ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী
যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।
সে যখন তাড়াতাড়ি চলে অথবা ব্যস্ত হইয়া কথা বলে, তখন তাহার হাত-পা ছোঁড়ার ভঙ্গি দেখিয়া হঠাত্ চিংড়িমাছের কথা মনে পড়ে।
সে যে বোকা ছিল তাহা নয়। অঙ্ক কষিবার সময়, বিশেষত লম্বা-লম্বা গুণ-ভাগের বেলায় তার আশ্চর্য মাথা খুলিত। আবার এক-এক সময় সে আমাদের বোকা বানাইয়া তামাশা দেখিবার জন্য এমন সকল ফন্দি বাহির করিত, যে আমরা তাহার বুদ্ধি দেখিয়া অবাক হইয়া থাকিতাম।
দাশু, অর্থাৎ দাশরথি, যখন প্রথম আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়, তখন জগবন্ধুকে আমাদের ক্লাশের ‘ভালো ছেলে’ বলিয়া সকলে জানিত। সে পড়াশুনায় ভালো হইলেও, তাহার মতো অমন একটি হিংসুটে ভিজেবেড়াল আমরা আর দেখি নাই। দাশু একদিন জগবন্ধুর কাছে কি একটা ইংরাজি পড়া জিজ্ঞাসা করিতে গিয়াছিল। জগবন্ধু পড়া বলিয়া দেওয়া দূরে থাকুক, তাহাকে বেশ দু’কথা শোনাইয়া বলিল, “আমার বুঝি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? আজ এঁকে ইংরিজি বোঝাব, কাল ওঁর অঙ্ক কষে দেব, পরশু আরেকজন আসবেন আরেক ফরমাইস নিয়ে- ঐ করি আর কি!” দাশু সাংঘাতিক চটিয়া বলিল, “তুমি তো ভারি চ্যাঁচড়া ছোটোলোক হে!” জগবন্ধু পণ্ডিতমহাশয়ের কাছে নালিশ করিল, “ঐ নতুন ছেলেটা আমাকে গালাগালি দিচ্ছে।” পণ্ডিতমহাশয় দাশুকে এমনি দু-চার ধমক দিয়া দিলেন যে, সে বেচারা একেবারে দমিয়া গেল।
তার পর কয়দিন দাশু জগবন্ধুর সহিত কথাবার্তা কহে নাই। পণ্ডিতমহাশয় রোজ ক্লাশে আসেন, আর যখন দরকার হয়, জগবন্ধুর কাছে বই চাহিয়া লন। একদিন তিনি পড়াইবার সময় উপক্রমণিকা চাহিলেন, জগবন্ধু তা।ড়াতাড়ি তাহার সবুজ কাপড়ের মলাট দেওয়া উপক্রমণিকাখানা বাহির করিয়া দিল। পণ্ডিতমহাশয় বইখানি খুলিয়াই হথাত্ গম্ভীর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বইখানা কার?” জগবন্ধু বুক ফুলাইয়া বলিল, “আমার।” পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “হুঁ- নূতন সংস্করণ বুঝি? বইকে বই একেবারে বদলে গেছে।” এই বলিয়া তিনি পড়িতে লাগিলেন, “যশোবন্ত দারোগা- লোমহর্ষক ডিটেক্টিভ নাটক।” জগবন্ধু ব্যাপারখানা বুঝিতে না পারিয়া বোকার মতো তাকাইয়া রহিল। পণ্ডিতমহাশয় বিকটরকম চোখ পাকাইয়া বলিলেন, “স্কুলে আমার আদুরে গোপাল, আর বাড়িতে বুঝি নৃসিংহ অবতার?” জগবন্ধু আম্তা-আম্তা করিয়া কি যেন বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু পণ্ডিতমহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, “থাক, থাক, আর ভালোমানুষি দেখিয়ে কাজ নেই- ঢের হয়েছে।” লজ্জায়, অপমানে জগবন্ধুর দুই কান লাল হৈয়া উঠিল- আমরা সকলেই তাহাতে বেশ খুশি হইলাম। পরে জানা গেল যে, এটি দাশুভায়ার কীর্তি, সে মজা দেখিবার জন্য উপক্রমণিকার জায়গায় ঠিক ঐরূপ মলাট দেওয়া একখানা বই রাখিয়া দিয়াছিল।
দাশুকে লইয়া আমরা সর্বদাই ঠাট্টা-তামাশা করিতাম এবং তাহার সামনেই তাহার বুদ্ধি ও চেহারা সম্বন্ধে অনেক অপ্রীতিকর আলোচনা করিতাম। তাহাতে বিরক্ত হওয়া দূরে থাকুক, বরং তাহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইত যেন সে বেশ আমোদ পাইতেছে। একেক সমযে সে নিজেই উত্সাহ করিয়া আমাদের মন্তব্যের উপর রঙ চড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে নানারকম অদ্ভুত গল্প বলিত! একদিন সে বলিল, “ভাই, আমাদের পাড়ায় যখনই কেউ আমসত্ত্ব বানায় তখনই আমার ডাক পড়ে। কেন জানিস?” আমরা বলিলাম, “খুব আমসত্ত্ব খাস বুঝি?” সে বলিল, “তা নয়। যখন আমসত্ত্ব শুকোতে দেয় আমি সেইখানে ছাদের ওপর বার দুয়েক এই চেহারাখানা দেখিয়ে আসি। তাতেই পাড়ার ত্রিসীমানার মধ্যে যত কাক সব ‘ত্রাহি ত্রাহি’ করে ছুটে পালায়। কাজেই আর আমসত্ত্ব পাহারা দিতে হয় না।”
প্রত্যেকবার ছুটির পরে স্কুলে ফিরিবার সময় দাশু একটা-না-একটা কাণ্ড বাধাইয়া আসে। একবার সে হঠাৎ পেণ্টেলুন পরিয়া স্কুলে হাজির হইল। ঢলঢলে পায়জামার মতো পেণ্টেলুন আর তাকিয়ার খোলের মতো কোট পরিয়া তাহাকে যে কিরূপ অদ্ভুত দেখাইতেছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতেছিল এবং সেটা তাহার কাছে ভারি একটা আমোদের ব্যাপার বলিয়া বোধ হইতেছিল। আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, “পেণ্টেলুন পরেছিস কেন?” দাশু একগাল হাসিয়া বলিল, “ভালো করে ইংরাজি শিখব বলে।” আরেকবার সে খামখা নেড়া মাথায় এক পট্টি বাঁধিয়া ক্লাশে আসিতে আরম্ভ করিল এবং আমরা সকলে তাহা লইয়া ঠাট্টা-তামাশা করায় যারপরনাই খুশি হইয়া উঠিল। দাশু আদপেই গান গাহিতে পারে না। তাহার যে তালজ্ঞান বা সুরজ্ঞান একেবারেই নেই, এ কথা সে বেশ জানে। তবু সেবার ইনস্পেক্টর সাহেব যখন স্কুল দেখিতে আসেন- তখন আমাদের খুশি করিবার জন্য সে চীত্কার করিয়া গান শুনাইয়াছিল। আমরা কেহ ওরূপ করিলে সেদিন রীতিমতো শাস্তি পাইতাম। কিন্তু দাশু ‘পাগলা’ বলিয়া কেহ তাহাকে কিছু বলিল না।
ছুটির পরে দাশু নূতন কি পাগলামি করে, তাহা দেখিবার জন্য আমরা ব্যস্ত হইয়া স্কুলে আসিতাম। কিন্তু যেবার সে অদ্ভুত এক বাক্স বগলে লইয়া ক্লাশে হাজির হইল, তখন আমরা বাস্তবিকই আশ্চর্য হইয়াছিলাম্। আমাদের মাস্টারমহাশয় জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হে দাশু, ও বাক্সের মধ্যে কি এনেছ?” দাশু বলিল, “আজ্ঞে, আমার জিনিসপত্র।” ‘জিনিসপত্র’টা কিরূপ হইতে পারে, এই লইয়া আমাদের মধ্যে বেশ একটু তর্ক হইয়া গেল। দাশুর সঙ্গে বই, খাতা, পেনসিল, ছুরি, সবই তো আছে, তবে আবার জিনিসপত্র কি রে বাপু? দাশুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে সোজাসুজি কোনো উত্তর না দিয়া বাক্সটিকে আঁকড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, “খবরদার, আমার বাক্স তোমরা কেউ ঘেঁটো না।” তাহার পর চাবি দিয়া বাক্সটাকে একটুখানি ফাঁক করিয়া, সে তাহার ভিতরে চাহিয়া কি যেন দেখিয়া লইল এবং ‘ঠিক আছে’ বলিয়া গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িয়া বিড়্বিড়্ করিয়া হিসাব করিতে লাগিল। আমি একটুখানি দেখিবার জন্য উঁকি মারিতে গিয়াছিলাম- অমনি পাগলা মহা ব্যস্ত হইয়া তাড়াতাড়ি চাবি ঘুরাইয়া বাক্স বন্ধ করিয়া ফেলিল।