ইনস্পেকটারের গল্প শেষ হতেই বৃন্দাবনবাবু টিকি দুলিয়ে বললেন, “আপনাদের গল্প শুনে আমারও একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সেও ঐরকম ‘উদোর-বোঝা-বুদোর-ঘাড়ে’ গোছের গল্প। তবে ভুলটা আমি নিজে করিনি, করেছিল আমার ভাইপো— সেই যে ছোকরাটি এখন মেডিকেল কলেজে পড়ে। একদিন সন্ধ্যার সময় ঘরের মধ্যে বসে আছি। ঘরেও বাতি জ্বালা হয়নি, বাইরেও বেশ অন্ধকার, খালি সরু নখের মতো একটুখানি চাঁদ সবেমাত্র পুবদিকে উঁকি দিয়েছে; এমন সময় মনে হল যেন একটা মানুষ দেয়াল বেয়ে বেয়ে ছাদের উপর উঠছে—”
বৃন্দাবনবাবু সবে এইটুকু বলেছেন, এমন সময় বারান্দায় কে ডাক দিল, “বাবু, টেলিগ্রাম।” রামবাবু তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে টেলিগ্রামখানা নিয়ে আসলেন, তারপর চোখের চশমাটি কপালে তুলে টেলিগ্রামখানা খুলে পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে তাঁর চোখ ক্রমেই গোল হয়ে উঠছে দেখে ডাক্তারবাবু জিগগেস করলেন, “কি ব্যাপারখানা কি?” রামবাবু ধপাস্ করে সোফার উপর বসে পড়ে বললেন, “এই দেখুন না, দেশ থেকে পরেশ টেলিগ্রাম করছে— সিরিয়াস এক্সিডেন্ট কাম্ হোম ইমেডিয়েটলি।” (অর্থাৎ গুরুতর দুর্ঘটনা, শীঘ্র বাড়ি আসুন)। রামবাবুর তিন ছেলে কয়দিন হল পুজোর ছুটিতে দেশে গিয়েছে, আর একটি মামাবাড়িতে আছে, আর বাকি তিনটে মায়ের কাছে বাড়িতেই রয়েছে। রামবাবু বললেন, “এত লোক থাকতে পরেশ ছোকরাটাকে দিয়েই বা টেলিগ্রাম করাতে গেল কেন? দুটো পয়সা খরচ করে বড়রা কেউ একটু ভালো করে গুছিয়ে টেলিগ্রাম করলেই পারত। এখন কি যে করি? আজ বিষ্যুৎবার, এ-সময়ে রওয়ানাই বা হই কেমন করে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।” তিনি চাকরকে ডেকে তিনতলার বড় ঘর থেকে তাঁর কলমটা আনতে বললেন, আর বললেন, “একটা টেলিগ্রাম করে দেখা যাক কি জবাব আসে।” এই ব’লে তিনি আবার টেলিগ্রামখানা পড়তে লাগলেন।
গল্পগুজব তো চুলোয় গেল, সবাই মিলে ভাবতে বসল এখন কি করা যায়। এমন সময় রামবাবু হঠাৎ বলে উঠেলেন, “ও কি! এ কার টেলিগ্রাম? এ তো দেখছি ‘রমাপদ সেন’ লেখা। আমার কি যে চোখ হয়েছে, আমি পড়ছি রমাপ্রসাদ সান্যাল।” বলতেই পোস্টমাস্টার প্রিয়শঙ্কর বলে উঠলেন, “ও! রমাপদ যে ও-পাড়ার গুপীবাবুর ভাই, আমি জানি তার শ্বশুরের নাম পরেশনাথ কি যেন।” তখন একটা হাসির ধুম পড়ে গেল।
রামবাবু বললেন, “দেখলেন মশাই, পিয়ন ব্যাটার কাণ্ড! এক ভুল টেলিগ্রাম দিয়ে আমার মেরেছিল আর কি! একে বুড়ো বয়েস, তাতে আবার জানেন তো আমার হার্টের ব্যারাম আছে।” হেডমাস্টার যতীশবাবু শুনে হেসে বললেন, “আপনি আবার এর মধ্যেই হলেন কি করে?” রামবাবু বললেন, “বিলক্ষণ! এ পাড়ায় আমার মতন বুড়ো আর ক’টি খুঁজে পান বলুন তো! এই আষাঢ় মাসে আমি ষাটের কোঠায় পা দিয়েছি।” বৃন্দাবনবাবু বললেন, ” তাহলে আমার জ্যেঠামশায়ের কাছে আপনার হার মানতে হল। তাঁর বয়েস উনসত্তর।” ডাক্তারবাবু বললেন, “আমারও বড় কম হয়নি, চৌষট্টি পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এ-পাড়ায় বয়েসের জন্য যদি প্রাইজ দিতে হয়, তাহলে ভোলানাথের বাপকেই দেওয়া উচিৎ; তার নাকি এখ আটাত্তর বছর চলেছে।” এই রকম বাজে কথা চলছে, এমন সময়ে বড় বড় বারকোশের উপর থালা সাজিয়ে রামবাবুর তিনটে চাকর খাবার নিয়ে হাজির। কচুরি, নিমকি, সন্দেশ থেকে পিঠে পায়েস পর্যন্ত প্রায় বারো-চোদ্দ রকমের খাবার। ডাক্তার বললেন, “বাপরে! এ যে বিরাট আয়োজন। ব্যাপারখানা কি?” রামবাবু বললেন, “ঐ যা! আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি। আজ আমার জামাই এসেছেন, তাই বাড়িতে একটু মিষ্টি মুখের আয়োজন করা হয়েছে।” ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, “এত বড় গুরুতর কথাটাই বলতে ভুলে গেলেন? আপনার বয়েসটা নিতান্তই বেড়ে গেছে দেখছি।” বৃন্দাবনবাবু বললেন, “তা হোক, আজকের বৈঠকে অনেক রকমই ভুলের কাণ্ড শুনলাম আর দেখলাম, কিন্তু এ ভুলটি বেশিদূর গড়ায়নি। আসুন, এখন ভুলটা সংশোধন করে নেওয়া যাক।”
ভুলের তালিকা
- গোড়াতেই রামবাবুকে কৃপণ বলা হইয়াছে, কিন্তু গল্পে তাঁহার স্বভাবের যে পরিচয় দেওয়া হইয়াছে তাহা মোটেই কৃপণের মতো নয়।
- বলা হইয়াছে রামবাবু ও বৃন্দাবনবাবুর মধ্যে বহুকালের বন্ধুতা অথচ পরেই বলা হইয়াছে কারো সঙ্গেই বৃন্দাবনবাবুর আলাপ পরিচয় নাই।
- প্রথমেই বৃন্দাবনবাবুর মাথা-ভরা টাক বলা হইয়াছে, অথচ তিনি টিকি দুলাইতেছেন।
- প্রথমে বলা হইয়াছে তাঁহার বয়স ৬০, কিন্তু তিনি চাকরি করিয়াছেন ৫৬ বৎসর।
- বলা হইয়াছে যে গিন্নী আর জ্যেঠামহাশয় ছাড়া তাঁহার আর কেহ নাই, কিন্তু পরে তাঁহার এক ভাইপোকে হাজির করা হইয়াছে।
- প্রথমে পোস্টমাস্টারের নাম বলা হইয়াছে প্রাণশঙ্কর, পরে লেখা হইয়াছে প্রিয়শঙ্কর।
- রামবাবু ইংরাজী জানেন না, অথচ তিনি চট্পট্ ইংরাজী টেলিগ্রাম পড়িতেছেন।
- রামবাবু পাটের তেলের ব্যবসা করেন কিন্তু এরকম কোনো তেল বা ব্যবসার কথা শোনা যায় না।
- তাঁহার বাড়ি দোতলা বলা হইয়াছে কিন্তু চাকরকে তিনতলায় পাঠানো হয়েছে।
- রামবাবুর আটটি ছেলে কিন্তু মাত্র সাতটির খবর পাওয়া যাইতেছে।
- রামবাবুর মেয়ে নাই কিন্তু তাঁহার জামাই আসিয়া হাজির।
- তাঁহার চশমার যে বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে সেরূপ চশমা কপালে তোলা যায় না।
- প্রথমে বলা হইয়াছে ঘরে কোনোরকম আসবাবপত্র নাই কিন্তু পরে সোফার উল্লেখ করা হইয়াছে।
- বলা হইয়াছে, ‘বড়দিনের ছুটির মধ্যে এক রবিবার’ বৃন্দাবন রামবাবুর সঙ্গে দেখা করিলেন; গল্পের ঘটনা তাহার ‘সাত দিনের পরে’ সুতরাং বৃহস্পতিবার হইতেই পারে না।
- বড়দিনের সপ্তাহখানেকের মধ্যেই পূজার ছুটি অসম্ভব।
- বৃন্দাবনবাবুর বয়েস গোড়াতেই ৬০ বলা হইয়াছে। তাহা হইলে তাঁর জ্যেঠামহাশয়ের বয়েস মোটে ৬৯ হইতেই পারে না।
- চাঁদকে যখন আমরা সূর্যের কাছাকাছি দেখি তখনই তাহার চেহারা থাকে ‘সরু নখের মতো।’ সন্ধ্যার সময় পুবদিকে, অর্থাৎ সূর্যের উল্টা দিকে তাহার ওরকম চেহারা অসম্ভব।
ভোলানাথের সর্দারি
সকল বিষয়েই সর্দারি করিতে যাওয়া ভোলানাথের ভারি একটা বদ অভ্যাস। যেখানে তাহার কিছু বলিবার দরকার নাই, সেখানে সে বিজ্ঞের মতো উপদেশ দিতে যায়, যে কাজের সে কিছুমাত্র বোঝে না, সে কাজেও সে চট্পট্ হাত লাগাইতে ছাড়ে না। এইজন্য গুরুজনেরা তাহাকে বলেন ‘জ্যাঠা’- আর সমবয়সীরা বলে ‘ফড়ফড়ি রাম’ ! কিন্তু তাহাতে তাহার কোনো দুঃখ নাই, বিশেষ লজ্জাও নাই। সেদিন তাহার তিন ক্লাশ উপরের বড় বড় ছেলেরা যখন নিজেদের পড়াশুনা লইয়া আলোচনা করিতেছিল, তখন ভোলানাথ মুরুব্বির মতো গম্ভীর হইয়া বলিল, “ওয়েব্স্টারের ডিক্সনারি সব চাইতে ভালো। আমার বড়দা যে দু’ভলুম ওয়েব্স্টারের ডিক্সনারি কিনেছেন্, তার এক-একখানা বই এত্তোখানি বড় আর এম্নি মোটা আর লাল চামড়া দিয়ে বাঁধানো”। উঁচু ক্লাশের একজন ছাত্র আচ্ছা করিয়া তাহার কান মলিয়া বলিল, “কি রকম লাল হে? তোমার এই কানের মতো?” তবু ভোলানাথ এমন বেহায়া, সে তার পরদিনই সেই তাহাদের কাছে ফুটবল সম্বন্ধে কি যেন মতামত দিতে গিয়া এক চড় খাইয়া আসিল।
বিশুদের একটা ইঁদুর ধরিবার কল ছিল। ভোলানাথ হঠাৎ একদিন্ , “এটা কিসের কল ভাই?” বলিয়া সেটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া কলকব্জা এমন বিগড়াইয়া দিল যে, কলটা একেবারেই নষ্ট হইয়া গেল। বিশু বলিল, “না, জেনে শুনে কেন টানাটানি করতে গেলি?” ভোলানাথ কিছুমাত্র অপ্রস্তুত না হইয়া বলিল, “আমার দোষ হল বুঝি? দেখ্ তো হাতলটা কিরকম বিচ্ছিরি বানিয়েছে। ওটা আরও অনেক মজবুত করা উচিত ছিল। কলওয়ালা ভয়ানক ঠকিয়েছে।”
ভোলানাথ পড়াশুনায় যে খুব ভালো ছিল তাহা নয়, কিন্তু মাস্টার মহাশয় যখন কঠিন কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেন, তখন সে জানুক আর না জানুক সাত তাড়াতাড়ি সকলের আগে জবাব দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিত। জবাবটা অনেক সময়েই বোকার মত হইত, শুনিয়া মাস্টার মহাশয় ঠাট্টা করিতেন, ছেলেরা হাসিত; কিন্তু ভোলানাথের উৎসাহ তাহাতে কমিত না।
সেই যেবার ইস্কুলে বই চুরির হাঙ্গামা হয়, সেবারও সে এইরকম সর্দারি করিতে গিয়া খুব জব্দ হয়। হেডমাস্টার মহাশয় ক্রমাগত বই চুরির নালিশে বিরক্ত হইয়া, একদিন প্রত্যেক ক্লাশে গিয়া জিগ্গেস করিলেন, “কে বই চুরি করছে তোমরা কেউ কিছু জানো?” ভোলানাথের ক্লাশে এই প্রশ্ন করিবামাত্র ভোলানাথ তড়াক করিয়া লাফাইয়া উঠিয়া বলিল, “আজ্ঞে, আমার বোধ হয় হরিদাস চুরি করে।” জবাব শুনিয়া আমরা সবাই অবাক হইয়া গেলাম। হেডমাস্টার মহাশয় বলিলেন, “কি করে জানলে যে হরিদাস চুরি করে?” ভোলানাথ অম্লানবদনে বলিল, “তা জানিনে, কিন্তু আমার মনে হয়।” মাষ্টার মহাশয় ধমক দিয়া বলিলেন, “জানো না, তবে অমন কথা বললে কেন? ও রকম মনে করবার তোমার কি কারণ আছে?” ভোলানাথ আবার বলিল, “আমার মনে হচ্ছিল, বোধহয় ও নেয়— তাই তো বললাম। আর তো কিছু আমি বলিনি।” মাষ্টার মহাশয় গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “যাও হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাও।” তখনই তাহার কান ধরিয়া হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাওয়ানো হইল। কিন্তু তবু কি তাহার চেতনা হয়?
ভোলানাথ সাঁতার জানে না, কিন্তু তবু সে বাহাদুরি করিয়া হরিশের ভাইকে সাঁতার শিখাইতে গেল। রামবাবু হঠাৎ ঘাটে আসিয়া পড়েন, তাই রক্ষা। তা না হইলে দুজনকেই সেদিন ঘোষপুকুরে ডুবিয়া মরিতে হইত। কলিকাতায় মামার নিষেধ না শুনিয়া চল্তি ট্রাম হইতে নামিতে গিয়া ভোলানাথ কাদার উপর আছাড় খাইয়াছিল, তিন মাস পর্যন্ত তাহার আঁচড়ের দাগ তাহার নাকের উপর ছিল। আর বেদেরা শেয়াল ধরিবার জন্য যেবার ফাঁদ পাতিয়া রাখে, সেবার সেই ফাঁদ ঘাঁটিতে গিয়া ভোলানাথ কি রকম আটকা পড়িয়াছিল, সেকথা ভাবলে আজও আমাদের হাসি পায়। কিন্তু সব চাইতে যেবার সে জব্দ হইয়াছিল সেবারের কথা বলি শোনো।
আমাদের ইস্কুলে আসিতে হইলে কলেজবাড়ির পাশ দিয়া আসিতে হয়। সেখানে একটা ঘর আছে, তাহাকে বলে ল্যাবরেটরি। সেই ঘরে নানারকম অদ্ভুত কলকারখানা থকিত। ভোলানাথের সবটাতেই বাড়াবাড়ি, সে একদিন একেবারে কলেজের ভিতর গিয়া দেখিল, একটা কলের চাকা ঘুরনো হইতেছে, আর কলের একদিকে চড়াক্ চড়াক্ করিয়া বিদ্যুতের মতো ঝিলিক্ জ্বলিতেছে। দেখিয়া ভোলানাথের ভারি শখ হইল সে একবার কল ঘুরাইয়া দেখে ! কিন্তু কলের কাছে যাওয়া মাত্র, কে একজন তাহাকে এমন ধমক দিয়া উঠিল যে, ভয়ে এক দৌড়ে সে ইস্কুলে আসিয়া হাঁপাইতে লাগিল। কিন্তু কলটা একবার নাড়িয়া দেখিবার ইচ্ছা তাহার কিছুতেই গেল না। একদিন বিকালে যখন সকলে বাড়ি যাইতেছি তখন ভোলানাথ যে কোন সময়ে কলেজবাড়িতে ঢুকিল, তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই। সে চুপিচুপি কলেজবাড়ির ল্যাবরেটরি বা যন্ত্রখানায় ঢুকিয়া, অনেকক্ষন এদিক ওদিক চাহিয়া দেখে, ঘরে কেউ নাই। তখনই ভরসা করিয়া ভিতরে ঢুকিয়া সে কলকব্জা দেখিতে লাগিল। সেই দিনের সেই কলটা আলমারির আড়ালে উঁচু তাকের উপর তোলা রহিয়াছে, সেখানে তাহার হাত যায় না। অনেক কষ্টে সে টেবিলের পিছন হইতে একখানা বড় চৌকি লইয়া আসিল। এদিকে কখন যে কলেজের কর্মচারী চাবি দিয়া ঘরের তালা আঁটিয়া চলিয়া গেল, সেও ভোলানাথকে দেখে নাই, ভোলানাথেরও সেদিকে চোখ নাই। চৌকির উপর দাঁড়াইয়া ভোলানাথ দেখিল কলটার কাছে একটা অদ্ভুত বোতল। সেটা যে বিদ্যুতের বোতল, ভোলানাথ তাহা জানে না। সে বোতলটিকে ধরিয়া সরাইয়া রাখিতে গেল। অমনি বোতলের বিদ্যুত তাহার শরীরের ভিতর দিয়া ছুটিয়া গেল, মনে হইল যেন তাহার হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কিসের একটা ধাক্কা লাগিল, সে মাথা ঘুরিয়া চৌকি হইতে পড়িয়া গেল।
বিদ্যুতের ধাক্কা খাইয়া ভোলানাথ খানিকক্ষন হতভম্ব হইয়া রহিল। তারপর ব্যস্ত হইয়া পলাইতে গিয়া দেখে দরজা বন্ধ! অনেকক্ষন দরজায় ধাক্কা দিয়া, কিল ঘুষি লাথি মারিয়াও দরজা খুলিল না। জানালাগুলি অনেক উঁচুতে আর বাহির হইতে বন্ধ করা- চৌকিতে উঠিয়াও নাগাল পাওয়া গেল না। তাহার কপালে দরদর করিয়া ঘাম ঝরিতে লাগিল। সে ভাবিল প্রাণপণে চীৎকার করা যাক্, যদি কেউ শুনিতে পায়। কিন্তু তাহার গলার স্বর এমন বিকৃত শোনাইল, আর মস্ত ঘরটাতে এমন অদ্ভুত প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল যে, নিজের আওয়াজে নিজেই সে ভয় পাইয়া গেল। ওদিকে প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে। কলেজের বট গাছটির উপর হইতে একটা পেঁচা হঠাৎ ‘ভুত-ভুতুম-ভুত’ বলিয়া বিকট শব্দে ডাকিয়া উঠিল। সেই শব্দে একেবারে দাঁতে দাঁতে লাগিয়া ভোলানাথ এক চীৎকারেই অজ্ঞান!
কলেজের দারোয়ান তখন আমাদের ইস্কুলের পাঁড়েজি আর দু-চারটি দেশ-ভাইয়ের সঙ্গে জুটিয়া মহা উৎসাহে ‘হাঁ হাঁ করে কাঁহা গয়ো রাম’ বলিয়া ঢোল কর্তাল পিটাইতেছিল, তাহারা কোনোরূপ চীৎকার শুনিতে পায় নাই। রাতদুপুর পর্যন্ত তাহাদের কীর্তনের হল্লা চলিল; সুতরাং জ্ঞান হইবার পর ভোলানাথ যখন দরজায় দুম্দুম্ লাথি মারিয়া চেঁচাইতেছিল, তখন সে শব্দ গানের ফাঁকে ফাঁকে তাহাদের কানে একটু-আধটু আসিলেও তাহারা গ্রাহ্য করে নাই। পাঁড়েজি একবার খালি বলিয়াছিল, কিসের শব্দ একবার খোঁজ লওয়া যাক, তখন অন্যেরা বাধা দিয়া বলিয়াছিল, “আরে চিল্ল্যানে দেও।” এমনি করিয়া রাত বারোটার সময় যখন তাহাদের উৎসাহ ঝিমাইয়া আসিল, তখন ভোলানাথের বাড়ির লোকেরা লণ্ঠন হাতে হাজির হইল। তাহারা বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া কোথাও তাহাকে আর খুঁজিতে বাকি রাখে নাই। দারোয়ানদের জিজ্ঞাসা করায় তাহার একবাক্যে বলিল, ‘ইস্কুল বাবুদের’ কোথাও তাহারা দেখে নাই। এমন সময় সেই দুম্দুম্ শব্দ আর চীৎকার আবার শোনা গেল।
তারপর ভোলানাথের সন্ধান পাইতে আর বেশি দেরি হইল না। কিন্তু তখনও উদ্ধার নাই- দরজা বন্ধ, চাবি গোপালবাবুর কাছে, গোপালবাবু বাসায় নাই, ভাইজির বিবাহে গিয়াছেন, সোমবার আসিবেন। তখন অগত্যা মই আনাইয়া, জানালা খুলিয়া, সার্সির কাঁচ ভাঙিয়া, অনেক হাঙ্গামার পর ভয়ে মৃতপ্রায় ভোলানাথকে বাহির করা হইল। সে ওখানে কি করিতেছিল, কেন আসিয়াছিল, কেমন করিয়া আটকা পড়িল ইত্যাদি করিবার জন্য তাহার বাবা প্রকাণ্ড এক চড় তুলিতেছিলেন, কিন্তু ভোলানাথের ফ্যাকাশে মুখখানা দেখিবার পর সে চড় আর তাহার গালে নামে নাই।
নানাজনে জেরা করিয়া তাহার কাছে যে সমস্ত কথা আদায় করিয়াছেন, তাহা শুনিয়াই আমরা আটকা পড়িবার বর্ণনাটা দিলাম। কিন্তু আমাদের কাছে এত কথা কবুল করে নাই। আমাদের কাছে সে আরও উল্টা বুঝাইতে চাহিয়াছিল যে, সে ইচ্ছা করিয়াই বাহাদুরির জন্য কলেজবাড়িতে রাত কাটাইবার চেষ্টায় ছিল। যখন সে দেখিল যে, তাহার কথা কেহ বিশ্বাস করে না, বরং আসল কাথাটা ক্রমে ফাঁস হইয়া পড়িতেছে, তখন সে এমন মুষড়াইয়া গেল যে, অন্তত মাস তিনেকের জন্য তাহার সর্দারির অভ্যাসটা বেশ একটু দমিয়া পড়িয়াছিল।
যতীনের জুতো
যতিনের বাবা তাকে এক জোড়া জুতো কিনে দিয়ে আচ্ছা করে শাসিঁয়ে কইলেন, “এইবারে যদি জুতো ছেঁড়ো, তাহলে ছেঁড়া জুতোই পড়ে থাকতে হবে।”
প্রতি মাসে যতিনের নতুন জুতোর দরকার হয়। তার জামা কিছুদিন যেতে না যেতেই ছিঁড়ে যায়। সে সব কিছুতেই উদাসীন। তার সব বই এর মলাট ছেঁড়া, কোনাগুলো মোড়ানো, স্লেটের আদ্যপান্ত চীড় ধরা। তার হাত থেকে চক পেন্সিল পড়ে পড়ে সেগুলো আর আস্ত নেই একটিও। তার আর একটি বদ অভ্যেস হল, পেন্সিলের গোড়া কামড়ানো। এই কারণে পেন্সিলের গোড়া গুলো দেখতে বাদামের ছিবড়ে ছাড়ানো খোসার মত হয়ে গেছে। তার ক্লাসের পন্ডিত মশাই সেগুলো দেখে বলেন, “আজ বাড়িতে ভাত খাও নি বুঝি!”
নতুন জুতো নিয়ে কিছুদিন যতিন বেশ সাবধানে চলাফেরা করল; ধীরে ধীরে সিঁড়ি থেকে নামে, দরজার বেড়ী সাবধানে ডিঙ্গোয়, সদা সতর্ক থাকে যেন হোঁচট না খায়। কিন্তু অতটুকুই সার। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই পুরোনো যতিন। জুতোর মাহাত্য তার মনে থাকে না-সিঁড়ি দিয়ে তরতরিয়ে নামা আর পাথরে হোঁচট খাওয়া নিত্য ব্যাপার। এক মাসের মধ্যে তার জুতোর সামনের দিক ছিঁড়ে গেল। যতিনের মা বললেন, “মুচি ডেকে এইবারে জুতোটা সেলাই করিয়ে নে, নইলে আর পড়তে পারবি নে।” কিন্তু মুচি ডাকা যতিনের কর্মের মধ্যে পড়ে না। ফল স্বরূপ জুতোর ছেঁড়া আরো বারতেই থাকে।
যতিনের যে একদমই কোনো কিছুর প্রতি দরদ নেই তা না, যে জিনিসটা যতিনের চিন্তা চেতনায় আছে সেটি হল তার ঘুড়ি। অতি যত্ন সহকারে সে ফাটা ঘুড়ি জোড়া লাগায় এবং যতদিন সম্ভব সেটি ওড়ানোর চেষ্টা করে। খেলার সময়টা তার বেশিরভাগই ঘুড়ি উড়িয়ে কাটে। এই ঘুড়ির কারণে তার রান্না ঘর হতে তাড়া খেতে হয়। ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে রান্না ঘরের আসে পাশে ঘুরঘুর করে, আঠা নেওয়ার জন্য। ঘুড়ির ল্যাজ লাগাতে হলে কিংবা কাঁচির দরকার হলে তার মায়ের সেলাই বাক্সের ওপর হামলা চলে। একবার ঘুড়ি ওড়াতে বের হলে নাওয়া খাওয়া তার মাথায় ওঠে। সেইদিন যতিন ইস্কুল থেকে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি আসল। গাছে উঠতে গিয়ে নতুন জামাটা ছিঁড়ে ফেলেছে। বই খাতা রাখার পর সে পায়ে জুতো গলাতে গেছে-দেখে সেটি এমনি ছিঁড়ে গেছে যে সেলাইয়েরও অযোগ্য। কিন্তু সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ভাবনাটি তার মাথা থেকে বেমালুম হাওয়া! দু-তিন ধাপ সিঁড়ি একেবারে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে লাগল। শেষতক তার জুতো জোড়ার দশা এমনি হল যে দেখলে মনে হবে বেচারা কষ্টে সব কটা দাঁত বের করে আছে। শেষ তিন ধাপ যেই সে নামতে যাবে, মনে হল যেন তার পায়ের তলায় আর মাটি নেই, ছেঁড়া জুতো তাকে শূন্যে ভাসিয়ে অজানা দেশে নিয়ে চলেছে।
যখন তার জুতো জোড়া থামল, যতিন চেয়ে দেখে কোন এক অজানা দেশে এসে সে পৌঁছেছে। অনেক মুচি এখানে ওখানে বসে আছে। যতিনকে দেখেই ছুটে এল তারা, তার জুতো জোড়া খুলে সাবধানে ঝাড়তে শুরু করে দিল। তাদের মধ্যে যে নেতা গোছের ছিল, যতিনকে বলল, “শুনেছি তুমি নাকি ভারি দুষ্টু? দেখ, কি করেছ জুতো জোড়ার হাল! দেখ, জুতো জোড়া তো মরমর আবস্থায় আছে!” ততক্ষণে যতিন একটু ধাতস্ত হয়েছে, বললে, “জুতোর কি প্রাণ আছে নাকি যে মরবে?” মুচি জবাব দিলে, “নয় ত কি? কি ভেবেছ হে বাপু? যখন দৌড়ে বেরাও তখন ত মনে থাকে না যে জুতো কষ্ট পায়, কিন্তু কষ্ট পায় বটে। সে কারনেই চিৎকার করে কাঁদে। যখন পড়িমড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে বেরাও, তখন পায়ের চাপে জুতোর পাশ ক্ষয়ে যায়। ঠিক এই কারনেই জুতো তোমাকে আমাদের কাছে এনেছে। আমরা এখানকার সব ছেলেদের জিনিসপত্রের দেখাশোনা করি। যখন তারা তাদের জিনিসের ঠিক মত দেখাশোনা করে না, তখন তাদের উচিত শিক্ষা দেই।” মুচি তার জুতো ফেরত দিয়ে বললে, “ঝট্পট্ সেলাই করতে লেগে পড় তো।” যতিনের খুব রাগ হল-তীব্র স্বরে বললে, “আমি জুতো সারাই না, মুচিরা সারায়।” মুচি মুচকি মুচকি হেসে বলে, “এটা কি মামাবাড়ি পেয়েছ? ভেবেছ যে বলবে করব না-ওমনি পার পেয়ে যাবে? এই নাও সুঁই আর সুতো-সেলাই করতে লেগে পড়।”
যতিনের রাগ ভয়ে পরিনত হয়ে গেছে ততক্ষণে। ভয়ে ভয়ে বললে, “কি করে সেলাই করতে হয় জানি নে।” মুচি বললে, “দেখাচ্ছি, কি করে করতে হয়।” যতিন ভয়ে ভয়ে বসল জুতো সেলাই করতে। হাতে সুঁই ফুটল, জুতোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘার ব্যাথা হয়ে গেল-অনেক্ষণ চেষ্টা করে একপাটি জুতো মাত্র সারতে পেরেছে। তখন মুচির কাছে কেঁদে কেঁদে বল্ল, “আমি কালকে বাকিটা করব, খিদে পাচ্ছে খুব।” মুচি বলল, “কি বলছ বাপু! পুরো কাজ শেষ না করলে খেতেও পাবে না ঘুমুতেও পারবে না। ঐটে এখনও সেলাই করা বাকি আছে। ওটি শেষ করলে শিখতে হবে কিভাবে হাঁটতে হবে যাতে পরে জুতোর কষ্ট না হয়। তারপর দর্জির কাছে যেতে হবে-জামা সেলাই করতে। তারপর আমরা দেখব আর কি কি ভেঙ্গেছ।”
যতিনের চোখ বেয়ে জল গড়াতে লাগল। কোনো মতে দ্বিতীয় পাটি জুতো সারাল। ভগবানের অসীম দয়া, এটা এতটা বাজে ভাবে ছেঁড়েনি। তারপর মুচি তাকে এক পাঁচতলা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেটাতে আবার সিঁড়ি মাটি থেকে সোজা ছাত পর্যন্ত। যতিনকে নিচে দাঁড় করিয়ে বললে, “একেবারে উপরে উঠে আবার নিচে নেমে এস ত দেখি। আর শোনো, একবারে একটা সিঁড়ির বেশি ভাংবে না।” যতিন কথা মতই সিঁড়ি ভাংল। মুচি বলল, “হল না, তিন বার দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গেছ, পাঁচ বার লাফিয়েছ, আর দু বার তিনটে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়েছ।” এতটা সিঁড়ি ভেঙ্গে যতিনের পা ব্যাথা করছিল। সে আর কোনো ছলচাতুরি করল না। ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠল আর নামল। মুচি বল্ল, “এবার ঠিক হয়েছে, নাও এবার দর্জির কাছে চল।”
তারা একটা বিশাল মাঠের কাছে এল, সেখানে শুধু দর্জি আর দর্জি-বসে বসে সেলাই করে যাচ্ছে। তারা যখন যতিনকে দেখল বল্ল, “কি ছিড়েছ?” তার ধুতির দিকে তাকিয়ে কইল “ইকি! ভালো জায়গাটাই ছিঁড়েছ!” বিরক্তি ভরে মাথা নাড়িয়ে বল্ল, “ভারী অন্যায়, ভারী অন্যায়! চট্পট্ সেলাই কর এখন।” যতিনের না করার কোনো সাহস আর ছিল না। সে সুঁই সুতো নিয়ে সেলাই করতে বসে গেল। মাত্র দু ফোঁড় দিয়েছে-ওমনি দর্জি চেঁচিয়ে উঠল, “ইকি! একে তুমি সেলাই বল? আবার কর-আবার শুরু থেকে কর।” শেষতক যতিন আর পারল না-কেঁদেই ফেল্ল, “আমার খিদে পেয়ছে, আমি বাড়ি যাব। আমি আর কক্ষণ জামা ছিঁড়ব না, আর কক্ষণ ছাতা ভাংব না।” তার কথা শুনে সবাই হাঃ হাঃ করে হাসতে লাগল, “খিদে পেয়েছে? আমাদের কাছে অনেক আছে খাওয়ার মত” বলে তারা যে পেন্সিল দিয়ে কাপড়ে দাগ কাটে সে সব কিছু এনে দিল। “পেন্সিল চিবোতে পছন্দ কর না! এই নাও এগুলো চেবাও বসে বসে। এছাড়া আর কিছু পাবে না।”
যতিন কে ওভাবে ছেড়েই তারা যে যার মত কাজে লেগে গেল। খিদে-তেষ্টায় মাঠে শুয়ে শুয়ে যতিন কাঁদতে লাগল। ঠিক সে সময়ে আকাশে কিছু একটা ফর্ফর্ করে উঠল-যে ঘুড়িটা যতিন যত্ন করে সাড়িয়েছিল, সেটি এসে তার কোলের কাছে পড়ল। ফিস্ ফিসিয়ে বল্ল, “তুমি আমার খুব যত্ন করেছ, সে কারনেই আমি তোমার সাহায্য করতে এসেছি। আমার লেজ ধর-শিগগিরি।” আর কথা না বাড়িয়ে যতিন ঘুড়ির লেজ ধরল। হুস্ করে ঘুড়ি তাকে আকাশে উঠিয়ে নিল। শব্দ শুনে দর্জিরা ছুটে এল, ঘুড়ির সুতো কাটার জন্য। আচমকা, যতিন ও তার ঘুড়ি গোঁত্তা খেয়ে আকাশ থেকে নামতে লাগল।