রামবাবু লোকটি যেমন কৃপণ, তাঁর প্রতিবেশী বৃন্দাবনচন্দ্রের আবার তেমনি হাত খোলা। দুজনের বহুকালের বন্ধুতা, অথচ কি চেহারায়, কি স্বভাব-প্রকৃতিতে কোথাও দুজনের মিল নেই। বৃন্দাবন বেঁটেখাটো গোলগাল গোছের মানুষ, তাঁর মাথা ভরা টাক, গোঁফ-দাড়ি সব কামানো। ছাপ্পান্ন বছর অতি প্রশংসার সঙ্গে রেজেস্ট্রি অফিসে চাকরি করে শেষদিকে তাঁর খুব পদোন্নতি হয়েছিল; এখন ষাট বছর বয়সে তিনি সবে মাত্র পেন্সন নিয়ে বিশ্রাম করছেন। তিনি, তার গিন্নি, আর এক বুড়ো জ্যেঠামশাই, এ-ছাড়া ত্রিসংসারে তাঁর আর কেউ নেই। জ্যেঠামশাই বিয়েটিয়ে করেননি, বৃন্দাবনের সঙ্গেই থাকেন। রামপ্রসাদ সান্যাল লোকটি ছিপছিপে লম্বা; পোস্টমাস্টার প্রাণশঙ্কর ঘোষ ছাড়া তেমন ঢ্যাঙা লোক সে পাড়াতে আরে খুঁজে পাবে না। এক অক্ষর ইংরাজি জানেন না, কিন্তু মার্বেল পাথর আর পাটের তেলের ব্যবসা করে তিনি প্রকাণ্ড দোতলা বাড়ি করেছেন, দেশে জমিদারী কিনেছেন আর নানারকম কারখানার অংশীদার হয়ে বসেছেন। তাঁর আটটি ছেলে, কিন্তু মেয়ে একটিও হল না বলে তাঁর ভারি দুঃখ। প্রকাণ্ড কপাল, তার উপর একরাশ চুল, মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি আর চোখে হাল-ফ্যাশানের ফ্রেম-ছাড়া চশমা, কানের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই, কেবল নাকের উপর স্প্রিং দিয়ে এঁটে বসানো। মোট কথা, দেখলেই বোঝা যায় যে মানুষটি কম কেউকেটা নন।
প্রতিদিন সন্ধ্যা হতেই পাড়ার মাতব্বর বাবুরা সবাই রামবাবুর বৈঠকখানা ঘরে এসে জোটেন, আর পান-তামাক-চা-বিস্কুট-সন্দেশ ইত্যাদির সঙ্গে খুব হাসি-তামাশা গল্প-গুজব চলতে থাকে। বৈঠকখানা ঘরটি বেশ বড়, মেঝের উপর প্রকাণ্ড ফরাশ পাতা, তার উপর কতকগুলো মোটাসোটা তাকিয়া আর রঙচঙে হাত-পাখা এদিক ওদিক ছড়ানো। তাছাড়া ঘরের মধ্যে কোথাও চেয়ার-টেবিল বা কোনোরকম আসবাবপত্র একেবারেই নেই। পোস্টমাস্টার বাবু, হরিহর ডাক্তার, যতীশ রায়, হেডমাস্টার, ইনস্পেকটার বাড়ুয্যে প্রভৃতি অনেকেই সেখানে প্রায় প্রতিদিন আসেন। বৃন্দাবন বসু বড়ো লাজুক লোক, প্রথম প্রথম সেদিকে বড় একটা ঘেঁষতেন না। সে-পাড়ায় তিনি সবে নতূন এসেছেন, কারও সঙ্গে আলাপ পরিচয় নেই, খালি পোস্টমাস্টারবাবুর সঙ্গে একটু জানাশোনা। যা হোক, পোস্টমাস্টারবাবু নাছোড়বান্দা লোক, তিনি বড়দিনের ছুটির মধ্যে এক রবিবার একরকম জোর করেই তাঁকে রামবাবুর বাড়ি নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন। প্রথমদিনের পরিচয়েই দুজনার আলাপ এমন জমে উঠল যে তারপর থেকে রামবাবুর বৈঠকে যাবার জন্য বৃন্দাবনচন্দ্রকে আর কোনো তাগিদ দেওয়ার দরকার হত না।
এই ঘটনার সাতদিন পরে একদিন রামবাবুর বৈঠক খুব জমেছে। মানুষকে চিনতে না পারার দরুন কত সময়ে কত অদ্ভুত ভুল হয়, তাই নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। হরিহরবাবু বললেন, “আমি একবার যা ফ্যাসাদে পরেছিলাম, সে বোধহয় আপনাদের বলিনি। সে প্রায় বিশ বছরের কথা। একদিন সন্ধ্যার সময় খাওয়া দাওয়া সেরে একটু শিগ্গির শিগ্গির ঘুমব ভাবছি, এমন সময়ে আমার ডিসপেনসারির চাকরটা এসে খবর দিল, প্রমথবাবু এসেছেন। প্রমথ মিত্তির তখন তার মাথার ব্যারামের জন্য আমাকে দিয়ে চিকিৎসা করাত। সেদিন কথা ছিল, আমি তার জন্য একটা মিকস্চার তৈরি করিয়ে রাখব, সে সন্ধ্যার সময় সেটা নিয়ে যাবে। তাই চাকর এসে খবর দিতেই আমি ওষুধের শিশিটা তার হাতে দিয়ে সেই সঙ্গে একটা কাগজে লিখে দিলাম, ‘ওষুধটা এখুনি এক দাগ খাবেন। দুর্বল মস্তিষ্কের পক্ষে কোনোরকম মানসিক পরিশ্রম বা উত্তেজনা ভালো নয়, এ-কথা সর্বদা মনে রাখবেন। তাহলেই আপনার মাথার ব্যারাম শিগ্গির সারবে।’ মিনিট খানেক যেতে না যেতেই চাকরটা ঘুরে এসে খবর দিল যে বাবুটি বেজায় খাপ্পা হয়েছেন এবং দাওয়াইয়ের শিশিটি ভেঙে আমায় গাল দিতে দিতে প্রস্থান করেছেন। শুনে তো আমার চক্ষুস্থির! যা হোক, ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে বেশি দেরি হল না। একটু সন্ধান করতেই বোঝা গেল যে, লোকটি মোটেই প্রমথ মিত্তির নন, আমারই মামাশ্বশুর, বাঁশবেড়ের প্রমথ নন্দী। যেরকম বদমেজাজী লোক, সে রাত্রেই আমায় ছুটতে হল বুড়োর তোয়াজ করবার জন্য। বুড়ো কি সহজে ঠাণ্ডা হয়! তাঁকে অপমান করা, বা তাঁর সঙ্গে ইয়ার্কি করা যে আমার মোটেই অভিপ্রায় ছিল না এবং ওষুধটা কিম্বা চিঠিটা যে তাঁর জন্য দেওয়া হয়নি, এই সহজ কথাটি তাঁর মাথায় ঢোকাতে প্রায় দুটি ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এদিকে বাসায় ফিরে শুনি প্রমথ মিত্তির এসে তার ওষুধ তৈরি না পেয়ে খুব বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। পরদিন সকালে আবার তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাণ্ডা করি।”
এই গল্পটা শুনে ইনস্পেকটারবাবু বললেন, “আপনার তো, মশাই, অল্পের উপর দিয়ে গেল, আমার ঐ রকম একটা ভুলের দরুন চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়েছিল। সেও বহু দিনের কথা, তখন আমি সবেমাত্র পুলিসের চাকরি নিয়েছি। ঘোষপুরের বাজার নিয়ে সে সময়ে সুদাস মণ্ডলের সঙ্গে রায়বাবুদের খুব ঝগড়া চলছে। একদিন বিকেলে খবর পাওয়া গেল, আজ সন্ধ্যার পর সুদাস লাঠিয়াল নিয়ে বাজার দখল করতে আসবে। ইনস্পেকটার যোগীনবাবুর হুকুমে আমি ছয়জন কনস্টেবল নিয়ে সন্ধ্যার কাছাকাছি ঘোষপুরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না; সন্ধ্যার একটু পরেই দেখলাম নদীর দিক থেকে কিসের আলো আসছে। মনে হচ্ছে কারা যেন কাঁঠালতলায় বসে বিশ্রাম করছে। ব্যাপার কি দেখবার জন্য আমি খুব সাবধানে একটা ঝোপের আড়াল পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি একটা মশালের ঝাপসা আলোয় লাঠি হাতে কয়েকটা লোক বসে আছে, আর এক পালকির আড়ালে দুজন লোক কথাবার্তা বলছে। কান পেতে শুনলাম একজন বলল, ‘সুদাসদা, কতদূর এলাম?’ উত্তর হল, ‘এই তো ঘোষপুরের বাজার দেখা যাচ্ছে।’ অম্নি আর কথা নেই। আমি জোরে শিস্ দিতেই সঙ্গের পুলিশগুলো মার-মার করে তেড়ে এসেছে। পুলিশের সাড়া পাবামাত্র সুদাসের লোকগুলো ‘বাপরে মারে’ করে কে যে কোথায় সরে পড়ল তা আর ধরতেই পারা গেলা না। কিন্তু পালকির কাছে যে দুটো লোক ছিল, তারা খুব সহজেই ধরা পড়ে গেল। তাদের একজনের বয়েস অল্প, চেহারা গোঁয়ারগোবিন্দ গোছের— বুঝলাম এই সুদাস মণ্ডল। সে আমায় তেড়ে কি যেন বলতে উঠেছিল, আমি এক ধমক লাগিয়ে বললাম, ‘হাতে হাতে ধরা পড়েছ বাপু, এখন রোখ করে কোনো লাভ নেই, কিছু বলবার থাকে তো থানায় গিয়ে ব’লো।’ শুনে তার সঙ্গের বুড়ো লোকটা ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে খানিকক্ষণ অনর্গল কি যে বকে গেল আমি তার কিছুই বুঝলাম না, খালি বুঝলাম যে সে আমাদের তার ‘সুদাসদা’র পরিচয় বোঝাচ্ছে। আমি বললাম, ‘অত পরিচয় শুনবার আমার দরকার নেই, আসল পরিচয়টা আজ ভালোরকমই পেয়েছি।’ তারপর তাদের হাতকড়া পরিয়ে মহা ফুর্তিতে তো থানায় এনে হাজির করা গেল। তারপর মশাই যা কাণ্ড! হেড ইনস্পেকটার যতীনবাবু রাগে আগুনের মতো লাল হয়ে, টেবিল থাবড়িয়ে, দোয়াত উলটিয়ে, কাগজ কলম ছুঁড়ে আমায় খুব সহজেই বুঝিয়ে দিলেন যে আমি একটি আস্ত রকমের হস্তীমূর্খ ও অর্বাচীন পাঁঠা। যে লোকটিকে ধরে এনেছি সে মোটেই সুদাস মণ্ডল নয়, তার নাম সুবাসচন্দ্র বোস; সে যতীনবাবুরই জামাই, সঙ্গের লোকটি তার ঠাকুরদার আমলের চাকর; যতীনবাবুর কাছেই তারা আসছিল। আমার বুদ্ধিটা হাঁ-করা বোয়াল মাছের মতো না হলে, আমি সুবাস শুনতে কখনই সুদাস শুনতাম না— ইত্যাদি। অনেক কষ্টে অনেক খোশামুদি করে, অনেক হাতে পায়ে ধরে, সে যাত্রায় চাকরিটা বজায় রাখতে হয়েছিল।”