে আবার একখানা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগল-
চাঁদনি রাতের পেতনীপিসি সজনেতলায় খোঁজ্ না রে-
থ্যাঁতলা মাথা হ্যাংলা সেথা হাড় কচাকচ্ ভোজ মারে।
চালতা গাছে আল্তা পরা নাক ঝুলানো শাঁখচুনি
মাক্ড়ি নেড়ে হাঁকড়ে বলে, আমায় তো কেঁউ ডাঁকছ নি!
মুণ্ডু ঝোলা উল্টোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
বলছে দুলে, মিন্সেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে।
সজারু বলল, “দূর ছাই! কি যে পড়ছে তার নেই ঠিক।”
কুমির বলল, “তাহলে কোনটা, এইটা?- দই দম্বল, টেকো অম্বল, কাঁথা কম্বল করে সম্বল বোকা ভোম্বল- এটাও নয়? আচ্ছা তা হলে দাঁড়াও দেখছি- নিঝুম নিশুত রাতে, একা শুয়ে তেতালাতে, খালি খালি খিদে পায় কেন রে?- কি বললে?- ও-সব নয়? তোমার গিন্নীর নামে কবিতা?- তা সে কথা আগে বললেই হত। এই তো- রামভজনের গিন্নীটা, বাপ রে যেন সিংহীটা! বাসন নাড়ে ঝনার্ঝন, কাপড় কাচে দমাদ্দম্।- এটাও মিলছে না? তা হলে নিশ্চয় এটা-
খুসখুসে কাশি ঘুষঘুষে জ্বর, ফুসফুসে ছ্যাঁদা বুড়ো তুই মর্।
মাজরাতে ব্যথা পাঁজরাতে বাত, আজ রাতে বুড়ো হবি কুপোকাত!”
সজারুটা ভয়ানক কাঁদতে লাগল, “হায়, হায়! আমার পয়সাগুলো সব জলে গেল! কোথাকার এক আহাম্মক উকিল, দলিল খুঁজে পায় না!”
নেড়াটা এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল, সে হঠাত্ বলে উঠল, “কোনটা শুনতে চাও? সেই যে- বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু- সেইটে?”
সজারু ব্যস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেইটে, সেইটে।”
অমনি শেয়াল আবার তেড়ে উঠল, “বাদুড় কি বলে? হুজুর, তা হলে বাদুড়গোপালকে সাক্ষী মানতে আজ্ঞা হোক।”
কোলাব্যাঙ গাল-গলা ফুলিয়ে হেঁকে বলল, “বাদুড়গোপাল হাজির?”
সবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কোথাও বাদুড় নেই। তখন শেয়াল বলল, “তা হলে হুজুর, ওদের সক্কলের ফাঁসির হুকুম হোক।”
কুমির বলল, “তা কেন? এখন আমরা আপিল করব?”
প্যাঁচা চোখ বুজে বলল, “আপিল চলুক! সাক্ষী আন।”
কুমির এদিক-ওদিক তাকিয়ে হিজি বিজ্ বিজ্কে জিজ্ঞাসা করল, “সাক্ষী দিবি? চার আনা পয়সা পাবি।” পয়সার নামে হিজি বিজ্ বিজ্ তড়াক্ করে সাক্ষী দিতে উঠেই ফ্যাক্ফ্যাক্
করে হেসে ফেলল।
শেয়াল বলল, “হাসছ কেন?”
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “একজনকে শিখিয়ে দিয়েছিল, তুই সাক্ষী দিবি যে, বইটার সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া আর মাথার উপর লালকালির ছাপ। উকিল যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি আসামীকে চেন? অমনি সে বলে উঠেছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া, মাথার উপর লালকালির ছাপ- হোঃ হোঃ হোঃ হো-”
শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, “তুমি সজারুকে চেন?”
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “হ্যাঁ, সজারু চিনি, কুমির চিনি, সব চিনি। সজারু গর্তে থাকে, তার গায়ে লম্বা-লম্বা কাঁটা, আর কুমিরের গায়ে চাকা-চাকা ঢিপির মতো, তারা ছাগল-টাগল ধরে খায়।” বলতেই ব্যাকরণ শিং ব্যা-ব্যা করে ভয়ানক কেঁদে উঠল।
আমি বললাম, “আবার কি হল?”
ছাগল বলল, “আমার সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়েছিল, তাই বাকি আধখানা মরে গেল।”
আমি বললাম, “গেল তো গেল, আপদ গেল। তুমি এখন চুপ কর।”
শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, “তুমি মোকদ্দমার কিছূ জানো?”
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “তা আর জানি নে? একজন নালিশ করে তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে ধরে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী। তারও একজন উকিল থাকে। এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে! আর একজন জজ থাকে, সে বসে-বসে ঘুমোয়।”
প্যাঁচা বলল, “কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি।”
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “আরো অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।” বলেই সে ফ্যাক্ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল।
শেয়াল বলল, “আবার কি হল?”
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে। হোঃ হোঃ হোঃ হো-”
শেয়াল বলল, “বটে? তোমার নাম কি শুনি?”
সে বলল, “এখন আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্।”
শেয়াল বলল, “নামের আবার এখন আর তখন কি?”
হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “তাও জানো না? সকালে আমার নাম থাকে আলুনারকোল আবার আর একটু বিকেল হলেই আমার নাম হয়ে যাবে রামতাড়ু।”