ক্রমে আমাদের মধ্যে তুমুল আলোচনা আরম্ভ হইল। কেহ বলিল, “ওটা ওর টিফিনের বাক্স- ওর মধ্যে খাবার আছে।” কিন্তু একদিনও টিফিনের সময় তাহাকে বাক্স খুলিয়া কিছু খাইতে দেখিলাম না। কেহ বলিল, “ওটা বোধ হয় ওর মানিব্যাগ- ওর মধ্যে টাকাপয়সা আছে, তাই ও সর্বদা কাছে কাছে রাখতে চায়।” আরেকজন বলিল, “টাকাপয়সার জন্য অত বড়ো বাক্স কেন? ও কি ইস্কুলে মহাজনী কারবার খুলবে নাকি?”
একদিন টিফিনের সময়ে দাশু হঠাত্ ব্যস্ত হইয়া বাক্সের চাবিটা আমার কাছে রাখিয়া গেল আর বলিল, “এটা এখন তোমার কাছে রাখ, দেখো হারায় না যেন। আর আমার আসতে যদি একটু দেরি হয়, তবে- তোমরা ক্লাশে যাবার আগে ওটা দরোয়ানের কাছে দিয়ে দিয়ো।” এই কথা বলিয়া সে বাক্সটা দরোয়ানের জিম্মায় রাখিয়া বাহির হইয়া গেল। তখন আমাদের উত্সাহ দেখে কে! এতদিনে সুবিধা পাওয়া গিয়াছে, এখন হতভাগা দরোয়ানটা একটু তফাত্ গেলেই হয়। খানিকবাদে দরোয়ান তাহার রুটি পাকাইবার লোহার উনানটি ধরাইয়া কতকগুলা বাসনপত্র লইয়া কলতলার দিকে গেল। আমরা এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। দরোয়ান আড়াল হওয়া মাত্র আমরা পাঁচ-সাতজনে তাহার ঘরের কাছে সেই বাক্সের উপর ঝুঁকিয়া পড়িলাম। তার পর আমি চাবি দিয়া বাক্স খুলিয়া দেখি, বাক্সের মধ্যে বেশ ভারী একটা কাগজের পোঁটলা নেকড়ার ফালি দিয়া খুব করিয়া জড়ানো। তার পর তাড়াতাড়ি পোঁটলার প্যাঁচ খুলিয়া দেখ গেল, তাহার মধ্যে একখানা কাগজের বাক্স- তার ভিতরে আরেকটি ছোট পোঁটলা। সেইটি খুলিয়া একখানা কার্ড বাহির হইল, তাহার একপিঠে লেখা ‘কাঁচকলা খাও’ আরেকটি পিঠে লেখা ‘অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়’। দেখিয়া আমরা এ-উহার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। সকলের শেষে একজন বলিয়া উঠিল, “ছোকরা আচ্ছা যাহোক, আমাদের বেজায় ঠকিয়েছে।” আরেকজন বলিল, “যেমনভাবে বাঁধা ছিল, তেমনি করে রেখে দাও, সে যেন টের না পায় যে আমরা খুলেছিলাম। তা হলে সে নিজেই জব্দ হবে।” আমি বলিলাম, “বেশ কথা, ও ছোকরা আসলে পরে তোমরা খুব ভালোমানুষের মতো বাক্সটা দেখাতে বোলো আর ওর মধ্যে কি আছে- সেটা বার করে জানতে চেয়ো।” তখন আমরা তাড়াতাড়ি কাগজপত্রগুলি বাঁধিয়া, আগেকার মতো পোঁটলা পাকাইয়া বাক্সে ভরিয়া ফেলিলাম।
বাক্সে চাবি দিতে যাইতেছি, এমন সময় হো হো করিয়া একটা হাসির শব্দ শুনা গেল- চাহিয়া দেখি পাঁচিলের উপর বসিয়া পাগলা দাশু হাসিয়া কুটিকুটি। হতভাগা এতক্ষণ চুপিচুপি তামাশা দেখিতেছিল। আর আমাদের কথাবার্তা সমস্ত শুনিতেছিল! তখন বুঝিলাম আমার কাছে চাবি দেওয়া, দরোয়ানের কাছে বাক্স রাখা, টিফিনের সময়ে বাইরে যাওয়ার ভান করা, এ-সমস্তই তাহার শয়তানি। আসল মতলবটি, আমাদের খানিকটা নাচাইয়া তামাশা দেখানো। খামখা আমাদের আহাম্মক বানাইবার জন্যই, সে মিছামিছি এ কয়দিন ধরিয়া ক্রমাগত একটা বাক্স, বহিয়া বেড়াইয়াছে।
সাধে কি বলি পাগলা দাশু?
(সন্দেশ-মাঘ, ১৩২৩ বঃ)
পাজি পিটার
শহরের কোণে মাঠের ধারে এক পুরানো বাড়িতে পিটার থাকত। তার আর কেউ ছিল না, খালি এক বোন ছিল। পিটারকে সবাই বলত ‘পাজি পিটার’ —কারণ পিটার কোন কাজকর্ম করে না—কেবল একে ওকে ঠকিয়ে খায়। পিটার একদিন ভাবল ঢের লোক ঠকিয়েছি—একবার রাজাকে ঠকানো যাক। এই ভেবে সে রাজবাড়িতে গেল।
রাজা বললেন, ‘তুমি কে হে? মতলবখানা কি?”
পিটার বলল, “আজ্ঞে, আমি পিটার— ঠকাবার জন্য লোক খুঁজছি।”
রাজা বললেন, “তাই নাকি? লোক খুঁজবার দরকার কি? আমাকের একবার ঠকিয়ে দেখাও না।” পিটার মাথা চুল্কাতে লাগল— বলল, “তাই ত’, আমার সরঞ্জাম সব বাড়িতে ফেলে এসেছি।” রাজা বললেন, “বেশ ত’, তোমার সরঞ্জাম সব নিয়ে এস।” পিটার তাই শুনে ভয়ানক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল, আর বলল, “দোহাই মহারাজ, অত হাঁটাহাঁটি করলে আমি মরেই যাব।” রাজা বললেন, “তবে এই ঘোড়াটায় চড়ে যা— দেরী করিস নে।” পিটার চিৎকার করতে লাগল, “ও ঘোড়ায় আমি চড়ব না— ঘোড়া আমায় ফেলে দেবে।” কিন্তু সে কথা কেউ শুনল না, তাকে জোর করে ঘোড়ায় চড়িয়ে দেওয়া হল। পিটার ঘোড়াটাকে আস্তে আস্তে মোড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে— যেই একটু আড়াল পেয়েছে, অমনি ঘোড়া ছুটিয়ে একেবারে শহরের বাইরে উপস্থিত। সেখানে সাজ-সরঞ্জামশুদ্ধ ঘোড়াটাকে বিক্রি করে, সে পকেটভরা টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরল। এদিকে রাজা উজীর পাত্রমিত্র সভায় বসে— পিটার আসে না, আসে না— এলই না— রাজা মশাই বাইরে খুব হাসলেন— বললেন, “ছেলেটা বেজায় চালাক”— কিন্তু মনে মনে ভারি চটলেন।
একদিন পিটার দেখতে পেল মাঠের উপর দিয়ে জমকালো পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে কে যেন আসছে। পিটার বলল, “এই মাটি করেছে! রাজা আসছে।” পিটার দৌড়ে তার বোনকে বলল— “ভাতের হাঁড়িটা উনুনে চড়িয়ে দাও— ফুট্তে থাকুক।” এই বলে সে একখানা ভাঙা শিলের উপর হিজিবিজি কি সব লিখতে বসল। তারপর যেই রাজা মশাই তার বাড়ির সামনে এসেছেন, অমনি সে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িটাকে সেই শিলের উপর বসিয়ে বিড়্ বিড়্ করে কি সব বলতে বলতে ভাতটাকে কাঠি দিয়ে নাড়তে লাগল। রাজা মশাই বললেন— “এ আবার কি?” পিটার বলল, “আজ্ঞে, ভাত রাঁধছি।” রাজা বললেন, “সে কি রে? তোর আগুন কৈ?” পিটার জোড়হাতে বলল, “মহারাজ, আমরা গরীব মানুষ আগুন-টাগুন কোথায় পাব? সন্ন্যাসী ঠাকুর এই পাথরখানা দিয়েছেন, আর দুটো মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন, তাতেই আমাদের রান্না চলে যায়।”
রাজা বললেন, “দে, ওটা আমায় দে— তোকে আমি মাপ করে দিচ্ছি।” পিটার কাঁদতে লাগল, দেখাদেখি তার দুষ্টু বোনটাও কাঁদতে লাগল। রাজা বললেন, “অত কান্নাকাটির দরকার কি? আমি ত’ কেড়ে নিচ্ছি না, দাম দিয়ে নিচ্ছি। এই নে!” বলে তিনি একমুঠো মোহর ফেলে দিলেন। তখন পিটার তাঁকে একটা যা-তা মন্ত্র শিখিয়ে দিল।
রাজা মশাই সেই শিলখানা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। গিয়ে সকলকে বলে পাঠালেন, “কাল সকালে তোমাদের এক আশ্চর্য ভোজ খাওয়াব।” সকাল না হতেই মন্ত্রী উজির কোটাল সকলে আশ্চর্য ভোজ খাবার জন্য রাজবাড়িতে হাজির। রাজা মশাই সেই পাথরটিকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে তার উপর প্রকাণ্ড এক হাঁড়ি চাপালেন, আর পোলাওয়ের চাল, ঘি, মাংস, মশ্লা আব তার মধ্যে দিয়ে গম্ভীরভাবে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল, পোলাও আর হল না। সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। রাজামশাই রেগে ঘেমে লালা হয়ে উঠলেন। শেষটায় তিনি লাফিয়ে উঠে কাউকে কিছু না বলে এক তলোয়ার হাতে আবার ঘোড়ায় চড়ে পিটারের বাড়ি ছুটলেন। মনে মনে বললেন, “এবারে আর পাজি পিটারকে আস্ত রাখছি নে।”
দূর থেকে রাজাকে দেখেই পিটার এক দৌড়ে শোবার ঘরে গিয়ে লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল। তার বোনকে সে আগে থেকেই সব শিখিয়ে রেখেছিল— সে করল কি একটা খরগোস কেটে তার রক্ত দিয়ে একটা থলি ভরে সেই থলিটা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখল।
রাজা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলেন, “পিটার কৈ? তাকে শিগ্গির ডাক।” পিটারের বোন বলল, “দোহাই মহারাজ, পিটার এখন ঘুমুচ্ছে— সে ভয়ানক রাগী লোক, এখন জাগাতে গেলে আমায় মারবে।” রাজা বললেন, “কিছু ভয় নেই— আমি আছি।”
পিটারের বোন পিটারকে ডাকতে গেল। খানিক বাদেই একটা চিৎকার গর্জনের মত শোনা গেল, রাজা দৌড়ে গিয়েই দেখেন পিটার একটা ছুরি নিয়ে তার বোনকে মারল আর সে বেচারা ঠিক যেন মড়ার মত পড়ে গেল— রক্তে তার কাপড় লাল হয়ে গেল। রাজা বললেন, “তবে রে পাজি পিটার, তোর বোনটাকে শুধু শুধু মেরে ফেললি?” পিটার বলল, “মহারাজ, এক মিনিট সবুর করুন।” এই বলে সে একটা ভাঙা শিঙের বাঁশী নিয়ে তার বোনের চোখে মুখে ফুঁ দিতে লাগল। এক মিনিটের মধ্যে মেয়েটা চোখ মেলে বড় বড় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে বসল। রাজা ত’ অবাক! তিনি বললেন, “এই শিঙেটা আমায় দিতে হবে।” পিটার কাঁদতে লাগল— বলল, “দোহাই মহারাজ, ওটা না হলে আমাদের চলবে কেমন করে?” দেখাদেখি বোনটাও কাঁদতে লাগল, “এবার আমি মারা গেলে কি করে বাঁচাবে? দোহাই মহারাজ, পিটারের মেজাজ বড় ভয়ানক।” রাজা বললেন, “আমার মেজাজ তার চাইতেও ভয়ানক— তোদের যে মেরে ফেলি নি এই ঢের— এই নে—” বলে একমুঠো মোহর ফেলে দিলেন।
রাজা বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবলেন, “এবার যার উপর রাগ করব— একেবারে তলোয়ারের কোপ বসিয়ে দেব।” বাড়ি ফিরে দেখেন— নিমন্ত্রিত লোকেরা তখনও আশ্চর্য ভোজ খাবার আশায় বসে আছেন! মন্ত্রী বললেন, “মহারাজ, আহারের অন্য বন্দোবস্ত করতে বলব কি?” রাজা বললেন, “কি? এতবড় কথা! আমি করছি একরকম বন্দোবস্ত, তুমি করবে অন্যরকম?” বলেই মন্ত্রীর মাথায় এক কোপ বসিয়ে দিলেন। উজীর নাজীর কোটাল সব হাঁ হাঁ করে উঠতেই রাজা ঘ্যাঁচ্ ঘ্যাঁচ্ করে তাদেরও মাথা কেটে দিলেন। চারিদিকে হুলুস্থূল পড়ে গেল। রাজা বললেন, “ভয় নেই, তোমরা এখন মজা দেখ।” বলে তিনি শিঙেটা মন্ত্রীর মুখের কাছে নিয়ে ফুঁ দিতে লাগলেন। কিনতি ফুঁ দিলে হবে কি— মড়া মানুষ কি আর বাঁচে?
তখন রাজার হুকুমে পেয়াদা পুলিশ দৌড়ে গিয়ে পিটারকে ধরে আনল। একটা মজবুত বাক্সের মধ্যে তাকে বন্ধ করে সেই বাক্স মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। রাজা বললেন, “পাজি পিটার— তোমার শাস্তি শোন— এই বাক্সে ভরে তিন দিন তিন রাত্রি তোমাকে ঐ পাহাড়ের উপর রাখা হবে। সেখানে রোদে পুড়ে হিমে ভিজে তুমি তোমার দুষ্টুমির কথা ভাববে— তারপর তোমাকে এই পাহাড় থেকে একেবারে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হবে।”
পিটার বলল, “আহা, মহারাজের দয়ার শরীর”—পাহাড়ের আগায় বাক্সের মধ্যে শুয়ে পিটার মনে মনে ভাবছে, ‘এখন উপায়?’ আর মুখে চিৎকার করে গান করছে—
“ধিন্ তাধিনা তাধেই ধেই— স্বর্গে যাবার রাস্তা এই”—
এমনি করে দুদিন গেল। তিনদিনের দিন এক বুড়ো বিদেশী সওদাগর সেখানে এল। সে বেচারা তীর্থ করতে বেরিয়েছে, পিটারের গান শুনে ব্যাপারটা কি দেখতে এল। সওদাগর বলল, “তুমি কে ভাই? স্বর্গের রাস্তার কথা বলছিলে?” পিটার বলল, “আরে চুপ— কাউকে ব’লো না, তাহলে স্বর্গে যাবার কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে— মাঝে থেকে আমার স্বর্গে যাওয়া মাটি হবে।” সওদাগর বলল, “ভাই, তুমি একা যাবে কেন? আমায়ও একটু পথ বাত্লে দাও না।” পিটার বলল, “সকলের কি রা সম্ভব হয়? এই বাক্সকে মন্ত্র পড়ে এখানে রাখা হয়েছে— যেমন তেমন বাক্স হলে হবে না; আজ রাত্রের শেষে স্বর্গের দূত এসে আমায় নিয়ে যাবে। আবার যে সে দিন হবে না— এমনি তিথি, এমনি বার, এমনি মাস, এমনি নক্ষত্র সব মেলা চাই— এরকম সুযোগ হাজার হাজার বছরে একদিন হয়।” সওদাগর বলল, “ভাই, আমি বুড়ো হয়েছি, কবে মরে যাই তার ত’ ঠিক নেই— আমার টাকাকড়ি ঘরবাড়ি সব তোমায় লিখে দিচ্ছি। তুমি আমায় ও বাক্সটা দাও— আমি স্বর্গে যাই।” পিটার বলল, “খবরদার, আমি ছেলেমানুষ বলে আমায় টাকার লোভ দেখিও না।” বুড়ো কাঁদতে লাগল; অনেক মিনতি করে বলতে লাগল, ‘এই বুড়ো বয়সে তীর্থ ঘুরে কতটুকু আর পূন্য হবে— এখন না হলে আর আমার স্বর্গে যাবার আশা নেই।” তখন পিটার রাজী হল।
বাক্স খুলে বুড়ো তার মধ্যে ঢুকল, পিটার তার কাছ থেকে সমস্ত বিষয়-সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে বাক্সটা আবার দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল। যাবার সময় বলে গেল, “রাত্রের শেষে স্বর্গের দূত আসবে, কিন্তু টুঁ শব্দটি করবে না। তা হলেই আর স্বর্গে যাওয়া হবে না।”
রাত্রে রাজামশাই শান্ত্রী নিয়ে বাক্সটা নেড়েচেড়ে সমুদ্রে ফেলে দিলেন। রাজা ভাবলেন, ‘আপদ গেল।’ দুদিন বাদে রাজা বেড়াতে বেরিয়েছেন— এমন সময় পাজি পিটার জমকালো পোশাক পরে ধব্ধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে এসে সেলাম করে বলল, “মহারাজ আমায় সমুদ্রে ফেলে বড়ই উপকার করেছেন। আহা! সমুদ্রের তলায় যে দেশ আছে— সে বড় চমৎকার জায়গা। আর লোকেরা যে কি ভাল, তা আর কি বলব— আমায় কি ছাড়তে চায়? আসবার সময় থেলে ভরে কেবল হীরে মনি মুক্তো সঙ্গে দিল।” এই বলেই সে চম্পট দিল।
রাজা মশাই হাঁ করে রইলেন। রাজামশাই জানতে চান সমুদ্রের তলাটার কথা। পাজি পিটার যা বলেছে তা সত্যি কিনা— তাহলে তিনি একবার দেখে আসেন।
পালোয়ান
তাহার আসল নামটি যে কি ছিল, তাহা ভুলিয়াই গিয়াছি— কারণ আমরা সকলেই তাহাকে “পালোয়ান” বলিয়া ডাকিতাম। এমনকি মাস্টারমহাশয়েরাও পর্যন্ত তাহাকে “পালোয়ান” বলিতেন। কবে কেমন করিয়া তাহার এরূপ নামকরণ হইল, তাহা মনে নাই; কিন্তু নামটি যে তাহাকে বেশ মানাইয়াছিল, একথা স্কুল সুদ্ধ সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিত।
প্রথমত, তাহার চেহারাটি ছিল একটু অতিরিক্ত রকমের হৃষ্টপুষ্ট। মোটা সোটা হাত পা, ব্যাঙের মত গোব্দা গলা— তাহার উপরেই গোলার মতো মাথাটি— যেন ঘাড়ে পিঠে এক হইয়া গিয়াছে। তার উপর সে কলিকাতায় গিয়া স্বচক্ষে কাল্লু ও করিমের লড়াই দেখিয়া আসিয়াছিল, এবং বড় বড় কুস্তির এমন আশ্চর্য রকম বর্ণনা দিতে পারিত যে, শুনিতে শুনিতে আমাদেরই রক্ত গরম হইয়া উঠিত। এক এক দিন উৎসাহের চোটে আমরাও তাল ঠুকিয়া স্কুলের উঠানে কুস্তি বাধাইয়া দিতাম। পালোয়ান তখন পাশে দাঁড়াইয়া নানারকম অঙ্গভঙ্গী করিয়া আমাদের প্যাঁচ ও কায়দা বাৎলাইয়া দিত। মাখনলাল আমার চাইতে আড়াই বছরের ছোট, কিন্তু পালোয়ানের কাছে “ল্যাং মূচ্কির” প্যাঁচ শিখিয়া সে যেদিন আমায় চিৎপাত করিয়া ফেলিল, সেইদিন হইতে সকলেরই বিশ্বাস হইল যে পালোয়ান ছোকরাটা কিছু না বুঝুক কুস্তিটা বেশ বঝে।
ঘোষেদের পাঠশালার ছাত্রগুলি বেজায় ডানপিটে। খামখা এক একদিন আমাদের সঙ্গে গায়ে পড়িয়া ঝগড়া বাধাইত। মনে আছে, একদিন ছুটির পরে আমি আর পাঁচ সাতটি ছেলের সঙ্গে গোঁসাইবাড়ির পাশ দিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময় দেখি পাঠশালার চারটা ছোকরা ঢেলা মারিয়া আম পাড়িতেছে। একটা ঢিল আরেকটু হইলেই আমার গায়ে পড়িত। আমরা দলে ভারি ছিলাম, সেই সাহসে আমাদের একজন ধমক দিয়া উঠিল, “এইও, বেয়াদব! মানুষ চোখে দেখিস্ নে?” ছোকরাদের এমনি আস্পর্ধা, একজন অমনি বলিয়া উঠিল, “হাঁ, মানুষ দেখি, বাঁদরও দেখি!”— শুনিয়া বাকী তিনটায় অসভ্যের মত হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল। আমার তখন ভয়ানক রাগ হইল, আমি আস্তিন গুটাইয়া বলিলাম, “পরেশ! দে ত আচ্ছা ক’রে ঘা দুচ্চার কষিয়ে।” পরেশও দমিবার পাত্র নয়, সে হুঙ্কার দিয়া বলিল, “গুপে, আনত ওই ছোক্রাটার কান ধ’রে।” গোপীকেষ্ট বলিল, “আমার হাতে বই আছে— ওরে ভুতো, তুই ধর্ দেখি একবার চেপে—”। ভুতোর বাড়ি বাঙাল দেশে— তার মেজাজটি যখন মাত্রায় চড়ে তখন তার কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান থাকে না— সে একটা ছোকরার কানে প্রকাণ্ড এক কীল বসাইয়া দিল। কীল খাইয়াই সে হতভাগা একেবারে ‘গোব্রাদা’ বলিয়া এমন এক্তা হৈ চৈ রব তুলিল যে, আমরা ব্যাপারটা কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া একেবারে হতভম্ব হইয়া রহিলাম। এমন সময় একটা কুচ্কুচে কালো মূর্তি হঠাৎ কোথা হইতে আসিয়া দেখা দিল। আসিয়াই আর কথাবার্তা না বলিয়াই ভুতোর ঘাড়ে ধাক্কা মারিয়া, গুপের কান মলিয়া, আমার গালে ঠাস্ঠাস্ দুই চড় লাগাইয়া দিল। তারপর কাহার কি হইল আমি খবর রাখিতে পারি নাই। মোট কথা, সেদিন আমাদের যতটা অপমান বোধ হইয়াছিল ভয় হইয়াছিল তাহার চাইতেও বেশি। সেই হইতে গোব্রার নাম শুনিলেই ভয়ে আমাদের মুখ শুকাইয়া আসিত।
পালোয়ানের কেরামতির পরিচয় পাইয়া আমাদের মনে ভরসা আসিল। আমরা ভাবিলাম, এবার যেদিন পাঠশালার ছেলেগুলো আমাদের ভ্যাংচাইতে আসিবে, তখন আমরাও আরো বেশি করিয়া ভ্যাংচাইতে ছাড়িব না। পালোয়ানও এ কথায় খুব উৎসাহ প্রকাশ করিল। কিন্তু অনেকদিন অপেক্ষা করিয়াও যখন তাহাদের ঝগড়া বাধাইবার আর কোন মতলব দেখা গেল না, তখন আমাদের মনটা খুঁৎ খুঁৎ করিতে লাগিল। আমরা বলিতে লাগিলাম, .ওরা নিশ্চয়ই পালোয়ানের কথা শুনতে পেয়েছে।” পালোয়ান বলিল— “হ্যাঁ, তাই হবে। দেখছ না, এখন আর বাছাদের টুঁ শব্দটি নেই।” তখন সবাই মিলিয়া স্থির করিলাম যে পালোয়ানকে সঙ্গে লইয়া গোব্রার দলের সঙ্গে ভালরকম বোঝাপড়া করিতে হইবে।
শনিবার দুইটার সময় স্কুল ছুটি হইয়াছে, এমন সময় কে যেন আসিয়া খবর দিল যে গোব্রা চার-পাঁচটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া পুকুরঘাটে বসিয়া গল্প করিতেছে। যেমন শোনা অমনি আমরা দলেবলে হৈ হৈ করিতে করিতে সেখানে গিয়া হাজির! আমাদের ভাবখানা দেখিয়াই বোধ হয় তাহারা বুঝিয়াছিল যে আমরা কেবল বন্ধুভাবে আলাপ করিতে আসি নাই। তাহারা শশব্যস্ত হইয়া উঠিতে না উঠিতেই আমরা তিন-চারজন মিলিয়া গোব্রাকে একেবারে চাপিয়া ধরিলাম। সকলেই ভাবিলাম, এ-যাত্রায় গোব্রার আর রক্ষা নাই। কিন্তু আহাম্মক রামপদটা সব মাটি করিয়া দিল। সে বোকারাম ছাতা হাতে হাঁ করিয়া তামাসা দেখিতেছি, এমন সময় পাঠশালার একটা ছোকরা এক থাব্ড়া মারিয়া তাহার ছাতাটা কাড়িয়া লইল। আমরা ততক্ষণে গোব্রাচাঁদকে চিৎপাত করিয়া আনিয়াছি, এমন সময় হঠাৎ আমাদের ঘাড়ে পিঠে ডাইনে বাঁয়ে ধপাধপ্ ছাতার বৃষ্টি শুরু হইল। আমরা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িলাম, আর সেই ফাঁকে গোব্রাও এক লাফে গা ঝাড়া দিয়া উঠিল। তাহার পর চক্ষের নিমেষে তাহারা আমাদের চার-পাঁচজনকে ধরিয়া পুকুরের জলে ভালরকমে চুবাইয়া রীতিমত নাকাল করিয়া ছাড়িয়া দিল। এই বিপদের সময় আমাদের দলের আর সকলে কে যে কোথায় পালাইল, তাহার আর কিনারাই করা গেল না। সব চাইতে আশ্চর্য এই যে, ইহার মধ্যে পালোয়ান যে কোথায় নিরুদ্দেশ হইল,— তাহাকে ডাকিয়া ডাকিয়া আমাদের গলা ফাটিয়া গেল, তবু তাহার সাড়া পাইলাম না।
সোমবার স্কুলে আসিয়াই আমরা সবাই মিলিয়া পালোয়ানকে গাল দিতে লাগিলাম। কিন্তু সে যে কিছুমাত্র লজ্জিত হইয়াছে, এমন বোধ হইল না। সে বলিল— “তোরা যে এমন আনাড়ি, তা জানলে কি আমি তোদের সঙ্গে যাই? আচ্ছা, গোব্রা যখন তোর টুঁটি চেপে ধরল, তখন আমি যে ‘ডানপট্কান দে’ ব’লে এত চেঁচালাম— কৈ, তুই তো তার কিছুই করলি না। আর ঐ গুপেটা, ওকে আমি এতবার বলেছি যে ল্যাংমুচ্কি মরতে হ’লে পাল্টা রোখ্ সামলে চলিস— তা তো ও শুনবে না! এরকম করলে আমি কি করব বল্? ওসব দেখে আমার একেবারে ঘেন্না ধ’রে গেল— তাই বিরক্ত হয়ে চ’লে এলুম। তারপর ভুতোটা, ওটা কি করল বল্ দেখি! আরে, দেখছিস যখন দোরোখা প্যাঁচ্ মারছে, তখন বাপু আহ্লাদ ক’রে কাৎ হ’য়ে পড়তে গেলি কেন?”— ভুতো এতক্ষণ কিছু বলে নাই, কিন্তু পালোয়ানের এই টিপ্পনী কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত তাহার মেজাজের উপর ছ্যাঁক্ করিয়া লাগিল। সে গলায় ঝাঁকড়া দিয়া মুখভঙ্গী করিয়া বলিল, “তুমি বাপু কানকাটা কুকুরের মত পলাইছিলা ক্যান্?” সর্বনাশ! পালোয়ানকে “কানকাটা কুকুর” বলা! আমরা ভাবিলাম, “দেখ, বাঙাল মরে বুঝি এবার!” পালোয়ান খুব গম্ভীর হইয়া বলিল, “দেখ্ বাঙাল! বেশী চালাকি করিস তো চর্কী প্যাঁচ লাগিয়ে একেবারে তুর্কী নাচন নাচিয়ে দেব!” ভুতো বলিল, “তুমি নাচলে বান্দর নাচবা।” রাগে পালোয়ানের মুখচোখ লাল হইয়া উঠিল। সে বেঞ্চি ডিঙ্গাইয়া একেবারে বাঙালের ঘাড়ে গিয়া পড়িল। তারপর দুইজনে কেবল হুড়াহুড়ি আর গড়াগড়ি। আশ্চর্য এই, পালোয়ান এত যে কায়দা আর এত যে প্যাঁচ আমাদের উপর খাটাইত, নিজের বেলায় তার একটিও তাহার কাজে আসিল না। ঠিক আমাদেরই মত হাত-পা ছুঁড়িয়া সে খামচা-খামচি করিতে লাগিল। তারপর বাঙাল যখন তাহার বুকের উপর চড়িয়া দুই হাতে তাহার টুঁটি চাপিয়া ধরিল, তখন আমরা সকলে মিলিয়া দুজনকে ছাড়াইয়া দিলাম। পালোয়ান হাঁপাইতে হাঁপাইতে বেঞ্চে বসিয়া ঘাম মুছিতে লাগিল। তারপর গম্ভীরভাবে বলিল, “গত বছর এই ডান হাতের কব্জিটা জখম হয়েছিল— তাই বড় বড় প্যাঁচগুলো দিতে ভরসা হয় না— যদি আবার মচ্কে ফচ্কে যায়! তা নৈলে ওকে একবার দেখে নিতুম।” ভুতো একথার কোন উত্তর না দিয়া, তাহার নাকের সামনে একবার বেশ করিয়া “কাঁচকলা” দেখাইয়া লইল।
ভুতো ছেলেটি দেখিতে যেমন রোগা এবং বেঁটে, তার হাত-পাগুলিও তেমনি লট্পটে, পালোয়ানের পালোয়ানী সম্মন্ধে অনেকের যে আশ্চর্য ধারণা ছিল, সেই দিনই তাহা ঘুচিয়া গেল। কিন্তু পালোয়ান নামটি আর কিছুতেই ঘুচিল না, সেটি শেষ পর্যন্ত টিকিয়া ছিল।
পুতুলের ভোজ
পুতুলের মা খুকী আজ ভয়ানক ব্যস্ত। আজ কিনা ছোট্ট পুতুলের জন্মদিন, তাই খুব খাওয়ার ধুম লেগেছে। ছোট্ট টেবিলের উপর ছোট্ট ছোট্ট থালা বাটি সাজিয়ে, তার মধ্যে কি চমৎকার ক’রে খাবার তৈরি ক’রে রাখা হয়েছে। আর চারিদিকে সত্যিকারের ছোট্ট ছোট্ট চেয়ার সাজানো রয়েছে, পুতুলেরা বসে খাবে ব’লে।
খুকীর যে ছোটদাদা, তার কিনা সাড়ে চার বছর বয়স, তাই সে বলে, “পুতুলরা খেতেই পারে না, তাদের আবার জন্মদিন কি?” কিন্তু খুকী সে কথা মানবে কেন? সে বলে, “পুতুলরা সব পারে। কে বলল পারে না? কে বলল যে কক্ষনো কোনোদিন তারা কথা বলে না, কক্ষনো কোনোদিন খায় না?”—খোকাপুতুলের যখন অসুখ করেছিল তখন সে কি ‘মা, মা’ বলে কাঁদত না? নিশ্চয়ই কাঁদত। তা না হ’লে খুকী জানল কী ক’রে যে তার অসুখ করেছে? খুকীর দাদা এ সবের জবাব দিতে পারে না, তাই সে, “বোকা মেয়ে, হাঁদা মেয়ে” ব’লে মুখ ভেংচিয়ে চলে যায়।
খুকী গেল তার মা’র কাছে নালিশ করতে। মা সব শুনে-টুনে বললেন, “সব সময়ে সকলের কাছে কি পুতুলরা জ্যান্ত হয়? যেদিন দেখবি পুতুল সত্যি ক’রে খাবার খাচ্ছে, সেদিন ছোড়দাকে ডেকে দেখাস্।” খুকী বললে, “আজকে যদি ওরা জেগে উঠে খাবার খেতে থাকে, তখন কী মজাই হবে! আমার বোধ হয় রাত্তিরে যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি, তখন তাদের দিন হয়! তা না হলে আমরা তো দেখতে পেতাম? সেই যে একদিন টিনের তৈরি দুষ্টু পুতুলটা খাট থেকে পড়ে গিয়েছিল— নিশ্চয় ওরা রাত্রে উঠে মারামারি করেছিল! তা না হলে খাট থেকে পড়ল কেন? আজ থেকে আমি ঘুমোবার সময় খুব ভালো ক’রে কান পেতে থাকব।”
পুতুলের জন্মদিনে কি চমৎকার খাবার! ময়দার মিঠাই, ময়দার পিঠে, ছোট্ট ছোট্ট নারকলের মোয়া, আর ছোট্ট ছোট্ট গুড়ের টিক্লি— এম্নি সব আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিস। রাতরে শোবার আগে খুকী তার পুতুলদের ঝেড়ে মুছে নাইয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়াল আর বলে দিল, “এই দেখ্, খাবার-টাবার রইল, রাত্রে উঠে খাস্।” কোথায় কে বসবে, কোনটার পর কোনটা খাবে, ঝগড়া করলে কে কী শাস্তি পাবে সব ব’লে, তারপর দুষ্টু পুতুলটাকে খুব ব’কে ধমকে, আর ছোট্ট পুতুলকে জন্মদিনের জন্য খুব খানিকটা আদর-টাদর ক’রে, তারপর খুকী গেল বিছানায় শুতে। যেম্নি শোয়া অম্নি ঘুম।
খুকীও ঘুমিয়েছে, আর অম্নি ঘরের মধ্যে কাদের টিপ্টিপ্ পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাদের একজন খুকুমণির জুতোর কাছে, ঘরের কোণে ছবির বইগুলোর কাছে, পুতুলদের চাদর-ঢাকা খাটের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে; এটা ওটা শুঁকছে, আর কুটুর-কুটুর ক’রে এতে ওতে কামড়িয়ে দেখছে! খানিকটা বর্ণ-পরিচয়ের পাতা খেয়ে দেখল, ভালো লাগে না; জুতোর ফিতেটা চিবিয়ে দেখল, তার মধ্যে কিচ্ছু রস নেই; টিনের পুতুলটাকে কামড়িয়ে দেখল— ওরে বাবা, কী শক্ত! এমন সময় হঠাৎ অন্ধকারে তার চোখ পড়ল— টেবিলে সাজানো ও সব কী রে!
দৌড়ে চেয়ার-টেয়ার উল্টিয়ে এক লাফে টেবিলের উপর চ’ড়ে সে একটুখানি শুঁকেই ব্যস্ত হয়ে বলল, “কিঁচ্ কিঁচ্ কীঁ—চ্ !” তার মানে, “ওগো শিগ্গির এস— দেখে যাও!” অম্নি টিপ্ টিপ্ টুপ্ টুপ্ ট্যাপ্ ট্যাপ্ থপ্ ক’রে সেইরকম আর একটা এসে হাজির। ঠিক সেইরকম লোমে ঢাকা ছেয়ে রং, সেইরকম সরু লম্বা ল্যাজ, আর সেইরকম চোখা চোখা নাক আর মিট্মিটে কালো কালো চোখ। দু’জনের উৎসাহ আর ধরে না! এটা কী সুন্দর! ওটা কেমন চমৎকার!” এম্নি ক’রে, দেখতে দেখতে, যত খাবার সব চেটেপুটে শেষ!
সকালবেলায় খুকী উঠে দেখল— ওমা! কি আশ্চর্য! সব খাবার শেষ হয়ে গেছে! কখন যে পুতুলগুলো জেগে উঠল, কখন যে খেল, আর কখন যে আবার ঘুমোল, কিছুই সে টের পায়নি। “খেয়েছে! খেয়েছে! সব খাবার খেয়েছে” ব’লে সে এমন চেঁচিয়ে উঠল যে মা বাবা ছোড়দা বড়দা সবাই ছুটে এসে হাজির।
ব্যাপার দেখে আর খুকীর কথা শুনে সবাই বলল, “তাই তো! কি আশ্চর্য!” খালি ছোড়দা বলল, “তা বই কি! ও নিজে খেয়ে এখন বলছে— পুতুলে খেয়েছে।” দেখ তো কি অন্যায়!
আসলে ব্যাপারটা যে কী, তা কেবল মা জানেন আর বাবা জানেন, কারণ তাঁরা ঘরের কোণে ইঁদুরের ছোট্ট ছোট্ট পায়ের দাগ দেখেছিলেন। কিন্তু সে কথা খুকীকে যদি বল, সে কক্ষনো তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
পেটুক
“হরিপদ! ও হরিপদ!”
হরিপদর আর সাড়াই নেই! সবাই মিলে এত চ্যাঁচাচ্ছে, হরিপদ আর সাড়াই দেয় না। কেন, হরিপদ কালা নাকি? কানে কম শোনে বুঝি? না, কম শুনবে কেন- বেশ দিব্যি পরিষ্কার শুনতে পায়। তবে হরিপদ কি বাড়ি নেই? তা কেন? হরিপদর মুখ ভরা ক্ষীরের লাডু, ফেলতেও পারে না, গিলতেও পারে না। কথা বলবে কি করে? আবার ডাক শুনে ছুটে আসতেও পারে না- তাহলে যে ধরা পড়ে যাবে। তাই সে তাড়াতাড়ি লাড়ু গিলছে আর জল খাচ্ছে, আর যতই গিলতে চাচ্ছে ততই গলার মধ্যে লাড়ুগুলো আঠার মতো আটকে যাচ্ছে। বিষম খাবার যোগাড় আর কি!
এটা কিন্তু হরিপদর ভারি বদভ্যাস। এর জন্য কত ধমক, কত শাসন, কত শাস্তি, কত সাজাই যে সে পেয়েছে,ও তবু তার আক্কেল হল না। তবু সে লুকিয়ে চুরিয়ে পেটুকের মতো খাবেই। যেমন হরিপদ তেমনি তার ছোট ভাইটি। এদিকে পেট রোগা, দুদিন অন্তর অসুখ লেগেই আছে, তবু হ্যাংলামি তাদের আর যায় না। যেদিন শাস্তিটা একটু শক্ত রকমের হয় তারপর কয়েক দিন ধরে প্রতিজ্ঞা থাকে,ও ‘এমন কাজ আর করব না’। যখন অসময়ে অখাদ্য খেয়ে, রাত্রে তার পেট কামড়ায়, তখন কাঁদে আর বলে, “আর না, এইবারেই শেষ”। কিন্তু দুদিন না যেতেই আবার যেই সেই।
এই তো কিছুদিন আগে পিসিমার ঘরে দই খেতে গিয়ে তারা জব্দ হয়েছিল, কিন্তু তবু লজ্জা নেই। হরিপদর ছোট ভাই শ্যামাপদ এসে বলল, “দাদা, শিগগির এস। পিসিমা এই মাত্র এক হাঁড়ি দই নিয়ে তার খাটের তলায় লুকিয়ে রাখলেন।” দাদাকে এত ব্যস্ত হয়ে এ-খবরটা দেবার আর্থ এই যে, পিসিমার ঘরে বিশাল শিকল দেওয়া থাকে, শ্যামাপদ সেটা হাতে নাগাল পায় না- তাই দাদার সাহায্য দরকার হয়। দাদা এসে আস্তে আস্তে শিকলটা খুলে আগেই তারাতাড়ি গিয়ে খাটের তলায় দইয়ের হাঁড়ি থেকে এক খাবল তুলে নইয়ে খপ করে মুখে দিয়েছে। মুখে দিয়েই চীৎকার। কথায় বলে, “ষাঁড়ের মত চ্যাঁচাচ্ছে”, কিন্তু হরিপদর চেঁচানো তার চাইতেও সাংঘাতিক! চীৎকার শুনে মা-মাসি-দিদি-পিসি যে যেখানে ছিলেন সব ‘কি হল, কি হল’ বলে দৌড়ে এলেন। শ্যামাপদ বুদ্ধিমান ছেলে, সে দাদার চীৎকারের নমুনা শুনেই দৌড়ে ঘোষেদের পাড়ায় গিয়ে হাজির! সেখানে অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো তার বন্ধু শান্তি ঘোষের কাছে পড়া বুঝে নিচ্ছে। এদিকে হরিপদর অবস্থা দেখে পিসিমা বুঝেছেন যে,হরিপদ দি ভেবে তাঁর চুনের হাঁড়ি চেখে বসেছে। তারপর হরিপদর যা সাজা! এক সপ্তাহ ধরে সে না পারে চিবোতে, না পারে গিলতে, তার খাওয়া নিয়েই এক মহা হাঙ্গামা! কিন্তু তবু তার লজ্জা নেই! আজ আবার লুকিয়ে কোথায় লাড়ু খেতে গিয়েছে। ওদিকে মামা তো ডেকে সারা!
খানিক বাদে মুখ ধুয়ে মুছে হরিপদ ভালোমানুষের মতো এসে হাজির। হরিপদর বড়মামা বললেন, “কিরে, এতক্ষণ কোথায় ছিলি?” হরিপদ বলল, “এইতো, উপরে ছিলাম।” “তবে, আমরা এত চ্যাঁচাচ্ছিলাম, তুই জবাব দিচ্ছিলি না যে?” হরিপদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আজ্ঞে জল খাচ্ছিলাম কিনা।” “শুধু জল?” না, কিছু স্থলও ছিল?” হরিপদ শুনে হাসতে লাগল যেন তার সঙ্গে ভারই একটা রসিকতা করা হয়েছে। এর মধ্যে তার মেজমামা মুখখানা গম্ভীর করে এসে হাজির। তিনি ভিতর থেকে খবর এনেছেন যে, হরিপদ একটু আগেই ভাঁড়ারঘরে ঢুকেছিল, আর তারপর থেকেই দশ-বারোখানা ক্ষীরের লাড়ু কম পড়েছে। তিনি এসেই হরিপদর বড়মামার সঙ্গে খানিকক্ষণ ইংরাজিতে ফিসফিস কি যেন বলাবলি করলেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, “বাড়িতে ইঁদুরের যে রকম উৎপাত, ইঁদুর মারবার একটা কিছু বন্দোবস্ত না করলে আর চলছে না। চারদিকে যে রকম প্লেগ আর ব্যরাম! এই পাড়া সুদ্ধু ইঁদুর না মারলে আর রক্ষা নেই।” বড়মামা বললেন, “হ্যাঁ, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিদিকে বলেছি, সেঁকো বিষ দইয়ে লাড়ু পাকাবে- সেইগুলো একবার ছড়িয়ে দিলেই ইঁদুর বংশ নির্বংশ হবে।”
হরিপদ জিজ্ঞেস করল, “লাড়ু কবে পাকানো হবে?” বড়মামা বললেন, “সে এতক্ষণে হয়ে গেছে, সকালেই টেঁপিকে দেখছিলাম একথাল ক্ষীর নিয়ে দিদির সঙ্গে লাড়ু পাকাতে বসেছে।” হরিপদর মুখখানা আমসির মতো শুকিয়ে এল, সে খানিকটা ঢেঁকি গিলে বলল, “সেঁকো বিষ খেলে কি হয় বড়মামা?” “হবে আবার কি? ইঁদুরগুলো মারা পড়ে, এই হয়।” “আর যদি মানুষে এই লাড়ু খেয়ে ফেলে?” “তা একটু আধটু যদি খেয়ে ফেলে তো নাও মরতে পারে- গলা জ্বলবে, মাথা ঘুরবে, বমি হবে, হয়তো হাত-পা খিঁচবে।” “আর যদি একেবারে এগারোটা লাড়ু খেয়ে ফেলে?” বলে হরিপদ ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। তখন বড়মামা হাসি চেপে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বললেন, “বলিস কিরে? তুই খেয়েছিস নাকি?” হরিপদ কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হ্যাঁ বড়মামা, তার মধ্যে পাঁচটা খুব বড় ছিল। তুমি শিগগির ডাক্তার ডাক বড়মামা, আমার কি রকম গা ঝিম্ঝিম্ আর বমি বমি করছে।”
বাজে গল্প ১
দুই বন্ধু ছিল। একজন অন্ধ আরেকজন বদ্ধ কালা। দুইজনে বেজায় ভাব। কালা বিঞ্জাপনে পড়িল আর অন্ধ লোকমুখে শুনিল, কোথায় যেন যাত্রা হইবে, সেখানে সঙেরা নাচগান করিবে। কালা বলিল, “অন্ধ ভাই, চল, যাত্রায় গিয়া নাচ দেখি। অন্ধ হাত নাড়িয়া, গলা খেলাইয়া কালাকে বুঝাইয়া দিল, “কালা ভাই, চল, যাত্রায় নাচগান শুনিয়া আসি।
দুইজনে যাত্রার আসরে গিয়া বসিল। রাত দুপুর পর্যন্ত নাচগান চলিল, তারপর অন্ধ বলিল, “বন্ধু, গান শুনিলে কেমন? কালা বলিল, “আজকে তো নাচ দেখিলাম- গানটা বোধহয় কাল হইবে। অন্ধ ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া বলিল, “মূর্খ তুমি! আজ হইল গান- নৃত্যটাই বোধহয় কাল হইবে।”
কালা চটিয়া গেল। সে বলিল , “চোখে দেখ না, তুমি নাচের মর্ম জানিবে কি? অন্ধ তাহার কানে আঙুল ঢুকাইয়া বলিল, “কানে শোন না, গানের তুমি কাঁচকলা বুঝিবে কি? কালা চিত্কার করিয়া বলিল, “আজকে নাচ, কালকে গান, অন্ধ গলা ঝাঁকড়াইয়া আর ঠ্যাং নাচাইয়া বলিল, “আজকে গান, কালকে নাচ।
সেই হইতে দুজনের ছাড়াছাড়ি। কালা বলে, “অন্ধটা এমন জুয়াচোর-সে দিনকে রাত করিতে পারে। অন্ধ বলে, “কালাটা যদি নিজের কথা শুনিতে পাইত, তবে বুঝিত সে কতবড় মিথ্যাবাদী।
বাজে গল্প ২
কতগুলো ছেলে ছাতের উপর হুড়োহুড়ি করে খেলা করছে-এমন সময়ে একটা মারামারির শব্দ শোনা গেল। তার পরেই হঠাৎ গোলমাল থেমে গিয়ে সবাই মিলে ‘হারু পড়ে গেছে’ বলে কাঁদতে কাঁদতে নিচে চলল।
খানিক বাদেই শুনি একতলা থেকে কান্নাকাটির শব্দ উঠছে। বাইরের ঘরে যদুর বাবা গণেশবাবু ছিলেন-তিনি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হয়েছে?’ শুনতে পেলেন ছেলেরা কাঁদছে, ‘হারু পড়ে গিয়েছে।’ বাবু তখন দৌড়ে গেলেন ডাক্তার ডাকতে।
পাঁচ মিনিটে ডাক্তার এসে হাজির, কিন্তু হারু কোথায়? বাবু বললেন, ‘এদিকে তো পড়েনি, ভেতর বাড়িতে পড়েছে বোধহয়।’ কিন্তু ভেতর বাড়িতে মেয়েরা বললেন, ‘এখানে তো পড়েনি-আমরা তো ভাবছি বার-বাড়িতে পড়েছে বুঝি।’ বাইরেও নেই, ভেতরেও নেই, তবে কি ছেলে উড়ে গেল? তখন ছেলেদের জিজ্ঞাসা করা হলো, ‘কোথায় রে? কোথায় হারু?’ তারা বললে, ‘ছাতের উপর।’ সেখানে গিয়ে তারা দেখে, হারু বাবু অভিমান করে বসে বসে কাঁদছে! হারু বড় আদুরে ছেলে, মারামারিতে সে পড়ে গেছে দেখেই আর সকলে মার খাবার ভয়ে সেখান থেকে চম্পট দিয়েছে। ‘হারু পড়ে গেছে’ বলে এত যে কান্না, তার অর্থ, সকলকে জানানো হচ্ছে যে ‘হারুকে আমরা ফেলে দিইনি-সে পড়ে গেছে বলে আমাদের ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে।’
হারু তখন সকলের নামে বাবার কাছে নালিশ করবার জন্য মনে মনে অভিমান জমিয়ে তুলছিল-হঠাৎ তার বাবাকে লোকজন আর ডাক্তার-সুদ্ধ এগিয়ে আসতে দেখে, ভয়ে তার আর নালিশ করাই হলো না। যা হোক, হারুকে আস্ত দেখে সবাই এমন খুশি হলো যে শাসনটাসনের কথা কারও মনেই এল না।
সবচেয়ে বেশি জোরে কেঁদেছিলেন হারুর ঠাকুরমা। তিনি আবার কানে শোনেন কিছু কম। তাঁকে সবাই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এত কাঁদছিলেন কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি কি অত জানি? দেখলুম ঝিয়েরা কাঁদছে, বৌমা কাঁদছেন, তাই আমিও কাঁদতে লাগলুম-ভাবলুম একটা কিছু হয়ে থাকবে।’
বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়
বিষ্ণুবাহন খাসা ছেলে। তাহার নামটি যেমন জমকালো, তার কথাবার্তা চাল-চলনও তেমনি। বড় বড় গম্ভীর কথা তাহার মুখে যেমন শোনাইত, এমন আর কাহারও মুখে শুনি নাই। সে যখন টেবিলের উপর দাঁড়াইয়া হাত পা নাড়িয়া ‘দুঃশাসনের রক্তপান’ অভিনয় করিত, তখন আমরা সবাই উৎসাহে হাততালি দিয়া উঠিতাম, কেবল দু-একজন হিংসুটে ছেলে নাক সিঁট্কাইয়া বলিত, “ওরকম ঢের ঢের দেখা আছে।” ভূতো এই হিংসুটে দলের সর্দার, সে বিষ্ণুবাহনকে ডাকিত ‘খগা’। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, “বিষ্ণুবাহন মানে গরুড়, আর গরুড় হচ্ছেন খগরাজ— খগরাজ পায় লাজ নাসিকা অতুল— তাই বিষ্ণুবাহন হলেন খগা।” বিষ্ণুবাহন বলিল, “ওরা আমার নামটাকে পর্যন্ত হিংসে করে।”
বিষ্ণুবাহনের কে এক মামা ‘চন্দ্রদ্বীপের দিগ্বিজয়’ ব’লে একখানা নতুন নাটক লিখিয়াছেন। বিষ্ণুবাহন একদিন সেটা আমাদের পড়িয়া শোনাইল। শুনিয়া আমরা সকলেই বলিলাম, “চমৎকার!” বিশেষত, যে জায়গায় চন্দ্রদ্বীপ “আয় আয় কাপুরুষ আয় শত্রু আয় রে” বলিয়া নিষাদরাজার সিংহদরজায় তলোয়ার মারিতেছেন, সেই জায়গাটা পড়িতে পড়িতে বিষ্ণুবাহন যখন হঠাৎ “আয় শত্রু আয়” বলিয়া ভূতোর ঘাড়ে ছাতার বাড়ি মারিল, তখন আমাদের এমন উৎসাহ হইয়াছিল যে আর একটু হইলেই একটা মারামারি বাঁধিয়া যাইত। আমরা তখনই ঠিক করিলাম যে ওটা ‘অ্যাক্টিং’ করিতে হইবে।
ছুটির দিনে আমাদের অভিনয় হইবে, তাহার জন্য ভিতরে ভিতরে সব আয়োজন চলিতে লাগিল। রোজ টিফিনের সময় আর ছুটির পরে আমাদের তর্জন-গর্জনে পাড়াশুদ্ধ লোক বুঝিতে পারিত যে, একটা কিছু কাণ্ড হইতেছে। বিষ্ণুবাহন চন্দ্রদ্বীপ সাজিবে, সেই আমাদের কথাবার্তা শিখাইত আর অঙ্গভঙ্গী লম্ফ ঝম্ফ সব নিজে করিয়া দেখাইত। ভূতোর দল প্রথমটা খুব ঠাট্টা বিদ্রূপ করিয়াছিল, কিন্তু যেদিন বিষ্ণুবাহন কোথা হইতে এক রাশ নকল গোঁফ-দাড়ি, কতকগুলা তীর ধনুক, আর রূপালি কাগজ মোড়া কাঠের তলোয়ার আনিয়া হাজির করিল, সেইদিন তাহারা হঠাৎ কেমন মুষ্ড়াইয়া গেল। ভূতোর কথাবার্তা ও ব্যবহার বদলাইয়া আশ্চর্যরকম নরম হইয়া আসিল এবং বিষ্ণুবাহনের সঙ্গে ভাব পাতাইবার জন্য সে হঠাৎ এমন ব্যাকুল হইয়া উঠিল যে ব্যাপার দেখিয়া আমরা সকলেই অবাক হইয়া রহিলাম। তার পরদিনই টিফিনের সময় সে একটি ছেলেকে দিয়া বলিয়া পাঠাইল যে, ‘দূত হোক, পেয়াদা হোক, তাহাকে যাহা কিছু সাজিতে দেওয়া যাইবে, সে তাহাই সাজিতে রাজী আছে।’ শেষ দৃশ্যে রণস্থলে মৃতদেহ দেখিয়া নিষাদরাজের কাঁদিবার কথা— আমরা কেহ কেহ বলিলাম, “আচ্ছা, ওকে মৃতদেহ সাজতে দাও।” বিষ্ণুবাহন কিন্তু রাজী হইল না। সে ছেলেটাকে বলিল, “জিজ্ঞাসা করে আয়, সে তামাক সাজতে পারে কিনা।” শুনিয়া আমরা হো হো করিয়া খুব হাসিলাম, আর বলিলাম, “এইবার ভূতোর মুখে জুতো।”
তারপর একদিন আমরা হরিদাসকে দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন লেখাইলাম। হরিদাস ছবি আঁকিতে জানে, তার হাতের লেখাও খুব ভাল; সে বড় বড় অক্ষরে একটা সাইনবোর্ড লিখিয়া দিল—
“চন্দ্রদ্বীপের দিগ্বিজয়” ১৪ই আশ্বিন, সন্ধ্যা ৬।। ঘটিকা
আমরা মহা উৎসাহ করিয়া সেইটা স্কুলের বড় বারান্দায় টাঙ্গাইয়া দিলাম। কিন্তু পরের দিন আসিয়া দেখি কে যেন ‘চন্দ্রদ্বীপ’ কথাটাকে কাটিয়া মোটা মোটা অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছে— “বিষ্ণুবাহন”— বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়! ইহার উপর ভূতো আবার গায়ে পড়িয়া বিষ্ণুবাহনকে শুনাইয়া গেল, “কিরে খগা, খুব দিগ্বিজয় করছিস যে!”
এমনি করিয়া শেষে ছুটির দিন আসিয়া পড়িল। সেদিন আমাদের উৎসাহ যেন ফাটিয়া পড়িতে লাগিল, আমরা পর্দা ঘেরিয়া তক্তা ফেলিয়া মস্ত স্টেজ বাঁধিয়া ফেলিলাম। অভিনয় দেখিবার জন্য দুনিয়াশুদ্ধ লোককে খবর দেওয়া হইয়াছে, ছয়টা না বাজিতেই লোক আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমরা সকলে তাড়াহুড়া করিয়া পোশাক পরিতেছি, বিষ্ণুবাহন ছুটাছুটি করিয়া ধমক-ধামক দিয়া সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া উপদেশ দিতেছে। দেখিতে দেখিতে সমস্ত যখন ঠিকঠাক হইল, তারপর ঘণ্টা দিতেই স্টেজের পর্দা সর্সর্ করিয়া উঠিয়া গেল, আর চারিদিকে খুব হাততালি খুব হাততালি পড়িতে লাগিল।
প্রথম দৃশ্যেই আছে, চন্দ্রদ্বীপ তাহার ভাই বজ্রদ্বীপের খোঁজে আসিয়া নিষাদরাজার দরজায় উপস্থিত হইয়াছেন, এবং খুব আড়ম্বর করিয়া নিষাদরাজাকে “আয় শত্রু আয়” বলিয়া যুদ্ধে ডাকিতেছেন। যখন তলোয়ার দিয়া দরজায় মারা হইবে তখন নিষাদের দল হুঙ্কার দিয়া বাহির হইবে, আর, এক্তা ভয়ানক যুদ্ধ বাধিবে। দুঃখের বিষয়, বিষ্ণুবাহনের বক্তৃতাটা আরম্ভ না হইতেই সে অতিরিক্ত উৎসাহে ভুলিয়া খটাং করিয়া দরজায় হঠাৎ এক ঘা মারিয়া বসিল। আর কোথা যায়! অমনি নিষাদের দল “মার মার” করিয়া আমাদের এমন ভীষণ আক্রমণ করিল যে, নাটকে যদিও আমাদের জিতিবার কথা, তবু আমরা বক্তৃতা-টক্তৃতা ভুলিয়া যে যার মত পিট্টান দিলাম। বাহিরে আসিয়া বিষ্ণুবাহন রাগে গজ্রাইতে লাগিল। আমরা বলিলাম, “আসল নাটকে কি আছে কেউ ত তা জানে না— না হয়, চন্দ্রদ্বীপ হেরেই গেল।” কিন্তু বিষ্ণুবাহন কি সে কথা শোনে? সে লাফাইয়া ধমকাইয়া হাত পা নাড়িয়া শেষটায় নাটকের বইয়ের উপর এক কালির বোতল উল্টাইয়া ফেলিল, এবং তাড়াতাড়ি রুমাল বাহির করিয়া কালি মুছিতে লাগিল। ততক্ষণে এদিকে দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘণ্টা পড়িয়াছে।
বিষ্ণুবাহন ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া আবার আসরে নামিতে গিয়াই পা হড়্কাইয়া প্রকাণ্ড এক আছাড় খাইল। দেখিয়া লোকেরা কেহ হাসিল, কেহ ‘আহা আহা’ করিল, আর সব গোলমালের উপর সকলের চাইতে পরিষ্কার শোনা গেল ভূতোর চড়া গলার চীৎকার— “বাহবা বিষ্ণুবাহন।” বিষ্ণুবাহন বেচারা এমন অপ্রস্তুত হইয়া গেল যে সেখানে যাহা বলিবার তাহা বেমালুম ভুলিয়া “সেনাপতি! এই কি সে রত্নগিরিপুর” বলিয়া একেবারে চতুর্থ দৃশ্যের কথা আরম্ভ করিল। আমি কানে কানে বলিলাম, “ওটা নয়,” তাহাতে সে আরো ঘাবরাইয়া গেল। তাহার মুখে দরদর করিয়া ঘাম দেখা দিল, সে কয়েকবার ঢোক গিলিয়া, তারপর রুমাল দিয়া মুখ মুছিতে লাগিল। রুমালটি আগে হইতেই কালিমাখা হইয়াছিল, সুতরাং তাহার মুখখানার চেহারা এমন অপরূপ হইল যে আমাদেরই হাসি চাপিয়া রাখা মুস্কিল হইল। ইহার উপর সে যখন ঐ চেহারা লইয়া, ভাঙা ভাঙা গলায় “কোথায় পালাবে তারা শৃগালের প্রায়” বলিয়া বিকট আস্ফালন করিতে লাগিল, তখন ঘরশুদ্ধ লোক হাসিয়া গড়াগড়ি দিবার জোগাড় করিল। বিষ্ণুবাহন বেচারা কিছুই জানে না, সে ভাবিল, শ্রোতাদের কোথাও একটা কিছু ঘটিয়াছে, তাই সকলে হাসিতেছে। সুতরাং সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য আরও উৎসাহে হাত-পা ছুঁড়িয়া ভীষণ রকম তর্জন-গর্জন করিয়া স্টেজের উপর ঘুরিতে লাগিল। ইহাতেও হাসি ক্রমাগত বাড়িতেছে দেখিয়া তাহার মনে কি যেন সন্দেহ হইল, সে হঠাৎ আমাদের দিকে ফিরিয়া দেখে আমরাও প্রাণপণে হাসিতেছি— এবং তাহাকে লক্ষ্য করিয়াই হাসিতেছি! তখন রাগে একেবারে দিগ্বিদিক ভুলিয়া সে তাহার ‘তলোয়ার’ দিয়া বিশুর পিঠে সপাং করিয়া এক বাড়ি মারিল। বিশু চন্দ্রদ্বীপের মন্ত্রী, তাহার মার খাইবার কথাই নয়, সুতরাং সে ছাড়িবে কেন? সে ঠাস্ ঠাস্ করিয়া বিষ্ণুবাহনের গালে দুই চড় বসাইয়া দিল। তখন সে স্টেজের উপরেই সকলের সামনে দুজনের মধ্যে একটা ভয়ানক হুড়োহুড়ি কিলাকিলি বাধিয়া গেল। প্রথমে, প্রায় সকলেই ভাবিয়াছিল ওটা অভিনয়ের লড়াই; সুতরাং অনেকে খুব হাততালি দিয়া উৎসাহ দিতে লাগিল। কিন্তু বিষ্ণুবাহন যখন দস্তুরমত মার খাইয়া “দেখুন দেখি সার্, মিছামিছি মারছে কেন” বলিয়া কাঁদ-কাঁদ গলায় হেডমাস্টার মহাশয়ের কাছে নালিশ জানাইতে লাগিল, তখন ব্যাপারখানা বুঝিতে আর কাহারও বাকী রহিল না।
ইহার পর, সে দিন যে আর অভিনয় হইতেই পারে নাই, একথা বুঝাইয়া বলিবার আর দরকার নাই। ছুটি হইবার তিনদিন পরেই বিষ্ণুবাহন তাহার মামার বাড়ি চলিয়া গেল। ঐ তিনদিন সে বাড়ি হইতে বাহির হয় নাই, কারণ তাহাকে দেখিলেই ছেলেরা চেঁচায়, “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়!” স্কুলের গায়ে রাস্তার ধারে প্ল্যাকার্ড মারা “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়”— এমনকি বিষ্ণুবাহনের বাড়ির দরজায় খড়ি দিয়া বড় বড় অক্ষরে লেখা— “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়”।
বুদ্ধিমান শিষ্য ১
এক মুনি, তাঁর অনেক শিষ্য। মুনিঠাকুর তাঁর পিতৃশ্রাদ্ধে এক মস্ত যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সে যজ্ঞ এর আগে মুনির আশ্রমে আর হয়নি। তাই তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, “আমি এক যজ্ঞের আয়োজন করেছি, সে যজ্ঞ তোমরা হয়তো আর কোথাও দেখবার সুযোগ পাবে না, কাজেই যজ্ঞের সব কাজ কর্ম বিধি ব্যবস্থা বেশ মন দিয়ে দেখো। নিজের চোখে সব ভালো ক’রে না দেখলে শুধু পুঁথি পড়ে এ যজ্ঞ করা সম্ভব হবে না।”
মুনিঠাকুরের আশ্রমে বেড়ালের ভারি উৎপাত; যজ্ঞের আয়োজন সব ঠিক হচ্ছে, এর মধ্যে বেড়ালগুলো এসে জ্বালাতন আরম্ভ করেছে- এটাতে মুখ দেয়, ওটা উল্টে ফেলে, কিছুতেই তাদের সামলানো যায় না। তখন মুনিঠকুর রেগে বললেন, “বেড়ালগুলোকে ধরে ঐ কোণায় বেঁধে রেখে দাও তো।” অমনি নয়টা বেড়ালকে ধরে সভার এক পাশে খোঁটায় বেঁধে রাখা হল। তারপর ঠিক সময় বুঝে যজ্ঞ আরম্ভ হল। শিষ্যেরা সব সভার সাজসজ্জা, আয়োজন, যজ্ঞের সব ক্রিয়া-কাণ্ড, মন্ত্রোচ্চারণের নিয়ম ইত্যাদি মন দিয়ে দেখতে আর শুনতে লাগল। নির্বিঘ্নে অতি সুন্দররূপে মুনিঠাকুরের যজ্ঞ সম্পন্ন হল।
কিছুকাল পরে শিষ্যদের একজনের বাবা মারা গেলেন। শিষ্যের ভারি ইচ্ছা তার পিতৃশ্রাদ্ধে সেও ঐ রকম সুন্দর যজ্ঞের আয়োজন করে। সে গিয়ে তার গুরুকে ধরল। তিনি বললেন, “আচ্ছা, সব আয়োজন করতে থাক, আমি এসে যজ্ঞের পুরোহিত হব।” শিষ্য মহা সন্তুষ্ট হয়ে যজ্ঞের সব ঠিকঠাক করতে লাগল।
ক্রমে যজ্ঞের দিন উপস্থিত। মুনিঠাকুর সশিষ্য শ্রাদ্ধের সভায় উপস্থিত; ঠিক নিয়ম মতো যজ্ঞের সমস্ত ব্যবস্থা প্রস্তুত হয়েছে কিন্তু শিষ্যটি তখনও সভাস্থলে এসে বসছে না, কেবল ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছে। এদিকে যজ্ঞের সময় প্রায় উপস্থিত দেখে মুনিঠাকুরও ক্রমে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি শিষ্যকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর বিলম্ব কেন? সবই তো প্রস্তুত, যজ্ঞের সময়ও উপস্থিত, এই বেলা সভায় এস।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে একটা আয়োজন বাকি রয়ে গেছে, সেইটা নিয়ে ভারি মুশকিলে পড়েছি।” মুনি বললেন, “কই, কিছুরই তো অভাব দেখছি না।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে চারটে বেড়াল কম পড়েছে।” মুনি বললেন, “সে কি রকম?” শিষ্য মুখ কাঁচুমাচু ক’রে বলল, “ঐ যে আপনার যজ্ঞে দেখলাম ঈশান কোণে নয়টা বেড়াল বাঁধা রয়েছে। আমাদের এ গ্রামে অনেক খুঁজে পাঁচটার বেশি পাওয়াই গেল না, কাজেই আর বাকি চারটার জন্য পাশের গ্রামে লোক গিয়েছে; তারা এই এসে পড়ল ব’লে।” শুনে গুরুর তো চক্ষুস্থির! তিনি বললেন, “আরে বুদ্ধিমান! কোনটা যজ্ঞের অঙ্গ আর কোনটা নয় তাও বিচার করতে শেখনি? আশ্রমের বেড়ালগুলি উৎপাত করছিল তাই বেঁধে রেখেছিলাম, তোমার এখানে কোনো উৎপাত ছিল না, তুমি আবার গায়ে পড়ে উৎপাত সংগ্রহ করতে গিয়েছ? বসে পড়, বসে পড়, আর বেড়াল ধরে কাজ নেই। এখন যজ্ঞটা নির্বিঘ্নে শেষ হয়ে যাক্।”
শিষ্য নিজের আহাম্মকিতে লজ্জিত হয়ে আপ্রস্তুত ভাবে সভার মধ্যে বসে পড়ল।
বুদ্ধিমান শিষ্য ২
টোলের যিনি গুরু, তাঁর অনেক শিষ্য। সবাই লেখে, সবাই পড়ে, কেবল একজনের আর কিছুতেই কিছু হয় না। বছরের পর বছর গেল, তার বিদ্যাও হয় না, বুদ্ধিও খুলল না। সকলেই বলে—”ওটা মূর্খ, ওটা নির্বোধ, ওটার আর হবে কি? ওটা যেমন বোকা, তেমনিই থাকবে।” শেষটায় গুরু পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিলেন। বেচারার কিন্তু একটি গুণ সকলেই স্বীকার করে,—সে প্রাণপণে গুরুর সেবা করতে ত্রুটি করে না।
একদিন গুরু শুয়ে আছেন, মূর্খ শিষ্য বসে বসে তাঁর পা টিপে দিচ্ছে। গুরু বললেন, “তুমি ঘমতে যাবার আগে খাটিয়াটা ঠিক করে দিও। পায়াগুলো অসমান আছে।” শিষ্য উঠবার সময় দেখল, একদিকের পায়াটা একেবারে ভাঙা। এখন উপায়? বেচারা খাটের সেই দিকটা নিজের হাঁটুর উপর রেখে সারারাত জেগে কাটাল। সকালে গুরু ঘুম থেকে উঠে ব্যাপার দেখে অবাক!
গুরুর মনে ভারি দুঃখ হল। তিনি ভাবলেন, আহা বেচারা এমন করে আমার সেবা করে, এর কি কোনরকম বিদ্যা বুদ্ধি হবার উপায় নাই? পুঁথি পড়ে বিদ্যালাভ সকলের হয় না, কিন্তু দেখে শুনেও ত কত লোকে কত কি শেখে? দেখা যাক, সেই ভাবে একে কিছু শেখান যায় কিনা। তিনি শিষ্যকে ডেকে বললেন, “বৎস, এখন থেকে তুমি যেখানেই যাও, ভাল ক’রে সব দেখবে—আর কি দেখলে, কি শুনলে, কি করলে, সব আমাকে এসে বলবে।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে, তা বলব।”
তারপর কিছুদিন যায়, শিষ্য একদিন জঙ্গলে একটা কাঠ আনতে গিয়ে একটা সাপ দেখতে পেল। সে টোলে ফিরে এসে গুরুকে বলল, “আজ একটা সাপ দেখেছি।” গুরু উৎসাহ ক’রে বললেন, “বেশ বেশ। বল ত সাপতা কি রকম?” শিষ্য বললে, “আজ্ঞে, ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্।” শুনে গুরু বেজায় খুশী হয়ে বললেন, “হাঁ, হাঁ, ঠিক বলেছ। অনেকটা লাঙ্গলের ডাণ্ডার মতই ত। সরু, লম্বা, বাঁকা আর কালো মতন। তুমি এমনি ক’রে সব জিনিস মন দিয়ে দেখতে শেখ, আর ভাল ক’রে বর্ণনা করতে শেখ, তা হলেই তোমার বুদ্ধি খুলবে।
শিষ্য ত আহ্লাদে আটখানা। সে ভাবলে, “তবে যে লোকে বলে আমার বুদ্ধি নেই।” আর একদিন সে বনের মধ্যে গিয়ে ফিরে এসে গুরুকে বলল, “আজ একটা হাতী দেখলাম।” গুরু বললেন, “হাতীটা কি রকম?” শিষ্য বললে, “ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্।” গুরু ভাবলেন, “হাতীটাকে লাঙ্গল দণ্ডের মত বলছে কেন? ও বোধহয় শুঁড়টাকেই ভাল করে দেখেছে। তা ত হবেই—শুঁড়টাই হল হাতীর আসল বিশেষত্ব কিনা। ও শুধু হাতী দেখেছে তা নয়, হাতীর মধ্যে সব চাইতে যেটা দেখবার জিনিস, সেইটাই আরও বিশেষ করে দেখেছে।’ সুতরাং তিনি শিষ্যকে খুব উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ঠিক, ঠিক, হাতীর শুঁড়টা দেখতে অনেকটা লাঙ্গলের ঈষের মতই ত।” শিষ্য ভাবলে, ‘গুরুর তাক্ লেগে গেছে—না জানি আমি কি পণ্ডিত হলাম রে!’
তারপর শিষ্যরা একদিন গেছে নিমন্ত্রণ খেতে। মূর্খও সঙ্গে গিয়েছে। খেয়েদেয়ে ফিরে আসতেই গুরু বললেন, “কি ক’রে এলে?” শিষ্য বললে, “দুধ দিয়ে, দৈ দিয়ে, গুড় মেখে খেলাম।” গুরু বললেন, “বেশ করেছ। বল ত, দৈ দুধ কি রকম?” শিষ্য একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্।”
গুরুর ত চক্ষুস্থির! তিনি বললেন, “ও মূর্খ! এই বুঝি তোর বিদ্যে! আমি ভাবছি যে তুই বুঝি বুদ্ধি খাটিয়ে সব জবাব দিচ্ছিস। তুই লাঙ্গলও দেখেছিস, দুধ দৈও খেয়েছিস, তবে কোন্ আক্কেলে বললি যে লাঙ্গলের ঈষের মত? দূর্ দূর্ দূর্! কোনদিন তোর কিচ্ছু হবে না।”
শিষ্য বেচারা হঠাৎ এমন তাড়া খেয়ে একেবারেই দমে গেল। সে মনে মনে বলতে লাগল, “এদের কিছুই বোঝা গেল না। ঐ কথাটাই ত ক’দিন ধ’রে ব’লে আসছি, শুনে গুরু রোজই ত খুশী হয়। তাহলে আজকে কেন বলছে ‘দূর দূর’! দুত্তারি! এদের কথার কিছু ঠিক নেই।”
বুদ্ধিমানের সাজা
আলি শাকালের মত ওস্তাদ আর ধূর্ত নাপিত সে সময়ে মেলাই ভার ছিল। বাগদাদের যত বড় লোক তাকে দিয়ে খেউড়ী করাতেন, গরিবকে সে গ্রাহ্যই করত না।
একদিন এক গরীব কাঠুরে ঐ নাপিতের কাছে গাধা বোঝাই ক’রে কাঠ বিক্রী করতে এল। আলি শাকাল কাঠুরেকে বলল, “তোমার গাধার পিঠে যত কাঠ আছে সব আমাকে দাও; তোমাকে এক টাকা দেব।” কাঠুরে তাতেই রাজী হয়ে গাধার পিঠের কাঠ নামিয়ে দিল। তখন নাপিত বলল, “সব কাঠ তো দাও নি; গাধার পিঠের ‘গদি’টা কাঠের তৈরী; ওটাও দিতে হবে।” কাঠুরে তো কিছুতেই রাজী হলো না; কিন্তু নাপিত তার আপত্তি গ্রাহ্য না ক’রে গদিটা জবরদস্তি ক’রে কেড়ে নিয়ে, কাঠুরেকে এক টাকা দিয়ে বিদায় করে দিল।
কাঠুরে বেচারা আর কি করে? সে গিয়ে খালিফের কাছে তার নালিশ জানাল। খালিফ বললেন, “তুমি তো ‘গাধার পিঠের সমস্ত কাঠ’ দিতে রাজী ছিলে; তবে আর এখন আপত্তি করছ কেন? কথামতই তো কাজ হয়েছে।” তারপর কাঠুরের কানে ফিস্ ফিস্ ক’রে কি জানি বললেন; কাঠুরেও মুচ্কি হেসে, “যো হুকুম” বলে সেলাম ঠুকে চলে গেল।
কিছুদিন বাদে কাঠুরে আবার নাপিতের কাছে এসে বলল, “নাপিত সাহেব, আমি আর আমার সঙ্গীকে খেউড়ী করার জন্য তোমাকে ১০ টাকা দেব, তোমার মত ওস্তাদের হাতে অনেক বেশি টাকা দিয়েও খেউড়ী হ’তে পারলে জন্ম সার্থক হয়। তুমি কি রাজী আছ?” নাপিত তো খোসামোদে ভুলে, কাঠুরেকে কামিয়ে চট্পট্ দিল; তারপর তাকে বলল, “কৈ হে তোমার সঙ্গী?” কাঠুরে তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তার গাধাটি এনে হাজির করল। নাপিত তো বেজায় চটে গিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে, ঘুষি বাগিয়ে বলল, “এত বড় বেয়াদবি আমার সঙ্গে! সুলতান, খালিফ, আগা, বেগ যার হাতে খেউড়ী হবার জন্য সর্বদাই খোসামোদ করে, সে কিনা গাধাকে কামাবে! বেরোও এখনি এখান থেকে!”
কাঠুরে নাপিতের কথার কোন উত্তর না দিয়ে সটান গিয়ে খালিফের কাছে হাজির। খালিফ তার নালিশ শুনে আলি শাকালকে ডেকে পাঠালেন। নাপিত এসেই হাত জোড় করে বলল, “দোহাই ধর্মাবতার! গাধাকে কি কখনও মানুষের সঙ্গী ব’লে ধরা যেতে পারে?” খালিফ বললেন, “তা’ না হ’তেও পারে, কিন্তু গাধার পিঠের গদিও কি কখনও কাঠের বোঝার মধ্যে ধরা যেতে পারে? তুমিই একথার জবাব দাও।” নাপিত তো একেবারে চুপ! কিছুক্ষণ বাদে খালিফ বললেন, “আর দেরি কেন? গাধাকে কামিয়ে ফেল; কথা-মত কাজ না করতে পারলে তার উচিত সাজার ব্যবস্থা হবে জানই তো।” নাপিত বেচারা আর করে কি? গাধাকে বেশ ক’রে খুর বুলিয়ে কামাতে লাগল। সে তামাসা দেখবার জন্য চারিদিকে ভিড় জমে গেল। কামান শেষ হতেই নাপিত অপমানে মাথা হেঁট ক’রে বাড়ি পালাল। কাঠুরেও নেড়া গাধায় চ’ড়ে নাচ্তে নাচ্তে বাড়ি পালাল।
বোকা বুড়ি
এক ছিল বুড়ো আর এক ছিল বুড়ী। তারা ভারি গরীব। আর বুড়ী বেজায় বোকা আর ভয়ানক বেশি কথা বলে— যেখানে সেখানে যার তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়— তার পেটে কোন কথা থাকে না।
বুড়ো একদিন তার জমি চষ্তে চষ্তে মাটির নিচে এক কলসী পেলে, সেই কলসী ভরা টাকা আর মোহর! তখন তার ভারি ভাবনা হল— এ টাকা যদি ফেলে রাখি কোনদিন কে চুরি ক’রে নেবে। আর যদি টাকা বাড়ি নিয়ে যাই, বুড়ী টের পেয়ে যাবে— সে সকলের কাছে তার গল্প করবে; ক্রমে কথা রাষ্ট্র হয়ে পড়লে রাজার কোটাল এসে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে যাবে। ভেবে ভেবে সে এক ফন্দি আঁটল। সে ঠিক করল যে বুড়ীকে সব কথা বলবে কিন্তু এ রকম উপায় করব যাতে বুড়ীর কথা কেউ না বিশ্বাস করে।
তখন সে একটা মাছ কিনে এনে তার ক্ষেতের ধারে একটা গাছের উপর বেঁধে রাখল, আর একটা খরগোস এনে নদীর ধারে একটা গর্তের মধ্যে জাল দিয়ে জড়িয়ে রাখল, তারপর সে তার স্ত্রীকে গিয়ে বলল, “একটা ভারি আশ্চর্য খবর শুনলাম— গাছের গায়ে নাকি মাছ উড়ে বসে আর খরগোস নাকি জলে খেলা করে। আমাদের গণক ঠাকুর বলেন—
“মৎস্য বসেন গাছে জলে খরগোস নাচে গুপ্ত রতন খুঁজলে পাবে খুঁড়লে তারি কাছে।”
বুড়ী বলল, “তোমার যেমন কথা!” বুড়ো বলল, “হাঁ! এরকম নাকি সত্যি সত্যি দেখা গেছে।” এই বলে বুড়ো আবার কাজে বেরুল।
আধঘণ্টা না যেতে যেতেই বুড়ো আবার ফিরে এসে ভারি ব্যস্ত হয়ে বুড়ীকে সেই টাকা পাওয়ার কথা বলল। তখন বুড়ো বুড়ী মিলে টাকা আনতে চলল। পথে যেতে যেতে বুড়ো সেই গাছতলায় এসে বলল, “গাছের উপর চক্চক্ করছে কি?” এই বলে সে একটা ঢিল ছুঁড়তেই মাছটা পড়ে গেল। বুড়ী ত অবাক! তখন বুড়ো বলল, “নদীতে জাল ফেলেছিলাম, মাছ-টাছ পড়ল কিনা দেখে আসি।” জাল টানতেই— ওমা! খরগোস যে! তখন বুড়ো বলল, “কেমন! গণক ঠাকুরের কথা আর অবিশ্বাস করবে?” তারপর টাকা নিয়ে তারা বাড়ি এল।
টাকা পেয়েই বুড়ী বলল, “ঘর করব, বাড়ি করব, গহনা বানাব, পোশাক কিনব।” বুড়ো বলল, “ব্যস্ত হ’য়ো না— কিছুদিন র’য়ে স’য়ে দেখ— ক্রমে সবই হবে। হঠাৎ অত কাণ্ড করলে লোকে সন্দেহ করবে যে।” কিন্তু বুড়ীর তাতে মন উঠে না— সে একে বলে, ওকে বলে; শেষে একবারে কোটালের কাছে নালিশ ক’রে দিল। কোটালের হুকুমে বুড়োকে হাতকড়া দিয়ে হাজির করা হল।
বুড়ো সব কথা শুনে বলল, “সে কি হুজুর! আমার স্ত্রীর কি মাথার কিছু ঠিক আছে? সে ত ওরকম আবোল তাবোল কত কি বলে।” কোটাল তখন তেড়ে উঠলেন— “বটে! তুমি টাকা পেয়ে লুকিয়ে রেখেছ— আবার বুড়ীর নামে দোষ দিচ্ছ?” বুড়ো বলল, “কিসের টাকা? কবে পেলাম? কোথায় পেলাম? আমি তো কিছুই জানি না।”
বুড়ী বলল, “না তুমি কিছুই জান না? সেই যেদিন গাছের ডালে মাছ বসেছিল, নদীতে জাল ফেলে খরগোস ধরলে— সেদিনের কথা তোমার মনে নেই? কচি খোকা আর কি?” তাই শুনে সবাই হাসতে লাগল; কোটাল এক ধমক দিয়ে বুড়ীকে বলল— “যা পাগ্লী, বাড়ি যা! ফের যদি যা-তা বলবি তোকে আমি কয়েদ ক’রে রাখব।”
বুড়ী তখন বাড়ি ফিরে গেল। কোটালের ভয়ে সে আর কারু কাছে টাকার কথা বলত না।
ব্যাঙের রাজা
রাজবাড়িতে যাবার যে পথ, সেই পথের ধারে প্রকাণ্ড দেয়াল, সেই দেয়ালের একপাশে ব্যাঙেদের পুকুর। সোনাব্যাং, কোলাব্যাং, গেছোব্যাং, মেঠোব্যাং— সকলেরই বাড়ি সেই পুকুরের ধারে। ব্যাঙেদের সর্দার যে বুড়ো ব্যাং, সে থাকে দেয়ালের ধারে, একটা মরা গাছের ফাটলের মধ্যে, আর ভোর হলে সবাইকে ডাক দিয়ে জাগায়— “আয় আয় আয়— গ্যাঁক্ গ্যাঁক্ গ্যাঁক্— দেখ্ দেখ্ দেখ্— ব্যাং ব্যাং ব্যাং— ব্যাঙ্গাচি।” এই ব’লে সে অহংকারে গাল ফুলিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, আর ব্যাংগুলো সব “যাই যাই যাই— থাক্ থাক্ থাক্” ব’লে, ঘুম ভেঙে, মুখ ধুয়ে দাঁত মেজে, পুকুর-পারের সভায় বসে।
একদিন হয়েছে কি, সর্দার ব্যাং ফুর্তির চোটে লাফ দিয়েছে উলটোমুখে ডিগবাজি খেয়ে— আর পড়বি তো পড়, এক্কেবারে দেয়াল টপকে রাজপথের মধ্যিখানে! রাজা তখন সভায় চলেছেন, সিপাইশান্ত্রী লোকলস্কর দলবল সব সঙ্গে চলেছে। মোটা মোটা সব নাগ্রাই জুতো, খট্মট্ ঘ্যাঁচ্ম্যাঁচ্ ক’রে ব্যাং বুড়োর মাথার উপর দিয়ে ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে এমনি রোখ ক’রে চলতে লেগেছে, যে ভয়ে ব্যাঙের প্রাণ তো যায় যায়! হঠাৎ কোত্থেকে কার একটা লাঠি না ছাতা না কিসের গুঁতো এসে এমনি ধাঁই করে ব্যাঙের গায়ে লেগেছে যে সে বেচারা ঠিক্রে গিয়ে পথের ধারে ঘাসের উপর চিৎপাত হয়ে পড়েছে। ব্যাং বুড়োর খুব লেগেছিল, কিন্তু হাতও ভাঙেনি, পাও ভাঙেনি, সে আস্তে আস্তে উঠে বসল— আর চারিদিকে তাকিয়ে, দেয়ালের গায়ে একটা ফাটল দেখে, তাড়াতাড়ি তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে খুব সাবধানে মুখ বার ক’রে সে চেয়ে দেখল, মাথায়-মুকুট রঙ্গিন-পোশাক রাজা, আলো-ঝল্মল্ চতুর্দোলায় চড়ে সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা সব “রাজা, রাজা” ব’লে নমস্কার করছে, নাচছে, গাইছে আর ছুটোছুটি করছে। আর রাজামশাই চতুর্দোলায় ব’সে খুশি হয়ে, এর দিকে তাকাচ্ছেন, ওর দিকে তাকাচ্ছেন, আর কেবলই হাসছেন। তাই দেখে ব্যাঙের বড় ভালো লাগল, সেও দু’হাত তুলে নমস্কার করতে লাগল আরে বলতে লাগল, “রাজা রাজা রাজা— রাজা রাজা রাজা—” তার মনে হল রাজামশাই ঠিক যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিক্ ক’রে হেসে ফেললেন! ব্যাং তখন কাঁদ কাঁদ হয়ে নিশ্বাস ফেলে ভাবল, “আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!”
তারপর ঘুরে ঘুরে পথ খুঁজে খুঁজে ব্যাং যখন বাসায় ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সবাই বলল, “সর্দার বুড়ো, সর্দার বুড়ো, সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা যে কত ডাকলাম, কত খুঁজলাম, তুমি তো কই সাড়াও দিলে না।” সর্দার বলল— “চোপ্ চোপ্ চোপ্ রাও! রাজা দেখতে গিয়েছিলাম।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সব এক সঙ্গে “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” ব’লে চেঁচিয়ে উঠল। বুড়ো তখন গাল ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে, দ’চোখ বুজে, দু’হাত তুলে লাফিয়ে বলল, “রাজা হচ্ছে এই এত্তো বড়ো উঁচু, আর ধব্ধবে সাদা আর ঝক্ঝকে আলোর মতো— আর তাকে দেখলেই সবাই মিলে ডাকতে থাকে— ‘রাজা রাজা রাজা রাজা’।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সবাই বলতে লাগল, “আহা! আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!” তাদের যে রাজা নেই, এই কথা ভাবতে ভাবতে তাদের চোখ দিয়ে ঝরঝর ক’রে জল পড়তে লাগল। বুড়ো ব্যাং বলল, “ভাই সকল, এস আমরা রাজার জন্য দরখাস্ত করি।” তখন সবাই মিলে গোল হয়ে ব’সে, আকাশের দিকে চোখ তুলে, নানান্ সুরে ডাকতে লাগল— “রাজা রাজা রাজা রাজা— রাজা রাজা রাজা রাজা— রাজা চাই রাজা চাই— রাজা চাই রাজা চাই।”
ব্যাংপুকুরের ব্যাং দেবতা— যিনি বাদ্লা দিনে বর্ষা মেঘের ঝাঁঝরি দিয়ে পুকুর ভরে জল ঢালেন— তিনি তখন আকাশতলায় চাদর মেলে ঘুমচ্ছিলেন। হঠাৎ ব্যাঙেদের চীৎকারে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, “বৃষ্টিও নেই, বাদ্লাও নেই, মেঘের কোনো চিহ্নও নেই, বাছারা সব চেঁচাও কেন?” ব্যাঙেরা বলল, “আমাদের রাজা নেই, রাজা চাই।” দেবতা বললেন, “এই নে রাজা।” ব’লে মরা গাছের একখানা ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিলেন।
ভাঙা ডাল পুকুরপাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল— তার মাথার উপর মস্ত মস্ত ব্যাঙের ছাতা জোছনায় চক্চক্ করতে লাগল। তাই দেখে ব্যাঙের ফুর্তি আর ধরে না। তারা গোল হয়ে ঘিরে ব’সে মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গাইতে লাগল— “রাজা রাজা রাজা রাজা— রাজা রাজা রাজা রাজা —”
এমনি ক’রে দু’দিন যায়, দশদিন যায়, শেষটায় একদিন সর্দার গিন্নী বললেন, “ছাই রাজা! কর্তা যে সেদিন রাজা দেখলেন, এর চেয়ে সে অনেক ভালো। এ রাজা নড়েও না চড়েও না, এদিকেও চায় না ওদিকেও চায় না— ছাই রাজা!” তাই শুনে সবাই বলল, “ছাই রাজা! ছাই রাজা!— নড়েও না চড়েও না, দেখেও না শোনেও না— ছাই রাজা!” তখন আবার বুড়ো ব্যাং গাছের উপর চড়ে বলল, “ভাই সকল, এস আমরা দরখাস্ত করি— আমাদের ভালো রাজা চাই।” আবার সবাই গোল হয়ে ব’সে আকাশপানে চোখ তাকিয়ে নানান্ সুরে ডাকতে লাগল— “রাজা চাই! রাজা চাই! ভালো রাজা— নতুন রাজা।” তাই শুনে ব্যাং দেবতা জেগে বললেন, “ব্যাপারখানা কী? এই তো সেদিন তোদের রাজা দিলাম, এর মধ্যে আবার নতুন কী হল?” ব্যাঙেরা বলল, “ও রাজা ছাই রাজা! ও রাজা বিশ্রী রাজা— ও রাজা নড়েও না চড়েও না— ও রাজা চাই না চাই না চাই না চাই না চাই না চাই না—” ব্যাং দেবতা বললেন, “থাম তোরা থাম্— নতুন রাজা দিচ্ছি।” এই ব’লে একটা বককে সেই পুকুরের ধারে নামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “এই নে তোদের নতুন রাজা।”
তাই না দেখে ব্যাঙেরা সব আবাক হয়ে বলতে লাগল, “বাপ্রে বাপ্! কি প্রকাণ্ড রাজা!” চক্চকে ঝক্ঝকে ধব্ধবে সাদা! ভালো রাজা! সুন্দর রাজা! রাজা রাজা রাজা রাজা।” বকের তখন খিদে ছিল না, মাছ খেয়ে পেট ভরা ছিল, তাই সে কিছু বলল না; খালি চোক মিট্মিট্ ক’রে একবার এদিকে তাকাল, একবার ওদিকে তাকাল, তারপর এক পা তুলে চুপচাপ ক’রে দাঁড়িয়ে রইল। তাই দেখে ব্যাঙেদের উৎসাহ আর ধরে না, তারা প্রাণ খুলে গলা ছেড়ে গাইতে লাগল। সকাল গেল, দুপুর গেল, বিকেল হল, সন্ধ্যা হল— তারপর ঘুট্ঘুটে অন্ধকার রাত্রি এল— তখন ব্যাঙেদের গান গাওয়া বন্ধ হল।
তার পরের দিন সকালবেলায় উঠে যেমনি তারা গান ধরেছে, অমনি বকরাজা এসে একটা গোব্দামতন মোটা ব্যাংকে টপাস্ ক’রে মুখের মধ্যে পুরে দিয়েছে! তাই দেখে ব্যাঙেরা সব হঠাৎ কেমন মুষড়ে গেল— তাদের “রাজা রাজা”র গান একেবারে পাঁচ সুর নেমে গেল। বকরাজা ব্যাংটিকে দিয়ে জলযোগ ক’রে একটি ঠ্যাং মুড়ে ধ্যান ক রতে লাগলেন। এমনি ক’রে এক-এক বেলায় এক-একটি ক’রে ব্যাং বকরাজার পেটের মধ্যে যায়। ব্যাং-মহলে হৈ চৈ লেগে গেল। সবাই মিলে সভায় ব’সে যুক্তি ক’রে বলল, “এটা বড় অন্যায় হচ্ছে। রাজাকে বুঝিয়ে বলা দরকার, সে হল আমাদের রাজা, সে এমন করলে আমরা পালাই কোথা?” কিন্তু বুঝিয়ে বলবে কে? সর্দার গিন্নী বললেন, “তার জন্য ভাবছিস্ কেন? এতে আরে মুশকিল কিসের? এই দেখ্ না, আমিই গিয়ে ব’লে আসছি।”
সর্দার গিন্নী বকরাজার পায়ের সামনে গ্যাঁট হয়ে ব’সে, হাতমুখ নেড়ে কড়্কড়ে গলায় বলতে লাগলেন, “ও রাজা, তোর ভাগ্যি ভালো, তুই আমাদের রাজা হলি। তোর চোখ ভালো, মুখ ভালো, ঝক্ঝকে রঙ ভালো, তোর এক পা-ও ভালো, দুই পা-ও ভালো, কেবল ঐটি তোর ভালো নয়, তুই আমাদের খাস কেন? শামুক আছে, শামুক খা’ না, পোকা মাকড় প্রজাপতি তাও তো তুই খেতে পারিস। রাজা হয়ে আমাদের খেতে চাস? ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা — রাম রাম রাম রাম— অমন আর কক্ষনো করিসনে।” বক দেখলে তার পায়ের কাছে দিব্যি একটা নাদুসনুদুস ব্যাং, তার নরম নরম গোলগাল চেহারা! টপ্ ক’রে বকরাজার জিভ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল আর খপ্ ক’রে সর্দার গিন্নী তার মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
ব্যাঙেদের মুখে আর কথাটি নেই। সবাই তাড়াতাড়ি চট্পট্ সরে ব’সে বড় বড় হাঁ ক’রে তাকিয়ে রইল। পরে সর্দার ব্যাং রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, “পাজি রাজা! লক্ষীছারা দুষ্টু রাজা!” তাই শুনে সবাই একসঙ্গে আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, “পাজি রাজা! দুষ্টু রাজা!— চাই না চাই না চাই না চাই না— রাজা চাই না, রাজা চাই না।”
ব্যাং দেবতা জেগে বললেন, “দূর ছাই! আবার কী হল?” ব্যাঙেরা বলল, “বাপ্রে বাপ্! বাপ্রে বাপ্! কী দুষ্টু রাজা! নিয়ে যাও, নিয়ে যাও, নিয়ে যাও!”
তখন ব্যাং দেবতা হুশ্ ক’রে তাড়া দিতেই বকরাজা পাখা মেলে উড়ে পালাল। আর ব্যাঙেরা সব বাসায় গিয়ে বলতে লাগল, “গ্যাঁক্ গ্যাঁক্ গ্যাঁক্ — বাপ্ বাপ্ বাপ্— ছ্যা ছ্যা ছ্যা— রাজাটাজা আর কক্ষনো চাইব না।”
ব্যাঙের সমুদ্র দেখা
(জাপানী গল্প) গ্রামের ধারে কবেকার পুরান এক পাতকুয়োর ফাটলের মধ্যে কোলাব্যাং তার পরিবার নিয়ে থাকত। গ্রামের মেয়েরা সেখানে জল তুলতে এসে যেসব কথাবার্তা বলত কোলাব্যাং তার ছেলেদের সেইসব কথা বুঝিয়ে দিত—আর ছেলেরা ভাবত ‘ইস্! বাবা কত জানে!’
একদিন সেই মেয়েরা সমুদ্রের কথা বলতে লাগল। ব্যাঙের ছানারা জিজ্ঞাসা করল—”হ্যাঁ বাবা! সমুদ্র কাকে বলে?” ব্যাং খানিক ভেবে বলল, “সমুদ্র? সে একরকম জন্তুর নাম।” তখন একটা ছানা বলল—”ওরা যে বলছিল সমুদ্র খুব ভয়ানক বড় হয়, আর তার মধ্যে অনেক জল থাকে—আর লোকেরা সাঁতার কেটে তা পার হতে পারে না।” তখন কোলাব্যাং মুশকিলে পড়ল। সে গাছপালা দেখেছে, বাড়িঘর দেখেছে—মানুষ কুকুর ঘটি বাটি নানারকম জিনিসপত্র দেখেছে, আর ছেলেবেলায় অনেকরকম জিনিসের গল্প শুনেছে। কিন্তু সমুদ্রের কথা ত কখন শোনেনি! তখন সে ভাবল সমুদ্রের কথা একটু খোঁজ করে দেখতে হবে।
পরদিন সকালে উঠেই কোলাব্যাং তার ছাতা পোঁটলা নিয়ে বলল, “আমি সমুদ্রের সন্ধান করতে যাচ্ছি।” তার গিন্নী কত কাঁদল, ছেলেরা নানারকম সুর করে তাকে বারণ করল কিন্তু কোলাব্যাং বলল, “না, এতে আমার জ্ঞানলাভ হবে—তোমরা বাধা দিও না।” এই বলে সে পাতকুয়ো থেকে উঠে একটা মাঠের দিকে চলল। ব্যাং বাইরে এসেই দেখে মানুষ কুকুর গরু তারা কেউ তার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে না—তাই দেখে সে ভাবল ‘লাফিয়ে চললে সবাই আমায় বেকুব ভাববে।’ এই ভেবে সে হেঁটে হেঁটে চলতে লাগল। কিন্তু অমন করে চলে ত তার অভ্যাস নেই—খানিক গিয়েই তার ভারই পরিশ্রম বোধ হল।
মাঠের ওপারে আর এক গ্রামের কাছে এক গর্তের মধ্যে মেতে ব্যংদের বাসা ছিল। মেটে ব্যাঙেরাও সমুদ্রের কথা শুনেছে, তাই তাদের মধ্যে একজন বেরিয়েছে সমুদ্রটা দেখতে। মাঝখানে দুই ব্যাঙের দেখা হল। কোলাব্যাং বলল, “আমি ফাটল-কুয়োর কোলাব্যাং, যাচ্ছি সমুদ্রে।” মেটে ব্যাং বলল, “আমি মেঠো-ব্যাং, আমিও যাচ্ছি সমুদ্রে।” তখন তাদের ভারি ফূর্তি হল।
কিন্তু সমুদ্রে যাবার পথ ত তারা জানে না। মাঠের মধ্যে একটা মস্ত ঢিপি ছিল; মেটে ব্যাং বলল, “ওর উপরে উঠে দেখি ত কিছু দেখা যায় কিনা।”
এই বলে তারা অনেক কষ্টে সেই ঢিপির উপর চড়ে সেখান থেকে একটা গ্রাম দেখতে পেল। মেটে ব্যাং বলল, “আরে দুর ছাই! এরকম ত ঢের দেখেছি! আমার বাড়ির কাছেই ত অমন আছে।” কোলাব্যাং বলল, “তাই ত! আমিও ছেলেবেলা থেকে ওরকম কত দেখেছি। সব জায়গাই দেখছি একরকম। মিছামিছি আমরা হেঁটে মরলাম।”
তখন তারা ভারই বিরক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে গেল। কোলাব্যাং তার ছানাদের বলল, “সমুদ্র টমুদ্র কিছু নেই—ওসব মিছে কথা!”
ব্যোমকেশের মাঞ্জা
‘টোকিয়ো—কিয়োটো—নাগাসাকি—য়োকোহামা’ — বোর্ডের উপর প্রকাণ্ড ম্যাপ ঝুলিয়ে হারাণচন্দ্র জাপানের প্রধান নগরগুলি দেখিয়ে যাচ্ছে। এর পরেই ব্যোমকেশের পালা কিন্তু ব্যোমকেশের সে খেয়ালই নেই। কাল বিকেলে ডাক্তারবাবুর ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে প্যাঁচ খেলতে গিয়ে তার দুটো-দুটো ঘুড়ি কাটা গিয়েছিল, সে-কথাটা ব্যোমকেশ কিছুতেই আর ভুলতে পারছে না। তাই সে বসে বসে সুতোর জন্যে কড়া রকমের একটা মাঞ্জা তৈরির উপায় চিন্তা করছে। চীনে শিরিস গালিয়ে, তার মধ্যে বোতলচুর আর কড়কড়ে এমেরি পাউডার মিশিয়ে সুতোয় মাখালে পর কি রকম চমৎকার মাঞ্জা হবে, সেই কথা ভাবতে ভাবতে উৎসাহে তার দুই চোখ কড়িকাঠের দিকে গোল হয়ে উঠছে। মনে মনে মাঞ্জা দেওয়া ঘুড়ির সুতোটা সবে তালগাছের আগা পর্যন্ত উঠে, আশ্চর্য কায়দায় ডাক্তারের ছেলের ঘুড়িটাকে কাটতে যাচ্ছে, এমন সময়ে গম্ভীর গলায় ডাক পড়ল— “তারপর, ব্যোমকেশ এস দেখি।”
ঐ রকম ভীষণ উত্তেজনার মধ্যে, সুতো-মাঞ্জা, ঘুড়ির প্যাঁচ সব ফেলে আকশের উপর থেকে ব্যোমকেশকে হঠাৎ নেমে আসতে হল একেবারে চীন দেশের মধ্যিখানে। একে তো ও দেশটার সঙ্গে তার পরিচয় খুব বেশি ছিল না, তার উপর যা-ও দু-একটা চীনদেশী নাম সে জানত, ওরকম হঠাৎ নেমে আসবার দরুন, সেগুলোও তার মাথার মধ্যে কেমন বিচ্ছিরি রকম ঘন্ট পাকিয়ে গেল। পাহাড়, নদী, দেশ, উপদেশের মধ্যে ঢুকতে না ঢুকতে বেচারা বেমালুম পথ হারিয়ে ফেলল। তার কেবলই মনে হতে লাগল যে চীনদেশের চীনে শিরীষ, তাই দিয়ে হয় মাঞ্জা। মাস্টারমশাই দু-দুবার তাড়া দিয়ে যখন তৃতীয়বার চড়া গলায় বললেন, “চীন দেশের নদী দেখাও” তখন বেচারা একেবারেই দিশেহারা আর মরিয়া মতন হয়ে বললে— “সাংহাই।” সাংহাই বলবার আর কোনো কারণ ছিল না, বোধ হয় তার সেজমামার যে স্ট্যাম্প সংগ্রহের খাতা আছে তার মধ্যে ঐ নামটাকে সে পেয়ে থাকবে — বিপদের ধাক্কায় হঠাৎ কেমন করে ঐটেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
গোটা দুই চড়-চাপড়ের পর ব্যোমকেশবাবু তাঁর কানের উপর মাস্টারমশায়ের প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে, বিনা আপত্তিতে বেঞ্চের উপর আরোহণ করলেন। কিন্তু কানদুটো জুড়োতে না জুড়োতেই মনটা তার খেই-হারানো ঘুড়ির পিছনে উধাও হয়ে, আবার সুতোর মাঞ্জা তৈরি করতে বসল। সারাটা দিন বকুনি খেয়েই তার সময় কাটল, কিন্তু এর মধ্যে কত উঁচুদরের মাঞ্জা-দেওয়া সুতো তৈরি হল আর কত যে ঘুড়ি গণ্ডায় গণ্ডায় কাটা পড়ল সে জানে কেবল ব্যোমকেশ।
বিকেলবেলায় সবাই যখন বাড়ি ফিরছে, তখন ব্যোমকেশ দেখল, ডাক্তারের ছেলেটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মস্ত একটা লাল রঙের ঘুড়ি কিনছে। দেখে ব্যোমকেশ বন্ধু পাঁচকড়িকে বলল, “দেখেছিস, পাঁচু, আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে আবার ঘুড়ি কেনা হচ্ছে! এ-সব কিন্তু নেহাত বাড়াবাড়ি। না হয় দুটো ঘুড়িই কেটেছিস বাপু, তার জন্যে এত কি গিরিম্বাড়ি!” এই ব’লে সে পাঁচুর কাছে তার মাঞ্জা তৈরির মতলবটা খুলে বলল। শুনে পাঁচু গম্ভীর হয়ে বলল, “তা যদি বলিস, তুই আর মাঞ্জা তৈরি করে ওদের সঙ্গে পারবি ভেবেছিস্? ওরা হল ডাক্তারের ছেলে, নানা রকম ওষুধ-মশলা জানে। এই তো সেদিন ওর দাদাকে দেখলুম, শানের উপর কি একটা আরক ঢেলে দিলে, আর ভসভস্ করে গ্যাঁজালের মতো তেজ বেরুতে লাগল। ওরা যদি মাঞ্জা বানায়, তাহলে কারু মাঞ্জার সাধ্যি নেই যে তার সঙ্গে পেরে ওঠে।” শুনে ব্যোমকেশের মনটা কেমন দমে গেল। তার ধ্রুব রকম বিশ্বাস হল যে, ডাক্তারের ছেলেটা নিশ্চয় কোনো আশ্চর্য রকম মাঞ্জার খবর জানে। তা নইলে ব্যোমকেশের চাইতেও চার বছরের ছোট হয়ে, সে কেমন করে তার ঘুড়ি কাটল? ব্যোমকেশ স্থির করল, যেমন করে হোক ওদের বাড়ির মাঞ্জা খানিকটা যোগাড় করতেই হবে। সেটা একবার আদায় করতে পারলে, তারপর সে ডাক্তারের ছেলেকে দেখে নেবে।
বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি জলখাবার সেরে নিয়ে ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল ডাক্তারবাবুর ছেলেদের সঙ্গে আলাপ করতে। সেখানে গিয়ে সে দেখে কি, কোণের বারান্দায় বসে সেই ছোট্ট ছেলেটা একটা ডাক্তারি থলের মধ্যে কি যেন মশলা ঘুঁটছে। ব্যোমকেশকে দেখে সে একটা চৌকির তলায় সব লুকিয়ে ফেলে সেখান থেকে সরে পড়ল। ব্যোমকেশ মনে মনে বললে, ‘বাপু হে! এখন আর লুকিয়ে করবে কি? তোমার আসল খবর আমি পেয়েছি’ — এই ব’লে সে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলে, কোথাও কেউ নেই। একবার সে ভাবল, কেউ আসলে এর একটুখানি চেয়ে নেব। আবার মনে হল, কি জানি চাইলে যদি না দেয়? তারপর ভাবলে, দূর! ভারি তো জিনিস তা আবার চাইবার দরকার কি? এই একটুকু মাঞ্জা হলেই প্রায় দুশো গজ সুতোয় শান দেওয়া হবে। এই ভেবে সে চৌকির তলা থেকে এক খাবলা মশলা তুলে নিয়েই এক দৌড়ে বাড়ি এসে হাজির।
আর কি তখন দেরি সয়? দেখতে দেখতে দক্ষিণের বারান্দা জুড়ে সুতো খাটিয়ে, মহা উৎসাহে মাঞ্জা দেওয়া শুরু হল। যাই বল, মাঞ্জাটা কিন্তু ভারি অদ্ভুত — কই, তেমন কড়কড়্ করছে না তো! বোধ হয়, খুব মিহি গুঁড়োর তৈরি — আর কালো কাচের গুঁড়ো। দুঃখের বিষয়, বেচারার কাজটা শেষ না হতেই সন্ধ্যা হয়ে এল, আর তার বড়দা এসে বললে, “যা, যা! আর সুতো পাকাতে হবে না, এখন পড়গে যা।”
সে রাত্তিরে ব্যোমকেশের ভালো করে ঘুমই হল না। সে স্বপ্ন দেখল যে, ডাক্তারের ছেলেটা হিংসে করে তার চমৎকার সুতোয় জল ফেলে সব নষ্ট করে দিয়েছে। সকাল হতে না হতেই ব্যোমকেশ দৌড়ে গেল তার সুতোর খবর নিতে। কিন্তু গিয়েই দেখে, কে এক বুড়ো ভদ্রলোক ঠিক বারান্দার দরজার সামনে বসে তার দাদার সঙ্গে গল্প করছেন, তামাক খাচ্ছেন। ব্যোমকেশ ভাবলে, দেখ তো কি অন্যায়! এর মধ্যে থেকে এখন সুতোটা আনি কেমন করে? যাহোক, অনেকক্ষণ ইতস্তত করে সে খুব সাহসের সঙ্গে গিয়ে, চট করে তার সুতো খুলে নিয়ে চলে আসছে — এমন সময়, হঠাৎ কাশতে গিয়ে বুড়ো লোকটির কলকে থেকে খানিকটা টিকে গেল মাটিতে পড়ে। বৃদ্ধ তখন ব্যস্ত হয়ে হাতের কাছে কিছু না পেয়ে, ব্যোমকেশের সেই মাঞ্জা-মাখানো কাগজটা দিয়ে টিকেটাকে তুলতে গেলেন।
সর্বনাশ! যেমন টিকের উপর কাগজ ছোঁয়ানো, অমনি কিনা ভসভস্ করে কাগজ জ্বলে উঠে ভদ্রলোকের আঙুল-টাঙুল পুড়ে, বারান্দার বেড়ায় আগুন-টাগুন লেগে এক হুলস্থুল কাণ্ড! অনেক চেঁচামেচি ছুটোছুটি আর জল ঢালাঢালির পর যখন আগুনটা নিভে এল, আর ভদ্রলোকের আঙুলের ফোস্কায় মলম দেয়া হল, তখন তার দাদা এসে তার কান ধরে বললেন, “হতভাগা! কি রেখেছিলি কাগজের মধ্যে বল্ তো?” ব্যোমকেশ কাঁদ-কাঁদ হয়ে বললে, “কিচ্ছু তো রাখিনি, খালি সুতোর মাঞ্জা রেখেছিলাম।” দাদা তার কৈফৈয়ৎটাকে নিতান্তই আজগুবি মনে করে, “আবার এয়ার্কি হচ্ছে?” ব’লে বেশ দু-চার ঘা কষিয়ে দিলেন। বেচারা ব্যোমকেশ এই ব’লে তার মনকে খুব খানিক সান্ত্বনা দিল যে, আর যাই হোক, তার সুতোটুকু রক্ষা পেয়েছে। ভাগ্যিস সে সময়মতো খুলে এনেছিল, নইলে তার সুতোও যেত, পরিশ্রমও নষ্ট হত।
বিকেলে সে বাড়ি এসেই চটপট ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে ছাতের উপর উঠল। মনে মনে বলল, ‘ডাক্তারের পো আজ একবার আসুক না, দেখিয়ে দেব প্যাঁচ খেলাটা কাকে বলে।’ এমন সময়ে পাঁচকড়ি এসে বড় বড় চোখ করে বললে, “শুনেছিস্?”ব্যোমকেশ বললে, “না— কি হয়েছে?” পাঁচু বললে, “ওদের সেই ছেলেটাকে দেখে এলুম, সে নিজে নিজে দেশলাইয়ের মশলা বানিয়েছে, আর চমৎকার লাল নীল দেশলাই তৈরি করছে।” ব্যোমকেশ হঠাৎ লাটাই-টাটাই রেখে, এত বড় হাঁ করে জিগ্গেস করলে, “দেশলাই কিরে! মাঞ্জা বল?” শুনে পাঁচু বেজায় চটে গেল, “বলছি লাল নীল আলো জ্বলছে, তবু বলবে মাঞ্জা, আচ্ছা গাধা যা হোক!”
ব্যোমকেশ কোনো জবাব না দিয়ে, দেশলাইয়ের মশলা-মাখানো সুতোটার দিকে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইল। সেই সময় ডাক্তারদের বাড়ি থেকে লাল রঙের ঘুড়ি উড়ে এসে, ঠিক ব্যোমকেশের মাথার উপর ফরফর্ করে তাকে যেন ঠাট্টা করতে লাগল। তখন সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। বলল, “আমার অসুখ করেছে।”
ভাঙা তারা
মাতারিকি আকাশের পরী। আকাশের পরী যারা, তাদের একটি করে তারা থাকে। মাতারিকি তার তারাটিকে রোজ সকালে শিশির দিয়ে ধুয়ে মেজে এমনি চকচক ক’রে সাজিয়ে রাখত যে, রাত্রিবেলা সবার আগে তার উপরেই লোকের চোখ পড়ত— আর সবাই বলত— “কী সুন্দর!” তাই শুনে শুনে আর সব আকাশ-পরীদের ভারি হিংসা হ’ত।
তানে হচ্ছেন গাছের দেবতা। তিনি গাছে গাছে রস যোগাতেন, ডালে ডালে ফুল ফোটাতেন আর গাছের সবুজ তাজা পাতার দিকে অবাক হ’য়ে ভাবতেন— ‘এ জিনিস দেখলে আর কিছুর পানে লোকে ফিরেও চাইবে না।’ কিন্তু লোকেরা গাছের উপর বার বার কেবল মাতারিকির তারা দেখত, আর কেবল তার কথাই বলত। তানের বড় রাগ হ’ল। সে বলল, “আচ্ছা, তারার আলো আর কতদিন? দুদিন বাদেই ঝাপসা হয়ে আসবে।” কিন্তু যতদিন যায় তারা উজ্জ্বল আর সুন্দর হয়, আর সবাই তার দিকে ততই বেশি ক’রে তাকায়। একদিন অন্ধকার রাত্রে যখন সবাই ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে, তখন তানে চুপি চুপি দুজন আকাশ-পরীর কানে কানে বলল, “এস ভাই, আমরা সবাই মিলে মাতারিকিকে মেরে তারাটাকে পেড়ে আনি।” পরীরা বলল, “চুপ চুপ, মাতারিকি জেগে আছেন। পূর্ণিমার জোছনা রাতে আলোয় শুয়ে মাতারিকি চোখ যখন আপনা হ’তে ঢুলে আসবে, সেই সময়ে আবার এস।”
এসব কথা কেউ শুনল না, শুনল খালি জলের রাজার ছোট্ট একটি মেয়ে। রাজার মেয়ে রাত্রি হলেই, সেই তারাটির ছায়া নিয়ে খেলতে খেলতে জলের নীচে ঘুমিয়ে পড়ত আর মাতারিকির স্বপ্ন দেখত। দুষ্ট পরীর কথা শুনে তার দু’ চোখ ভ’রে জল আসল।
এমন সময় দখিন হাওয়া আপন মনে গুনগুনিয়ে জলের ধারে এসে পড়ল। রাজার মেয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগল, “দখিন হাওয়া শুনেছ? ওরা মাতারিকিকে মারতে চায়।” শুনে দখিন হাওয়া ‘হায়’ ‘হায়’ ক’রে কেঁদে উঠল। রাজার মেয়ে বলল, “চুপ চুপ, এখন উপায় কি বল ত?” তখন তারা দুজনে পরামর্শ করল যে, মাতারিকিকে জানাতে হবে— সে যেন পূর্ণিমার রাতে জেগে থাকে।
ভোর না হ’তে দখিন হাওয়া রাজার মেয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বলল, “এখন যেতে হবে।” সূর্য তখন স্নানটি সেরে সিঁদুর মেখে সোনার সাজে পুবের দিকে দেখা দিচ্ছেন। রাজার মেয়ে তার কাছে আবদার করল, “আমি আকাশের দেশে বেরাতে যাব।” সূর্য তাঁর একখানি সোনালি কিরণ ছড়িয়ে দিলেন। সেই কিরণ বেয়ে বেয়ে রাজার মেয়ে উঠতে লাগল। সকাল বেলার কুয়াশা দিয়ে দক্ষিণ হাওয়া তাকে ঘিরে চারদিকেতে ঢেকে রাখল। এমনি করে রাজার মেয়ে মাতারিকির বাড়িতে গিয়ে, সব খবর বলে আসল। মাতারিকি কি করবে? সে বলল, “আমি আর কোথায় যাব? পূর্ণিমার রাতে এইখানেই পাহারা দিব— তারপর যা হয় হবে।”
রাজার মেয়ে ঝাপ্সা মেঘের আড়াল দিয়ে বৃষ্টি বেয়ে নেমে আসলেন।
তারপর পূর্ণিমার রাতে তানে আর সেই দুষ্টু পরীরা ছুটে বেরুল মাতারিকির তারা ধরতে। মাতারিকি দু’হাত দিয়ে তারাটিকে আঁকড়ে ধ’রে, প্রাণের ভয়ে ছুটতে লাগল। ছুট্ ছুট্ ছুট্! আকাশের আলোর নীচে, ছায়াপথের ছায়ায় ছায়ায় নিঃশব্দে ছুটাছুটি আর লকোচুরি। দখিন হাওয়া স্তব্ধ হ’য়ে দেখতে লাগল, রাজার মেয়ে রাত্রি জেগে অবাক হ’য়ে তাকিয়ে রইল। তারায় তারায় আকাশ-পরী, কিন্তু মাতারিকি যার কাছেই যায়, সেই তাকে দূর দূর ক’রে তাড়িয়ে দেয়।
ছুটতে ছুটতে মাতারিকি হাঁপিয়ে পড়ল- আর সে ছুটতে পারে না। তখন তার মনে হ’ল, ‘জলের দেশে রাজার মেয়ে আমায় বড় ভালোবাসে— তার কাছে লুকিয়ে থাকি।’ মাতারিকি ঝুপ ক’রে জলে পড়েই ডুব, ডুব, ডুব— একেবারে জলের তলায় ঠাণ্ডা কালো ছায়ার নীচে লুকিয়ে রইল। রাজার মেয়ে অমনি তাকে শেওলায় ঢেকে আড়াল করল।
সবাই তখন খুঁজে সারা— “কোথায় গেল, কোথায় গেল?” একজন পরী ব’লে উঠল, “ঐ ওখানে— জলের নীচে।” তানে বললেন, “বটে! মাতারিকিকে লুকিয়ে রেখেছ কে?” রাজার মেয়ের বুকের মধ্যে দুর দুর ক’রে কেঁপে উঠল— কিন্তু সে কোন কথা বলল না। তখন তানে বলল, “আচ্ছা দাঁড়াও। আমি এর উপায় করছি।” তখন সে জলের ধারে নেমে এসে, হাজার গাছের শিকড় মেলে শোঁ শোঁ করে জল টানতে লাগল।
মাতারিকি জল ঝেড়ে উঠে আসল। জলের নীচে আরামে শুয়ে তার পরিশ্রম দূর হ’য়েছে, এখন তাকে ধরবে কে? আকাশময় ছুটে ছুটে কাহিল হ’য়ে সবাই বলছে, “আর হলো না।” তানে তখন রেগে বলল, “হতেই হবে।” এই ব’লে হঠাৎ সে পথের পাশের একটা মস্ত তারা কুড়িয়ে নিয়ে, মাতারিকির হাতের দিকে ছুড়ে মারল।
ঝন্ ঝন্ ক’রে শব্দ হল, মাতারিকি হায় হায় ক’রে কেঁদে উঠল, তার এতদিনের সাধের তারা সাত টুকরো হ’য়ে ভেঙে পড়ল। তানে তখন দৌড়ে এসে সেগুলোকে দুহাতে ক’রে ছিটিয়ে দিলেন আর বললেন, “এখন থেকে দেখুক সবাই— আমার গাছের কত বাহার।” দুষ্টু পরীরা হো হো করে হাসতে লাগল।
এখনও যদি দখিন হাওয়ার দেশে যাও, দেখবে সেই ভাঙা তারার সাতটি টুকরো আকাশের নীচে একই জায়গায় ঝিকমিক করে জ্বলছে। ঘুমের আগে রাজার মেয়ে এখনও তার ছায়ার সঙ্গে খেলা করে। আর জোছনা রাতে দখিন হাওয়ায় মাতারিকির দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।
ভুল গল্প
[ এই গল্পের মধ্যে ইচ্ছা করিয়া কতগুলি ভুল বর্ণনা করা হইয়াছে। কোথাও হয়ত এমন কথাও লেখা হইয়াছে যাহা একেবারেই অসম্ভব; অথবা এক জায়গায় যাহা লেখা হইয়াছে অন্য জায়গায় তাহারই উল্টা কথা বলা হইয়াছে— একটা ঠিক হইলে আর একটা ঠিক হইতেই পারে না। দেখ তো এই রকম ভুল কতগুলি বাহির করিতে পার। ]