নামছে ত নামছেই-ঠিক যখন মাটিতে মাথা ঠেকব ঠেকব করছে তখনই, যতিন ধড়মড় করে উঠে বসল। ভগবান ই জানেন ঘুড়ির কি হল, যতিন দেখল সে শুয়ে আছে সিড়ির নিচে আর মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা।
কিছুদিন ভুগে, যতিন যখন সেরে উঠল, তার মা বললে, “সিঁড়ি থেকে পড়ে আমার যতিন খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। আর ছুটোছুটি করে না। একদম ছট্ফটানি নেই! তা না হলে তার জুতো চার মাস টেকে কি করে!”
সত্যি বলতে-যতিন মুচি আর দর্জিকে এখনো ভোলেনি।
রাগের ওষুধ
কেদারবাবু বড় বদরাগী লোক। যখন রেগে বসেন, কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না।
একদিন তিনি মুখখানা বিষণ্ণ ক’রে বসে আছেন, এমন সময় আমাদের মাস্টারবাবু এসে বললেন, ‘কি হে কেদারকেষ্ট, মুখখানা হাঁড়ি কেন?”
কেদারবাবু বললেন, “আর মশাই, বলবেন না। আমার সেই রূপোবাঁধানো হুঁকোটা ভেঙে সাত টুকরো হয়ে গেল— মুখ হাঁড়ির মত হবে না তো কি বদনার মত হবে?”
মাস্টারমশাই বললেন, ‘বল কি হে? এ তো কাচের বাসন নয় কি মাটির পুতুল নয়— অমনি খামখা ভেঙে গেল, এর মানে কি?’
কেদারবাবু বললেন, ‘খামখা ভাঙতে যাবে কেন— কথাটা শুনুন না। হল কী,— কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নি। সকালবেলা উঠেছি, মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে বসব, এমন সময় কল্কেটা কাত হয়ে আমার ফরাসের উপর টিকের আগুন প’ড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি যেই আগুনটা সরাতে গেছি অমনি কিনা আঙ্গুলে ছ্যাঁক্ করে ফোস্কা প’ড়ে গেল। আছা, আপনিই বলুন— এতে কার না রাগ হয়? আরে, আমার হুঁকো, আমার কল্কে, আমার আগুন, আরাম ফরাস, আবার আমার উপরেই জুলুম! তাই আমি রাগ ক’রে— বেশি কিছু নয়— ঐ মুগুরখানা দিয়ে পাঁচ দশ ঘা মারতেই কিনা হতভাগা হুঁকোটা ভেঙে খান্ খান্!’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘তা যাই বল বাপু, এ রাগ বড় চণ্ডাল— রাগের মাথায় এমন কাণ্ড ক’রে বস, রাগটা একটু কমাও।’ ‘কমাও তো বললেন— রাগ যে মুখের কথায় বাগ মানবে— এ রাগ আমার তেমন নয়।’
‘দেখো, আমি এক উপায় বলি। শুনেছি, খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন ক’রে দশ গুনলে— রাগটা নাকি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তোমার যেমন রাগ, তাতে দশ-বারোতে কূলোবে না— তুমি একেবারে একশো পর্যন্ত গুনে দেখো।’
তারপর একদিন কেদারবাবু ইস্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। তখন ছুটির সময়, ছেলেরা খেলা করছে। হঠাৎ একটা মার্বেল ছুটে এসে কেদারবাবুর পায়ের হাড়ে ঠাঁই করে লাগল। আর যায় কোথা! কেদারবাবু ছাতের সমান এক লাফ দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছেলের দল যে যেখানে পারে একেবারে সটান চম্পট্। তখন কেদারবাবুর মনে হল মাস্টারবাবুর কথাটা একবার পরীক্ষা ক’রে দেখি। তিনি আরম্ভ করলেন, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-
ইস্কুলের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে বিড়্বিড়্ করে অঙ্ক বলছে, তাই দেখে ইস্কুলের দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে কয়েকজন লোক ডেকে আনল। একজন বলল, ‘কী হয়েছে মশাই?’ কেদারবাবু বললেন, ‘ষোল-সতেরো-আঠারো-উনিশ-কুড়ি-‘
সকলে বলল, ‘এ কী? লোকটা পাগল হল নাকি?— আরে, ও মশাই, বলি অমনধারা কচ্ছেন কেন?’ কেদারবাবু মনে মনে ভয়ানক চটলেও— তিনি গুনেই চলেছেন, ‘ত্রিশ-একত্রিশ-বত্রিশ-তেত্রিশ-‘ আবার খানিক বাদে আর একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘মশাই, আপনার কি অসুখ করেছে? কবরেজ মশাইকে ডাকতে হবে?’ কেদারবাবু রেগে আগুন হয়ে বললেন, ‘উনষাট-ষাট-একষট্টি-বাষট্টি-তেষট্টি-‘ দেখতে দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল— চারিদিকে গোলমাল, হৈ চৈ। তাই শুনে মাস্টারবাবু দেখতে এলেন, ব্যাপারখানা কি! ততক্ষণে কেদারবাবুর গোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি দুই চোখ লাল করে লাঠি ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, ‘ছিয়ানব্বুই-সাতানব্বুই-আটানব্বুই-নিরেনব্বুই-একশো— কোন্ হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যাবাদী বলেছিল একশো গুনলে রাগ থামে?’ বলেই ডাইনে বাঁয়ে দুম্দাম্ লাঠির ঘা।
লোকজন আব ছুটে পালাল। আর মাস্টারমশাই এক দৌড়ে সে যে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, আর সারাদিন বেরোলেন না।
রাজার অসুখ
কেদারবাবু বড় বদরাগী লোক। যখন রেগে বসেন, কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না।
একদিন তিনি মুখখানা বিষণ্ণ ক’রে বসে আছেন, এমন সময় আমাদের মাস্টারবাবু এসে বললেন, ‘কি হে কেদারকেষ্ট, মুখখানা হাঁড়ি কেন?”
কেদারবাবু বললেন, “আর মশাই, বলবেন না। আমার সেই রূপোবাঁধানো হুঁকোটা ভেঙে সাত টুকরো হয়ে গেল— মুখ হাঁড়ির মত হবে না তো কি বদনার মত হবে?”
মাস্টারমশাই বললেন, ‘বল কি হে? এ তো কাচের বাসন নয় কি মাটির পুতুল নয়— অমনি খামখা ভেঙে গেল, এর মানে কি?’
কেদারবাবু বললেন, ‘খামখা ভাঙতে যাবে কেন— কথাটা শুনুন না। হল কী,— কাল রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় নি। সকালবেলা উঠেছি, মুখ হাত ধুয়ে তামাক খেতে বসব, এমন সময় কল্কেটা কাত হয়ে আমার ফরাসের উপর টিকের আগুন প’ড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি যেই আগুনটা সরাতে গেছি অমনি কিনা আঙ্গুলে ছ্যাঁক্ করে ফোস্কা প’ড়ে গেল। আছা, আপনিই বলুন— এতে কার না রাগ হয়? আরে, আমার হুঁকো, আমার কল্কে, আমার আগুন, আরাম ফরাস, আবার আমার উপরেই জুলুম! তাই আমি রাগ ক’রে— বেশি কিছু নয়— ঐ মুগুরখানা দিয়ে পাঁচ দশ ঘা মারতেই কিনা হতভাগা হুঁকোটা ভেঙে খান্ খান্!’
মাস্টারমশাই বললেন, ‘তা যাই বল বাপু, এ রাগ বড় চণ্ডাল— রাগের মাথায় এমন কাণ্ড ক’রে বস, রাগটা একটু কমাও।’ ‘কমাও তো বললেন— রাগ যে মুখের কথায় বাগ মানবে— এ রাগ আমার তেমন নয়।’
‘দেখো, আমি এক উপায় বলি। শুনেছি, খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন ক’রে দশ গুনলে— রাগটা নাকি শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু তোমার যেমন রাগ, তাতে দশ-বারোতে কূলোবে না— তুমি একেবারে একশো পর্যন্ত গুনে দেখো।’
তারপর একদিন কেদারবাবু ইস্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। তখন ছুটির সময়, ছেলেরা খেলা করছে। হঠাৎ একটা মার্বেল ছুটে এসে কেদারবাবুর পায়ের হাড়ে ঠাঁই করে লাগল। আর যায় কোথা! কেদারবাবু ছাতের সমান এক লাফ দিয়ে লাঠি উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছেন। ছেলের দল যে যেখানে পারে একেবারে সটান চম্পট্। তখন কেদারবাবুর মনে হল মাস্টারবাবুর কথাটা একবার পরীক্ষা ক’রে দেখি। তিনি আরম্ভ করলেন, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-
ইস্কুলের মাঝখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে বিড়্বিড়্ করে অঙ্ক বলছে, তাই দেখে ইস্কুলের দারোয়ান ব্যস্ত হয়ে কয়েকজন লোক ডেকে আনল। একজন বলল, ‘কী হয়েছে মশাই?’ কেদারবাবু বললেন, ‘ষোল-সতেরো-আঠারো-উনিশ-কুড়ি-‘
সকলে বলল, ‘এ কী? লোকটা পাগল হল নাকি?— আরে, ও মশাই, বলি অমনধারা কচ্ছেন কেন?’ কেদারবাবু মনে মনে ভয়ানক চটলেও— তিনি গুনেই চলেছেন, ‘ত্রিশ-একত্রিশ-বত্রিশ-তেত্রিশ-‘ আবার খানিক বাদে আর একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘মশাই, আপনার কি অসুখ করেছে? কবরেজ মশাইকে ডাকতে হবে?’ কেদারবাবু রেগে আগুন হয়ে বললেন, ‘উনষাট-ষাট-একষট্টি-বাষট্টি-তেষট্টি-‘ দেখতে দেখতে লোকের ভিড় জমে গেল— চারিদিকে গোলমাল, হৈ চৈ। তাই শুনে মাস্টারবাবু দেখতে এলেন, ব্যাপারখানা কি! ততক্ষণে কেদারবাবুর গোনা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তিনি দুই চোখ লাল করে লাঠি ঘোরাচ্ছেন আর বলছেন, ‘ছিয়ানব্বুই-সাতানব্বুই-আটানব্বুই-নিরেনব্বুই-একশো— কোন্ হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া মিথ্যাবাদী বলেছিল একশো গুনলে রাগ থামে?’ বলেই ডাইনে বাঁয়ে দুম্দাম্ লাঠির ঘা।
লোকজন আব ছুটে পালাল। আর মাস্টারমশাই এক দৌড়ে সে যে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, আর সারাদিন বেরোলেন না।
সত্যি
ইনি কে জানো না বুঝি? ইনি নিধিরাম পাটকেল।
কোন নিধিরাম? যার মিঠাইয়ের দোকান আছে?
আরে দুৎ! তা কেন? নিধিরাম ময়রা নয়— প্রে—ফে—সার্ নিধিরাম!
ইনি কি করেন?
কি করেন আবার কি? আবিষ্কার করেন!
ও বুঝছি! ঐ যে উত্তর মেরুতে যায়, যেখানে ভয়ানক ঠাণ্ডা— মানুষজন সব মরে যায়—
দূর মুখ্যু! আবিষ্কার বললেই বুঝি উত্তর মেরু বুঝতে হবে, বা দেশ বিদেশ ঘুরতে হবে? তাছাড়া বুঝি আবিষ্কার হয় না?
ও! তাহলে?
মানে, বিজ্ঞান শিখে নানা রকম রাসায়নিক প্রক্রিয়া করে নতুন নতুন কথা শিখছেন, নতুন নতুন জিনিস বানাচ্ছেন। ইনি আজ পর্যন্ত কত কী আবিষ্কার করেছেন তোমরা তার খবর রাখ কি? ওঁর তৈরি সেই গন্ধবিকট তেলের নাম শোননি? সেই তেলের আশ্চর্য গুণ! আমি নিজে মাখিনি বা খাইনি কিন্তু আমাদের বাড়িওয়ালার কে যেন বলেছেন যে সে ভয়ঙ্কর তেল। সে তেল খেলে পরে পিলের ওষুধ, মাখলে পরে ঘায়ের মলম, আর গোঁফে লাগালে দেড় দিনে আধহাত লম্বা গোঁফ বেরোয়।
সে কী মশাই! তাও কি হয়?
আলবাৎ হয়! বললে বিশ্বাস করবে না, কিন্তু নন্দলাল ডাক্তার বলেছে ভুলু মিত্তিরের খোকাকে ওই তেল মাখিয়ে তার এয়া মোটা গোঁফ হয়ে গেছিল।
কি আবোল তাবোল বকছেন মশাই!
বিশ্বেস করতে না চাও বিশ্বেস করো না, কিন্তু চোখে যা দেখেছ তা বিশ্বেস করবে ত? কী কাণ্ড হচ্ছে দেখছ তো? ঐ দেখ নিধিরাম পাটকেলের নতুন কামান তৈরি হচ্ছে। নতুন কামান, নতুন গোলা, নতুন সব। একি সহজ কথা ভেবেছ? ওই রকম আর গোটা পঞ্চাশ কামান আর হাজার দশেক গোলা তৈরি হলেই উনি লড়াই করতে বেরুবেন। সব নতুন রকম হচ্ছে বুঝি?
নতুন না তো কি? নতুন, অথচ সস্তা! ওই দেখ কামান আর গোলা। কামানে কি আছে? নল আছে আর বাতাস ভরা হাপর আছে। নলের মধ্যে গোলা ভরে খুব খানিক দম নিয়ে ভ—শ্ করে যেমনি হাপর চেপে ধরবে অমনি হশ্ করে গোলা গিয়ে ছিট্কে পড়বে আর ফট্ করে ফেটে যাবে।
তারপরে?
তার পরেই তো হচ্ছে আসল মজা। গোলার মধ্যে কি আছে জান? বিছুটির আরক আছে, লঙ্কার ধোঁয়া আছে, ছারপোকার আতর আছে গাঁদালের রস আছে, পচা মুলোর একস্ট্রাকট আছে, আরও যে কত কি আছে, তার নামও আমি জানি না। যত রকম উৎকট বিশ্রী গন্ধ আছে, যত রকম ঝাঁঝালো তেজাল বিটকেল জিনিস আছে, আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক কৌশলে সব তিনি মিশিয়েছেন ঐ গোলার মধ্যে। সেদিন ছোট একটা গোলা ওঁর হাত থেকে প’ড়ে ফেটে গিয়েছিল শুনেছ তো?
তাই নাকি? তারপর হল কি?
যেমনি গোলা ফাটল অমনি তিনি চট্ করে একটা ধামা চাপা দিয়েছিলেন, নইলে কি হত কে জানে। তবু দেখছ ওষুধের গন্ধে আর ঝাঁঝে প্রফেসারের চেহারা কেমন হয়ে গেছে। তার আগে ওঁর চেহারা ছিল ঠিক কার্তিকের মত; মাথাভরা কোঁকড়া চুল আর এক হাত লম্বা দাড়ি! সত্যি!
সত্যি নাকি?
সত্যি না তো কি?
সবজান্তা
আমাদের ‘সবজান্তা’ দুলিরামের বাবা কোন একটা খবরের কাগজের সম্পাদক । সেই জন্য আমাদের মধ্যে অনেকেরই মনে তাহার সমস্ত কথার উপরে অগাধ বিশ্বাস দেখা যাইত । যে কোন বিষয়েই হোক, জার্মানির লড়াইয়ের কথাটাই হোক আর মোহনবাগানের ফুটবলের ব্যাখ্যাই হোক, দেশের বড় লোকদের ঘরোয়া গল্পই হোক, আর নানারকম উৎকট রোগের বর্ণনাই হোক, যে কোন বিষয়ে সে মতামত প্রকাশ করিত । একদল ছাত্র অসাধারণ শ্রদ্ধার সঙ্গে সে সকল কথা শুনিত । মাস্টার মহশয়দের মধ্যেও কেহ কেহ এ বিষয়ে তাহার ভারি পক্ষপাতী ছিলেন । দুনিয়ার সকল খবর লইয়া সে কারবার করে, সেইজন্য পণ্ডিত মহাশয় তাহার নাম দিয়াছিলেন ‘সবজান্তা’ । আমার কিন্তু বরাবরই বিশ্বাস ছিল যে, সবজান্তা যতখানি পাণ্ডিত্য দেখায়, আসলে তাহার অনেকখানি উপরচালাকি । দু-চারটি বড়-বড় শোনা কথা আর খবরের কাগজ পড়িয়া দু-দশটা খবর- এইমাত্র তাহার পুঁজি, তারই উপর রঙচঙ দিয়া নানারকম বাজে গল্প জুড়িয়া সে তাহার বিদ্যা জাহির করিত ।
একদিন আমাদের ক্লাশে পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে সে নায়েগ্রা জলপ্রপাতের গল্প করিয়াছিল । তাহাতে সে বলে যে, নায়েগ্রা দশ মাইল উঁচু ও একশত মাইল চওড়া ! একজন ছাত্র বলিল, “সে কি করে হবে ? এভারেস্ট সবচেয়ে উঁচু পাহাড়, সে-ই মোটে পাঁচ মাইল ।” সবজান্তা তাকে বাধা দিয়া বলিল, “তোমরা তো আজকাল খবর রাখ না !” যখনই তার কথায় আমরা সন্দেহ বা আপত্তি করিতাম, সে একটা কিছু যা তা নাম করিয়া আমাদের ধমক দিয়া বলিত, “তোমরা কি অমুকের চেয়ে বেশি জানো ?” আমরা বাহিরে সব সহ্য করিয়া থাকিতাম, কিন্তু এক এক সময় রাগে গা জ্বলিয়া যাইত । সবজান্তা যে আমাদের মনের ভাবটা বুঝিত না, তাহা নয় । সে তাহা বিলক্ষণ বুঝিত এবং সর্বদাই এমন ভাব প্রকাশ করিত যে, আমরা তাহার কথা মানি বা না মানি, তাহাতে কিছুমাত্র আসে যায় না । নানারকম খবর ও গল্প জাহির করিবার সময় মাঝে মাঝে আমাদের শুনাইয়া বলিত, “অবশ্যি কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এসব কথা মানবেন না ।” অথবা “যাঁরা না পড়েই খুব বুদ্ধিমান তাঁরা নিশ্চয়ই এ-সব উড়িয়ে দিতে চাইবেন”- ইত্যাদি । ছোকরা বাস্তবিক অনেক রকম খবর রাখিত, তার উপর বোলচালগুলিও বেশ ছিল ঝাঁঝালো রকমের, কাজেই আমরা বেশি তর্ক করিতে সাহস পাইতাম না ।
তাহার পরে একদিন, কি কুক্ষণে, তাহার এক মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া আমাদেরই স্কুলের কাছে বাসা লইয়া বসিলেন । তখন আর সবজান্তাকে পায় কে ! তাহার কথাবার্তার দৌড় এমন আশ্চর্য রকম বাড়িয়া চলিল, যে মনে হইত বুঝি বা তাহার পরামর্শ ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পুলিশের পেয়াদা পর্যন্ত কাহারও কাজ চলিতে পারে না । স্কুলের ছাত্র মহলে তাহার খাতির ও প্রতিপত্তি এমন আশ্চর্য রকম জমিয়া গেল যে, আমরা কয়েক বেচারা, যাহারা বরাবর তাহাকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিয়া আসিয়াছি- একেবারে কোণঠাসা হইয়া রহিলাম । এমন কি আমাদের মধ্য হইতে দু-একজন তাহার দলে যোগ দিতেও আরম্ভ করিল ।
অবস্থাটা শেষটায় এমন দাঁড়াইল যে, ইস্কুলে আমাদের টেকা দায় ! দশটার সময় মুখ কাঁচুমাচু করিয়া ক্লাশে ঢুকিতাম আর ছুটি হইলেই, সকলের ঠাট্টা-বিদ্রূপ হাসি-তামাশার হাত এড়াইবার জন্য দৌড়িয়া বাড়ি আসিতাম । টিফিনের সময়টুকু হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘরের সামনে একখানা বেঞ্চের উপর বসিয়া অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো পড়াশুনা করিতাম ।
এইরকম ভাবে কতদিন চলিত জানি না, কিন্তু একদিনের একটা ঘটনায় হঠাৎ সবজান্তা মহাশয়ের জারিজুরি সব এমনই ফাঁস হইয়া গেল যে, তাহার অনেকদিনের খ্যাতি ঐ একদিনেই লোপ পাইল- আর আমরাও সেইদিন হইতে একটু মাথা তুলিতে পারিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলাম । সেই ঘটনার গল্প বলিতেছি ।
একদিন শোনা গেল, লোহারপুরের জমিদার রামলালবাবু আমাদের স্কুলে তিন হাজার টাকা দিয়াছেন- একটা ফুটবল গ্রাউন্ড ও খেলার সরঞ্জামের জন্য । আরও শুনিলাম, রামলালবাবুর ইচ্ছা সেই উপলক্ষে আমাদের একদিন ছুটি ও একদিন রীতিমত ভোজের আয়োজন হয় ! কয়দিন ধরিয়া এই খবরটাই আমাদের প্রধান আলোচনার বিষয় হইয়া উঠিল । কবে ছুটি পাওয়া যাইবে, কবে খাওয়া এবং কি খাওয়া হইবে, এই সকল বিষয়ে জল্পনা চলিতে লাগিল । সবজান্তা দুলিরাম বলিল, যেবার সে দার্জিলিং গিয়াছিল, সেবার নাকি রামলালবাবু তাহাকে কেমন খাতির করিতেন, তাহার আবৃত্তি শুনিয়া কি কি প্রশংসা করিয়াছিলেন, এ বিষয়ে সে স্কুলে আগে এবং পরে, সারাটি টিফিনের সময় এবং সুযোগ পাইলে ক্লাশের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকেও নানা অসম্ভব রকম গল্প বলিত । ‘অসম্ভব’ বলিলাম বটে, কিন্তু তাহার চেলার দল সে সকল কথা নির্বিচারে বিশ্বাস করিতে একটুও বাধা বোধ করিত না ।
একদিন টিফিনের সময় উঠানের বড় সিঁড়িটার উপর একদল ছেলের সঙ্গে বসিয়া সবজান্তা গল্প আরম্ভ করিল- একদিন আমি দার্জিলিঙে লাটসাহেবের বাড়ির কাছেই ঐ রাস্তাটায় বেড়াচ্ছি, এমন সময় দেখি রামলালবাবু হাসতে হাসতে আমার দিকে আসছেন, তাঁর সঙ্গে আবার একটা সাহেব । রামলালবাবু বলিলেন, “দুলিরাম ! তোমার সেই ইংরাজি কবিতাটা একবার এঁকে শোনাতে হচ্ছে । আমি এর কাছে তোমার সুখ্যাতি করছিলাম, তাই ইনি সেটা শুনবার জন্য ভারি ব্যস্ত হয়েছেন !” উনি নিজে থেকে বলছেন, তখন আমি আর কি করি ? আমি সেই ‘ক্যাসাবিয়াংকা’ থেকে আবৃত্তি করলুম । তারপর দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল ! সবাই শুনতে চায়, সবাই বলে, ‘আবার কর ।’ মহা মুশকিলে পড়ে গেলাম, নেহাত রামলালবাবু বললেন, তাই আবার করতে হল ।